Categories: সারাদেশ

পাওয়ার হাউজ, বিপর্যয়ের নেপথ্যে

একটি পাওয়ার হাউজের ‘পতন’। নাটকীয় এবং অবিশ্বাস্য। এক যুগের বেশি সময় ধরে বাড়িটি ছিল ক্ষমতার ভরকেন্দ্র। ফরিদপুরের রাজনীতি বা প্রশাসন কেউই এর বাইরে ছিল না। এ বাড়ির প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়েই গড়ে ওঠে বাবর-বরকত-রুবেল-ফুয়াদ সিন্ডিকেট। তাদের প্রত্যেকেই এখন কারাগারে। এটি কখনো ভাবা গেছে! এই সরকারের আমলে! জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা অবশ্য এ প্রশ্নের জবাব দিলেন অনেকটা দার্শনিক ভঙ্গিতে। একে তিনি মনে করেন, পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

বলেন, ধর্মেও বলা আছে, ‘আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।’ কেন, কীভাবে বিপর্যয় এই পাওয়ার হাউজের? কেবল ফরিদপুর নয়, সারা দেশেই এ নিয়ে কৌতূহল। নানা আলোচনা। বেশ কয়েকটি ঘটনা সামনে এসেছে। রয়েছে নানা গুঞ্জন, গুজবও।

ডেটলাইন ১৬ই মে, ২০২০: সুবল চন্দ্র সাহা। প্রবীণ আইনজীবী। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। একসময় পরিচিত ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছের লোক হিসেবে। যদিও সুবল চন্দ্র সাহা মনে করেন, গঠনতন্ত্র মেনেই স্থানীয় এমপি’র সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সে যাই হোক। ১৬ই মে, ২০২০। সুবল চন্দ্র সাহার ফরিদপুর শহরের বাসায় দুই দফায় হামলা চালায় বরকত-রুবেল গং। চালানো হয় ভাঙচুর এবং তাণ্ডব।

অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই ঘটনা পাওয়ার হাউজের পতন ত্বরান্বিত করে। মামলা করেন সুবল সাহা। কিছুদিন পর গ্রেপ্তার করা হয় শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলকে। পর্দার আড়ালে কি ঘটেছিল? কেন খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলো সুবল সাহার।

কিইবা ঘটেছিল সে রাতে? সরাসরি জানতে চেয়েছিলাম, সুবল চন্দ্র সাহার কাছে। পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। বলেন, ‘আমি যেহেতু সবসময় তাদের সঙ্গে থাকতাম, তাদের যে আকাম-কুকাম সবই আমাদের চোখে পড়ে গেছে।’ আর একটা ইমিডিয়েট কারণ থাকতে পারে। সুবল সাহা বলে যান, একদিন আমাদের জেলা কমিটির ইফতার মাহফিল হলো। আমরা করলাম। আমাদের কার্যক্রম অফিসে করতে পারতাম না। সবই উনার বাড়িতে (খন্দকার মোশাররফ হোসেন) করতে হতো। যখন আমাদের থানা কমিটির ইফতার পার্টি হবে। তার দুই দিন আগে আমি উনার বাড়িতেই পড়ে গিয়ে আহত হলাম। আমি ক্ষতিগ্রস্ত হই। চলাফেরা করতে পারতাম না। তারপর সম্ভবত ১২ তারিখ হবে, জননেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফরিদপুরে আমাদের একটা ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত থাকার নির্দেশ দিলেন। আমি চিন্তা করলাম, যেহেতু আমি জেলা সভাপতি।

তাই আমার থাকা উচিত। আমি ব্যথানাশক ওষুধ গ্রহণ করে, আমার ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্টে ভিডিও কনফারেন্সে ছিলাম। মন্ত্রী মহোদয় বললেন, তুমি সুস্থ হিসেবে সেখানে গেলা। আর তুমি আমার এখানে ইফতার পার্টিতে আসো না। তিনি এই দোষ ধরে আমার ওপর ভীষণভাবে রাগান্বিত হলেন। মন্ত্রী মহোদয় যদি ভিডিও কনফারেন্সের কথা বলতেন তাহলে দোষ ছিল না, তিনি বললেন, তুমি ডিসির ইফতার পার্টিতে অংশ নিলা। আসলে এটা নেত্রীর ভিডিও কনফারেন্স ছিল। দুপুরের দিকে ওই দুই ভাই, বরকত-রুবেল আমাকে থ্রেট করলো। তারপর সন্ধ্যায় এই ঘটনা ঘটালো। দুইশ’-আড়াইশ’ লোক ছিল। আমার বাড়ি আক্রমণ করলো। দুই দফায়। প্রথম দফায় আসলো। কিছু আমাদের পৌর কমিটির সদস্য ছিল।

তারা বললো, উনি তো আপনার ওপর খুব ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আপনি গিয়ে একটু মাফ চেয়ে আসেন। আমি বললাম, কেন? আমি অসুস্থ ছিলাম। তারপরও আমার স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে উনার বাড়িতে গেলাম। কিন্তু উনি ঢুকতে দিলেন না। তারপর আমি চলে আসলাম। পরে আবার খবর পেলাম, আমাকে যেতে বলেছেন। আমি আবার গেলাম। সেখানে বসে রইলাম। কিন্তু তিনি দেখা করলেন না। এরইমধ্যে আমার পুত্রবধূ ফোন করলেন যে, আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করেছে। ভীষণভাবে আক্রমণ করেছে। দুইশ’-আড়াইশ’ লোক ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছে। জানালা ভাঙছে। বাঁশে আগুন দিয়েছে। একটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। আমি একদম নিরুপায়। কাকে বলবো? আমি জানতাম, এসপি সাহেব বদলি হয়ে গেছেন। তারপরও আমি তাকে ফোন দিলাম। উপায়ান্তর না দেখে, উনাদেরই জামাই, ডা. হাবিবে মিল্লাত, তাকে ফোন করলাম।

এই ঘটনার পর সকালবেলা ওবায়দুল কাদের সাহেব আমাকে ফোন করেন। হাউমাউ করে আমি সব বলতেছিলাম। কাদের সাহেব বললেন, ‘দাদা আপনার কিচ্ছু বলতে হবে না। আমরা সব জানি, নেত্রী সব জানেন। নেত্রী শুধু জিজ্ঞেস করেছেন আমার কাছে, আপনি কি অক্ষত আছেন? না হাসপাতালে ভর্তি আছেন?’ তার কয়েকদিন পরই রুবেল-বরকতকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দুর্নীতি, হাতুড়ি সন্ত্রাস: জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক দীপক মজুমদার। ২০২০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি নিজ মালিকানাধীন মজুমদার ড্রাগ হাউজে হেলমেট বাহিনীর হামলার শিকার হন। তাকে মারাত্মকভাবে কুপিয়ে জখম করা হয়। সোমবার শহরে তার বাসায় বসে বলছিলেন, কীভাবে হামলার শিকার হন তিনি। দীপক মজুমদার বলেন, ‘ওদের হাতে সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।’ আশিষ পোদ্দার বিমান। স্থানীয় সাংবাদিক। গণসংহতি পত্রিকার সম্পাদক। ২০১৯ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি তার ওপর হামলা চালায় বরকত-রুবেল বাহিনী। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। তার দাবি, এমনকি তাকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেও দেয়া হয়নি। তিনি পরে এ ব্যাপারে নালিশ করেন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। চাপে পড়ে তার সব চিকিৎসা খরচ বহন করে রুবেল-বরকতরা।

তিনবার ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। তবে এখনো যন্ত্রণা বয়ে বেড়ান। আশিষ পোদ্দার জানান, ২০১৬ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর। কিন্তু ব্যর্থ হন। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল আশিষ পোদ্দারের সম্পাদিত পত্রিকায়। এতে ক্ষুব্ধ হয় সিন্ডিকেট। তাকে তুলে নিয়ে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে রাতে চালানো হয় হামলা।

এ ছাড়াও এ বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, বীরমুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শওকত আলী, ছাত্রলীগ নেতা মনির হোসেনসহ অনেকে। এসব হামলার ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে নালিশ গেছে। ২০১৯ সালের ১৭ই অক্টোবর মানবজমিন-এ প্রকাশিত ‘ফরিদপুরে দুই ভাইয়ের ত্রাসের রাজত্ব’ শিরোনামের রিপোর্টটি এখনো আলোচনায়।

স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বলছেন, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের কারণেই পতন হয়েছে পাওয়ার হাউজের। বিএনপি নেতা সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছা বলেন, আমরা বহুদিন ধরেই বলে আসছি এখানে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সব সীমা অতিক্রম করে গেছে। যে কারণে এত প্রভাবশালী হওয়ার পরও এরা আইনের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শামীম হক বলেন, ‘দুর্নীতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি দলের লোক, বাইরের লোক, আত্মীয়স্বজন দেখেন না। তিনি ফরিদপুর দিয়ে সারা দেশের মানুষকে দেখিয়ে দিলেন, দুর্নীতিবাজের ক্ষমা নেই। এ শুদ্ধি অভিযান চলমান।

আগামীদিনে এটি আরও তীব্র হবে আশা করি।’ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন অবশ্য এখনই কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করতে রাজি নন। তিনি বলেন, যার শেষ ভালো, তার সব ভালো। শেষ পর্যন্ত কী হয় তা না দেখে এখন কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে যা হয়েছে তা রাজনীতির জন্য সুখবর, মঙ্গলজনক।

গুজবের শহর: গুজবের মেশিন। বাংলাদেশে বহু বছর ধরেই সক্রিয়। ঘোরার গতির তারতম্য হয় এই যা। পাওয়ার হাউজের কেন এই বিপর্যয়? এ নিয়ে ফরিদপুর শহরে গুজবের কোনো অভাব নেই। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত এর ডালপালা। নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায়ই নেই।

banglaekattor

Recent Posts

মায়ের পথ অনুসরণ করে চলচ্চিত্রে দিতিকন্যা লামিয়া

ঢাকাই সিনেমার প্রবাদপ্রতিমা অভিনেত্রী পারভীন সুলতানা দিতির মেয়ে লামিয়া চৌধুরী চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে তার মায়ের…

১ সপ্তাহ ago

আমরা দেখলাম, কীভাবে একজন ন’টীর জন্ম হয় : বন্যা মির্জা

নেটফ্লিক্সে আজ মুক্তি পাচ্ছে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন অভিনীত প্রথম হিন্দি ওয়েব ফিল্ম ‘খুফিয়া’। এ…

৭ মাস ago

প্রকাশ্যে এলো রাজ-বুবলীর ‘গোপন’ রহস্য

বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় দুই অভিনয়শিল্পী শরিফুল রাজ ও শবনম বুবলী। কয়েক দিন আগে জানা গিয়েছিল,…

৮ মাস ago

পরীমণি এত টাকা কোথায় পান, জানালেন নিজেই

ক’দিন আগেই চিত্রনায়ক শরিফুল রাজের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ সেরেছেন নায়িকা পরীমণি। এখন পুত্র রাজ্যকে ঘিরেই…

৮ মাস ago

‘খেলা হবে’র পর নতুন সূচনা পরীমণির

মা হওয়ার সুবাদে দুই বছর কাজ থেকে দূরে ছিলেন। সেই বিরতি কাটিয়ে কাজে নিয়মিত হচ্ছেন।…

৮ মাস ago

শুভশ্রীর ৪০ সেকেন্ডের ভিডিও ভাইরাল

টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের ৪০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে…

৮ মাস ago