Categories: জাতীয়

একচোখা দা’জ্জাল মিডিয়া ও কো’ণঠাসা ফি’লিস্তিন

‘ফিলিস্তিনিদের কোনো কিছু বলতে মানা’—১৯৮৪ সালে এই বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন ওরিয়েন্টালিজমখ্যাত ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান বুদ্ধিজীবী ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাঈদ। তাঁর এই উক্তির ৩৬ বছর পর ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার অধ্যাপক এবং ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত লেখক মাহা নাসের ২০২০ সালে দুটি দৈনিক—নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট এবং দুটি সাপ্তাহিক—দ্য নিউ রিপাবলিক ও দ্য নেশন-এর ১৯৭০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ছাপা হওয়া সব মন্তব্য প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেছেন। দীর্ঘদিন গবেষণার পর মাহা নাসেরের মন্তব্য, এসব পত্রিকার সম্পাদকীয় পর্ষদ ও কলামিস্টরা সম্ভবত আগে থেকেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন, ফিলিস্তিনিদের স’মস্যা নিয়ে তাঁরা কিছু লিখবেন না। এই কাগজগুলোর এত বছরের সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় ঘেঁটে তাঁর মনে হয়েছে, এই সাংবাদিকেরা ফিলিস্তিনিদের কোনো কথা শোনারই প্রয়োজন বোধ করেননি।

পত্রিকা, বার্তা সংস্থা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর একদেশদর্শিতা
আজ সেই একচোখা নীতির প্রতিফলন প্রায় সব পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে। শুধু ফিলিস্তিনেদের কথা না শোনার নীতি অনুসরণেই তারা থেমে থাকেনি, বরং সমন্বিতভাবে তারা এই উন্মুক্ত জে’লখানার বাসিন্দাদের বি’রুদ্ধে তথ্যস’ন্ত্রাস চা’লিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনায় সেই বি’ষয়টি একেবারে নাঙ্গা হয়ে গেছে। সর্বশেষ ঘটনায় আমরা কী দেখলাম?

দেখলাম, ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’ লাইলাতুল কদরে নবী সুলাইমান (আ.) (সাধারণ ইতিহাসে যিনি কিং সলোমন নামে পরিচিত) এর স্মৃ’তিবিজ’ড়িত আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন ফিলিস্তিনি মু’সলমানেরা। অতর্কিতে হা’নাদার ই’সরায়েলি বাহিনী ঢুকে পড়ল। নির্বিচারে রাবার বু’লেট ও সাউন্ড গ্রে’নেড ফাটাতে লাগল তারা। প্রচুর মুসল্লি হ’তাহত হলেন। পরদিন আবার তাঁদের ও’পর হা’মলা হলো। এরপর ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্টের বরাত দিয়ে এএফপি তাদের খবরের শিরোনাম করল, ‘জেরুজালেমে নতুন সং’ঘাতে শত শত হ’তাহত: জরুরি সেবাদাতা সংস্থা’, এই শিরোনাম পড়ে প্রথমে আপনি বুঝতে পারবেন না, কোন পক্ষ হা’মলা করেছে আর কোন পক্ষের লোক হ’তাহত হয়েছে। এই খবরের বিস্তারিত বর্ণনায় গেলে তখন আপনি জানতে পারবেন, জেরুজালেমের ওই সং’ঘাতে হ’তাহত মানুষের শতকরা ৯৮ থেকে ৯৯ জনই ছিল ফিলিস্তিনি। এটি এএফপি ভালো করেই জানে। তারপরও এই ‘নিরপেক্ষ’ সংবাদমাধ্যমটি শিরোনামে সে বি’ষয়টি পরিষ্কার করেনি। শিরোনাম পড়ে প্রথমেই যে ধারণা তৈরি হয়, তা তারা পাঠকের অনুমান শক্তির ও’পর ছেড়ে দিয়েছে।

গবেষণা বলছে, প্রতি ১০ জন পাঠকের ৮ জনই খবরের শুধু শিরোনামের ও’পর চোখ বুলিয়ে খবর সম্পর্কে একটা ভাসা ভাসা ধারণা নেন। বাকি ২ জন খবরের টেক্সটে ঢোকেন। তার মানে, এই শিরোনাম দিয়ে যারা হা’মলা চা’লিয়েছে এবং বিপুলসংখ্যক মানুষকে হ’’ত্যা করেছে তাদের দায়মুক্তির ‘ফ্রি পাস’ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে সংবাদমাধ্যমগুলোর এই ধূর্তামি বহু পুরোনো। এরা সম্পাদনার মারপ্যাঁচে আ’ক্রমণকারী আর ভু’ক্তভোগীকে এক পাল্লায় মেপে দেয়।

এসব মিডিয়া আউটলেটের নীতি এতটাই একচোখা যে তারা যদ্দুর সম্ভব ‘প্যালেস্টাইন’ কথাটাই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কোনো ফিলিস্তিনিকে তাঁর জমি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে কোনো ইহুদিকে বসিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ বর্ণনার সময় তারা ওই দ’খলদার ইহুদিকে বারবার ‘সেটলার’ হিসেবে উল্লেখ করতে থাকে। এই ‘সেটলার’ শব্দের মধ্য দিয়ে পাঠকের মনস্তত্ত্বে এমন একটি দ্যোতনা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়, পাঠকের মনে হবে এই ইহুদি কোনো বিরান ভূমিতে বসতি স্থাপন করেছেন। তিনি বিরান ভূমিতে ‘প্রা’ণের ছোঁয়া’ দিয়েছেন।

আল-আকসা মসজিদ ও তার আশপাশে বহু শি’শু, নারীসহ বেসা’মরিক লোককে ই’সরায়েলের সে’নারা মে’রে ফেলার পর গাজা থেকে হামাসের প্রতিরোধযো’দ্ধারা যখন ই’সরায়েলের দিকে রকেট ছুড়লেন, তখন সেই ছবি প্রথমে যতটা সম্ভব ভ’য়াবহভাবে প্রচার করা হলো। এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হলো যেন ফিলিস্তিনিরা স’ন্ত্রাসী। তাদের আত্মরক্ষা বা প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার নেই। এরপরই ই’সরায়েলের বিমান থেকে শুরু হলো বো’মা বর্ষণ। স্থলপথে ট্যাংক নিয়ে হা’মলা। একের পর এক গাজার বাড়িঘর ধসিয়ে দেওয়া হলো। মা’র্কিন প্রে’সিডেন্ট জো বাইডেন হামাসের রকেট ছোড়াকে সাং’ঘাতিক খা’রাপ কাজ বলে প্রথমে খানিক নি’ন্দা করলেন এবং পরে বললেন, ‘ই’সরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।’ মানে ই’সরায়েল যদি মনে করে তার নিরাপত্তা হু’মকিতে আছে, তাহলে তারা বেশুমার বো’মা মে’রে নিষ্পাপ শি’শুদেরও হ’’ত্যা করতে পারে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সায় থাকবে।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো কীভাবে ই’সরায়েলকে নির্বিচারে মানুষ মা’রার নৈতিক সমর্থন দিয়ে রেখেছে, তা ‘মিডল ইস্ট আই’ নামের একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত ফয়সাল হানিফ নামের একজন লেখকের ‘আল-আকসা অ্যাটাকস: হাউ দ্য মিডিয়া গিভস ই’সরায়েল আ ফ্রি পাস’ শিরোনামের একটি লেখা পড়লে কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। সেখানে ফয়সাল লিখেছেন, তিনি সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং নামের একটি সংগঠনের জোগাড় করা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। তাতে তিনি দেখেছেন, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল—এই এক বছরে গাজায় ফিলিস্তিনিদের নি’র্যাতন-নি’পীড়নের পেছনে ই’সরায়েলের হাত থাকার যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ১৮২টি ঘটনাই মূলধারার গণমাধ্যম চে’পে গেছে। এর মধ্যে এএফপি, রয়টার্স ও এপি—এই তিনটি বিশ্বখ্যাত ‘নিরপেক্ষ’ বার্তা সংস্থা চে’পে গেছে ১৪৩টি খবর।

গোটা গাজা ভূখণ্ড ‘উন্মুক্ত জে’লখানা’ হয়ে আছে। ক্ষুধা ও অনাহারে মরতে বসা মানুষ যখনই অধিকার চেয়ে মুখ খোলে, তখনই গু’লি চা’লানো হয়। শুধু ২০১৮ সালেই ই’সরায়েলি সে’নাদের গু’লিতে সেখানে আড়াই শ ফিলিস্তিনি নি’হত ও ২৫ হাজার আ’হত হয়েছে।

ফয়সাল হানিফ বলছেন, এই এক বছরে ই’সরায়েলি সে’নাদের গু’লিতে ফিলিস্তিনিদের নি’হত হওয়ার যত ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে অন্তত ২১টি ঘটনায় বার্তা সংস্থাগুলো তাদের হেডলাইনে তথ্য আড়াল করেছে। অথবা ভু’ল বার্তা দেওয়া শিরোনাম দিয়েছে। যেমন কোনো একজন কি’শোরকে ই’সরায়েলি সে’না গু’লি করে মারল, তখন তারা শিরোনাম করবে, ‘সং’ঘর্ষে বালক নি’হত’। এখানে বালকটিকে ‘ফিলিস্তিনি বালক’ বলা হবে না। নি’হত হওয়ার আগে যে ‘সং’ঘর্ষ’ হয়েছিল, তার প্রমাণ হিসেবে বলা হবে, ‘ওই বালক পাথর ছু’ড়ে ই’সরায়েলি বাহিনীর ও’পর হা’মলা চা’লিয়েছিল’। অনেক সময় ‘কিলড’ শব্দটি ব্যবহার না করে সেটিকে আরও মোলায়েম ভাষায় বলা হয়, ‘ডাই’য়িজ ফ্রম উন্ডস ইন বর্ডার আনরেস্ট’ (সীমান্ত উ’ত্তেজনার সময় আ’ঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মা’রা গেছে)। কিন্তু যখন কোনো ফিলিস্তিনি ছু’রি দিয়ে ই’সরায়েলের কাউকে আ’ঘাত করে এবং সেই আ’ঘাতে যদি সেই ই’সরায়েলি নি’হত হয়, তাহলে এসব বার্তা সংস্থার বর্ণনার ভাষা আমূল বদলে যাবে। সেই খবরের বারবার ‘স্ট্যাবস’, ‘কিলস’—এসব শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে।

ফিলিস্তিনিদের যেকোনো প্রতিরোধ বা আন্দোলনকে স’ন্ত্রাসবাদের তকমা এঁটে দেওয়ার চলও বেশ পুরোনো। তারা কোথাও কোনো মিটিং মিছিল করল, তো বলে দেওয়া হলো এটি স’ন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর সম্মেলন। তাদের জমিতে কোনো ই’সরায়েলি দ’খলদার বিল্ডিং তৈরি করতে গেল এবং তারা বা’ধা দিল, তো সঙ্গে সঙ্গে তাদের স’ন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়া হলো। এতে ই’সরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের হ’’ত্যার বি’ষয়ে দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের জাতিগত মুক্তিসংগ্রামকে ইসলামের সঙ্গে মিলিয়ে ফে’লে ফিলিস্তিনিদের শুধু ‘মু’সলমান’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা জারি আছে।

শবে কদরের ও তার পরের রাতগুলোর সং’ঘাতের খবর প্রচারের সময় রয়টার্স তাদের নিউজের শিরোনামে বারবার ‘রমাদান নাইটস’ শব্দটি উল্লেখ করছিল। এই সং’ঘা’তকে রয়টার্স একটি শিরোনামে ‘রমাদান ভায়োলেন্স’ হিসেবেও উল্লেখ করেছে। আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান চ’রম দক্ষিণপন্থী নেতারা রমজান মাসের সঙ্গে স’ন্ত্রাস ও সহিং’সতা জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইল সম্প্রতি কেটি হপকিন্সের একটি নিবন্ধ ছেপেছে, যাতে কেটি রমজান মাসকে ‘সিজন অব বম্বারস’ বা ‘বো’মাবাজদের মৌসুম’ বলে মন্তব্য করেছেন।

কিছু সংবাদমাধ্যম পেশাদারি তো দূরের কথা, কোনো ভব্যতারও ধার ধারে না। এর মধ্যে একটির নাম বলা যেতে পারে। সেটি হলো কানাডার টেলিভিশন সিবিসি (কানাডিয়ান ব্র’ডকাস্টিং করপোরেশন)। গত ২৭ এপ্রিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২১৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাতে ফিলিস্তিনে ই’সরায়েলের পরিকল্পিত আগ্রাসনের চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ই’সরায়েল ঠান্ডা মাথায় ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এই অতিগুরুত্বপূর্ণ খবরটি সিবিসি বেমালুম চে’পে গেলেও সাবেক মা’র্কিন প্রে’সিডেন্ট বারাক ওবামার কুকুর বো’র ক্যানসারে আ’ক্রান্ত হয়ে মা’রা যাওয়ার খবরটি তারা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে ভু’ল করেনি। পর্তুগিজ ওয়াটার ডগ প্রজাতির কুকুরটিকে তারা ‘হোয়াইট হাউস সেলিব্রেটি’ বলে বিশেষ সম্মানসূচক বিশেষণ দিয়ে যথেষ্ট কা’ন্নাকাটি করে নিউজ প্রচার করেছে।

ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামেও ফিলিস্তিন অচ্ছুত
শুধু কি মূলধারার সংবাদমাধ্যম? না, ফিলিস্তিনের বি’ষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও একচোখা নীতি নিয়ে বসে আছে। জুম, ফেসবুক এবং টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিও একই চেহারা দেখাচ্ছে।

আল-জাজিরায় প্রকাশিত একটি কলাম থেকে জানতে পারছি, গত এপ্রিলে আরব ও মু’সলিম বংশোদ্ভূত প্রবাসীরা এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া হিউম্যানিটিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইউসিএইচআরআই) ও কাউন্সিল অব ইউসি ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশনস (সিইউএফসিএ) যৌথভাবে সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একটি অনলাইন একাডেমিক আলোচনার আয়োজন করেছিল। আলোচনা সভার শিরোনাম ছিল, ‘কার ভাষ্য? ফিলিস্তিনের জন্য কিসের মুক্তবাক?’ সেখানে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনের আইকন লায়লা খালেদ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এএনসি মিলিটারি নেতা রনি কাসরিলের যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জুম এবং অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সেই অনুষ্ঠান সেন্সর করে বসে। সেটি তারা আর হতে দেয়নি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, লায়লা খালেদ পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের (পিএফএলপি) সমর্থক। ওই সংগঠনকে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র স’ন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করে, সেহেতু সে অনুষ্ঠান তারা জুমে হতে দেবে না।

আর ফেসবুকের তো ফিলিস্তিনিদের জায়গা দেওয়ার কোনো কারণই নেই। কারণ ফেসবুকের কনটেন্ট দেখভাল করে অর্থাৎ নজরদারি করে যে ওভারসাইট বোর্ড, তার অন্যতম সদস্য হলেন ই’সরায়েলের বিচার ম’ন্ত্রণালয়ের সাবেক মহাপরিচালক এমি পালমোর। পালমোর একসময় ই’সরায়েলের সাইবার ইউনিটে কাজ করেছেন এবং তিনি ফেসবুক থেকে ফিলিস্তিনপন্থী হাজার হাজার কনটেন্ট অপসারণে লিয়াজোঁ করেছেন।
পূর্ব জেরুজালেমের কাছের শেখ জাররাহ এলাকা থেকে সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের উ’চ্ছেদ করার দৃশ্য অনেকে ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিয়েছিলেন। ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম সে কনটেন্টগুলো পরিকল্পিতভাবে ‘সেন্সর’ করেছে। এসব কনটেন্ট মুছে দেওয়ার যুক্তি দিয়ে ইনস্টাগ্রাম বলছে, এটি নাকি ‘গ্লোবাল টেকনিক্যাল ইস্যু’। সম্প্রতি ফিলিস্তিনি লেখক মারিয়াম বারঘুতির টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় হয়। টুইটার পরে তাঁর অ্যাকাউন্ট সচল করে বলেছে, বারঘুতির অ্যাকাউন্ট ‘দু’র্ঘটনাবশত’ বন্ধ হয়েছিল।

গুগল আর্থ আর অ্যাপল ম্যাপে ঝাপসা গাজা
গুগল আর্থ এবং অ্যাপল ম্যাপও একই তরিকায় হাঁটছে। আপনি গুগল আর্থ বা অ্যাপল ম্যাপে গেলে বিশ্বের যেকোনো জন ঘনবসতিপূর্ণ শহরের হাই রেজল্যুশনের ছবি পাবেন। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ গাজা শহরের ছবি দেখতে যান। দেখবেন সেখানকার ছবি ঝাপসা করে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনে রো’হিঙ্গা মু’সলমানদের বাড়িঘর জ্বা’লিয়ে দেওয়ার চাক্ষুষ প্রমাণ দিয়েছিল গুগল আর্থ। চীনের উইঘুর মু’সলমানদের কোন ব’ন্দিশিবিরে আ’টকে রাখা হয়, তারও প্রামাণ্য দলিল ছিল গুগল আর্থের ছবি। এসব ছবি বিশ্লেষণ করে কখন কোন ভবন ভে’ঙে ফেলা হয়েছে বা কোন এলাকায় বো’মায় কতটুকু ক্ষয়ক্ষ’তি হয়েছে, তা আপনি কম্পিউটার বা মোবাইলের স্ক্রিনেই দেখতে পারেন। কিন্তু গাজার ছবি এখন পাবেন না। খুব কম রেজল্যুশনের ছবি দেওয়া হচ্ছে, যা একেবারেই ঝাপসা।

গুগল তাদের স্যাটেলাইট ইমেজ সরবরাহের বি’ষয়ে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, জন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ছবি তারা নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করে। কিন্তু গাজার ক্ষেত্রে তারা সেই সেবা বন্ধ রেখেছে। সেই হাই রেজল্যুশনের স্যাটেলাইট ইমেজ যদি গুগল কিছুক্ষণ পরপর আপডেট করে আমাদের সরবরাহ করত, তাহলে গাজায় কখন কোন হা’মলায় কয়টা ভবন ধ্বং’স হলো বা সেখানকার পরিস্থিতি কতটা বদলাল, তা সবাই বুঝতে পারত। সেই পথ গুগল ও অ্যাপল বন্ধ করে দিয়েছে।

বিবিসি এই নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে। এ বি’ষয়ে বিবিসি গুগল এবং অ্যাপলের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল। অ্যাপল বলছে, আরও বেশি রেজল্যুশনের ছবি সরবরাহ করার জন্য তারা তাদের ম্যাপ আপডেট করার কাজ করছে। শিগগিরই সেই ছবি তারা দিতে পারবে। আর গুগল অত চালাকির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি বলেছে, উচ্চ রেজল্যুশনের ছবি সরবরাহের জন্য তাদের স্যাটেলাইট ইমেজারি আপডেট করার সুযোগ আছে। কিন্তু এখনই তারা সেটা করবে না।

গুগল আর্থ ও অ্যাপল ম্যাপের মতো পাবলিক ম্যাপিং প্ল্যাটফর্ম সেই সব স্যাটেলাইট কোম্পানির ও’পর নির্ভর করে, যারা ভূ-উপগ্রহ থেকে ছবি তুলে এসব প্ল্যাটফর্মের কাছে বিক্রি করে। এই ধরনের সবচেয়ে বড় দুটি কোম্পানির একটি হলো ম্যাক্সার। অপরটির নাম প্ল্যানেট ল্যাবস। ম্যাক্সার বলেছে, তারা ই’সরায়েল ও গাজার যেসব ছবি গুগলকে সরবরাহ করছে তা ৪০ সিএম রেজল্যুশনের। আর প্ল্যানেট ল্যাবস যে ছবি দেয় তার রেজল্যুশন ৫০ সিএম। এই রেজল্যুশনের ছবি দিয়ে সহজেই একটা গাড়িকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়। এমনকি মানুষের চেহারাও স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু গুগল আর্থ বা অ্যাপল ম্যাপ কেউ সেই রেজল্যুশনের ছবি সরবরাহ করছে না।

ইসলামি ভাষ্যমতে, শেষ জমানায় জেরুজালেম থেকেই দাজ্জাল নামে এক দুষ্ট ব্যক্তির উদ্ভব হবে। দাজ্জাল শব্দের আভিধানিক অর্থ ভ্রান্ত মসিহ, মি’থ্যাবা’দী বা প্র’তারক। তার এক চোখ কানা থাকবে। সে একদেশদর্শী হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনের বি’ষয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম সেই একদেশদর্শী দাজ্জালের ভূমিকা নিয়েছে।

ফিলিস্তিনের পাশে কার্যত কেউ নেই। না পশ্চিমা স’রকারগুলো, না আরব দেশগুলো। না মূলধারার মিডিয়া, না সোশ্যাল মিডিয়া। অ’বরুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা কোণঠাসা হতে হতে একেবারে শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে।

ফিলিস্তিনের চিরনির্বাসিত জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ তাঁর ‘দ্য আর্থ ইজ ক্লোজিং অন আস’ কবিতায় লিখেছিলেন—
‘দুনিয়া ঘনিয়ে আসছে আমাদের দিকে
এ পৃথ্বী ঠেসে ধরছে আমাদের একেবারে শেষ কোনায়

….
শেষ প্রান্তে ঠেকে গেলে যাবটা কোথায়?
শেষ আসমানে ঠেকে গেলে পাখিগুলো উড়বে কোথায়?
হয়ার শুড দ্য বার্ডস ফ্লাই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই?’

এই কবিতার ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’ বা ‘শেষ আসমানের পর’ কথাটি নিয়ে অ্যাওয়ার্ড সাঈদের ফিলিস্তিনি জীবনবি’ষয়ক বই ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’ প্রকাশিত হয়েছিল। এই বই নিয়ে সালমান রুশদির সঙ্গে সাঈদের একটি দীর্ঘ সংলাপ হয়েছিল (আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন: ‘ফিলিস্তিনিদের পরিচয় সন্ধানে এডওয়ার্ড সাঈদ ও সালমান রুশদির বাকবিনিময়’, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ ও সাখাওয়াৎ টিপু ; এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ : আবিশ্ব বিবেকের কণ্ঠস্বর, সম্পাদনা: বেনজিন খান, প্রকাশক: সংবেদ। প্রকাশকাল: ২০০৪ )। সেখানে সাঈদ বলেছিলেন, ‘শেষ আসমানের পর আর কোনো আসমান নেই। শেষ ভূখণ্ডের পর আর কোনো ভূখণ্ড নেই। তাই ফিলিস্তিনিদের আমৃ’ত্যু লড়াই ছাড়া আর কোনো পথও নেই।’

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com

banglaekattor

Recent Posts

মায়ের পথ অনুসরণ করে চলচ্চিত্রে দিতিকন্যা লামিয়া

ঢাকাই সিনেমার প্রবাদপ্রতিমা অভিনেত্রী পারভীন সুলতানা দিতির মেয়ে লামিয়া চৌধুরী চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে তার মায়ের…

২ সপ্তাহ ago

আমরা দেখলাম, কীভাবে একজন ন’টীর জন্ম হয় : বন্যা মির্জা

নেটফ্লিক্সে আজ মুক্তি পাচ্ছে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন অভিনীত প্রথম হিন্দি ওয়েব ফিল্ম ‘খুফিয়া’। এ…

৭ মাস ago

প্রকাশ্যে এলো রাজ-বুবলীর ‘গোপন’ রহস্য

বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় দুই অভিনয়শিল্পী শরিফুল রাজ ও শবনম বুবলী। কয়েক দিন আগে জানা গিয়েছিল,…

৮ মাস ago

পরীমণি এত টাকা কোথায় পান, জানালেন নিজেই

ক’দিন আগেই চিত্রনায়ক শরিফুল রাজের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ সেরেছেন নায়িকা পরীমণি। এখন পুত্র রাজ্যকে ঘিরেই…

৮ মাস ago

‘খেলা হবে’র পর নতুন সূচনা পরীমণির

মা হওয়ার সুবাদে দুই বছর কাজ থেকে দূরে ছিলেন। সেই বিরতি কাটিয়ে কাজে নিয়মিত হচ্ছেন।…

৮ মাস ago

শুভশ্রীর ৪০ সেকেন্ডের ভিডিও ভাইরাল

টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের ৪০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে…

৮ মাস ago