আচমকা ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে নতুন হাওয়া, ঘোষণা দিতে পারেন ইমরান খান

| আপডেট :  ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

আচমকা ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে ‘সুবাতাস’ বইতে শুরু হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে সম্পর্কোন্নয়নে দেশটির তৎপরতা বেশ দৃশ্যমান। কিন্তু এতে ইসলামাবাদ কতোটা সফল হয়েছে? বা ঢাকা কতোটা সাড়া দিয়েছে- তা নিয়ে বিতর্ক বা ভিন্নমত রয়েছে। পেশাদার কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা এটা মানছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন এক যুগবয়সী স’রকারের প্রায় ১১ বছরই ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ছিল। কিন্তু গত ক’মাসে তাতে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। অনেকে এর জন্য চীনকে ক্রেডিট দিতে চান। তারা মনে করেন দৃশ্যপটে না থাকলেও বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক মেরামতে উভ’য়ের বন্ধু চীনই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের প্রবল আপত্তি বিদ্যমান।

এ নিয়ে স’রকারের ভেতরে যে অস্বস্তি নেই তা কিন্তু নয়। একাত্তরের মানবতাবি’রোধী অ’পরাধে পাকিস্তানি ঘা’তকদের সহযোগিতার দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার ও মৃ’ত্যুদ’ণ্ড প্রশ্নে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা একেবারে ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি তলব ও ব’হিষ্কারের ঘটনা চলেছে বহুদিন। উভ’য় পক্ষে কূটনীতিকদের ভিসা প্রদানও বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়েছিল যে, প্রায় দু’বছর ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারের পদটি শূন্য ছিল। অবস্থা যখন চ’রমে তখন নাটকীয়ভাবে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী হয় ইসলামাবাদ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক চেয়ে প্রস্তাব পাঠান। ঢাকায় খবর আসে স’রকার গঠনের পর থেকেই নাকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চেষ্টায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার জন্য। ঢাকায় নড়াচড়া শুরু হয়।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইডলাইনে ইমরান খান সুযোগটি গ্রহণ করেন। সেদিনের আলাপে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রশংসা করেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও। ওই সাক্ষাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় ফিরে তিনি তার একটি বর্ণনাও দেন। মূলত এক দশক পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান শীর্ষ নেতৃত্বের এটাই ছিল প্রথম বাক্য বিনিময়। স্মরণ করা যায়, ২০১০ সালে সর্বশেষ পাকিস্তানের সঙ্গে পররাষ্ট্র স’চিব পর্যায়ের বৈঠক এফওসি হয়েছিল। তারপর থেকে বাৎসরিক ওই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি ঝুলে আছে। মাঝখানে পাকিস্তানের বহুল আলোচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার ঢাকায় এসেছিলেন, ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-এইট সম্মেলনের দাওয়াত দিতে। কিন্তু ঢাকা থেকে কেউ পাকিস্তানে পা ফে’লেননি।

২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিউ ইয়র্কে ইমরান খানের সাক্ষাৎ পরবর্তী নানা ঘটনা ঘটেছে- যা বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। নাটকীয়ও বটে। নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার একদিনের মাথায় ইমরান খান ঢাকায় হাইকমিশনারের শূন্য পদে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ‘চৌকস অফিসার’ ইমরান আহমেদ সিদ্দিকীকে নিয়োগ দেন। মিস্টার সিদ্দিকী তখন টরোন্টোতে কন্সাল জেনারেল। রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় তার প্রথম পোস্টিং। কানাডায় যাওয়ার আগে তিনি দুই বছর পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের যুগ্ম স’চিব হিসেবে কাজ করেছেন। তাছাড়া জাতিসংঘ এবং ওআইসিতেও কাজ করেছেন। বলাবলি আছে মিস্টার সিদ্দিকী পাকিস্তানের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মহলটির বিশেষ আস্থাভাজন।

ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃ’দ্ধির বি’ষয়টিকে পাকিস্তানের জন্য সম্ভাবনাময় করে তুলতে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। নতুন দূত নিয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন ইমরান খান। ২রা অক্টোবর ২০১৯-এর ওই ফোনে তখন কূটনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় লেগে যায়। কারণ পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর। ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার ক’ঘণ্টা আগে ইমরান খানের ফোনটি বিশেষ ইঙ্গিতবাহী বলে সেদিন নড়েচড়ে ওঠেছিলেন বিশ্লেষকরা। সেই ফোনালাপে ইমরান খান আদতে কি বলেছেন? তা নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের নানা বিশ্লেষণ ছিল। অবশ্য ঢাকা আগেভাগেই জানায়- ফোনালাপটি ছিল স্রেফ ‘কুশল বিনিময়’। নিউ ইয়র্ক যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে চোখের চিকিৎসা নিয়েছিলেন।

ঢাকায় ফিরেও তিনি চোখ পরীক্ষা করান। ইমরান খান তার চিকিৎসার খোঁজখবর নিতেই ফোন করেছিলেন। সেই ফোনালাপ এবং নিয়োগের চার মাসের মাথায় ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন হাইকমিশনার মিস্টার সিদ্দিকী। তখন ফেব্রুয়ারি মাস। মার্চে ক’রোনা ঠে’কাতে ঢাকায় প্রায় লকডাউন অবস্থা। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা আ’টকা। হাইকমিশনার নিজের লোকদের নিরাপত্তা এবং ফেরত পাঠানো নিয়ে ব্যস্ত। অবশ্য ওই সময়ে পররাষ্ট্র ম’ন্ত্রণালয় বা স’রকারি অন্য দপ্তরে সাক্ষাৎকে নিরুৎসাহিত করা হতো। ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফরমেই ছিল সব যোগাযোগ। জুলাই মাসে পরিস্থিতি খানিকটা শিথিল হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অনেকটা নীরবে সাক্ষাৎ করতে যান পাকিস্তানি দূত।

সেখানে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের বি’ষয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। তার্কিশ নিউজ এজেন্সি আনাদুলু সাক্ষাৎটির খবর প্রকাশ করে দেয়ায় ঢাকায় শোরগোল পড়ে যায়। সেই শোরগোলে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় ওই মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইমরান খানের দ্বিতীয় দফায় ফোন করায়। ১০ মাস আগের ফোন আর জুলাই ২০২০-এর প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন চীন-ভারত উ’ত্তেজনা চ’রমে। লাদাখ সী’মান্তে প্রা’ণহা’নির ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ নীরব, শান্তির পক্ষে। ভারতের সব প্রতিবেশীকে নিজেদের বলয়ে টানার চেষ্টা করছে চীন। এটা তখন ওপেন সিক্রেট। এমন সময়ে ঢাকায় বার্তা আসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চান। ইসলামাবাদস্থ বাংলাদেশ মিশন তখনো অন্ধকারে।

ঢাকাস্থ পাকিস্তান মিশন সেগুনবাগিচার সঙ্গে যোগাযোগ করে ফোনালাপের সময়ক্ষণ চূড়ান্ত করে ফে’লে। চটজলদি ইসলামাবাদ মিশনকে খোঁজখবর নিয়ে রিপোর্ট পাঠাতে বলে সেগুনবাগিচা। কিন্তু মিশনের রিপোর্ট আসার আগেই ঢাকায় ফোন করে বসেন ইমরান খান। এবার আর রাখঢাক নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার সরাসরি প্রস্তাব করেন ইমরান খান। অতীতকে পেছনে ঠেলে নিয়মিত যোগাযোগে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের বরাতে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস ফোনালাপের খবরটি প্রকাশ করে। খবরে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে ইমরান খান বাংলাদেশের ক’রোনা আর বন্যা পরিস্থিতির খবর জানতে চেয়েছেন। ফোনালাপের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর বিবৃতি প্রচার করে।

তাতে আলাপের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। বলা হয়- বন্যা ও পরিস্থিতি নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর আলাপ ছাড়াও পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান এবং সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক গভীর করতে আগ্রহ দেখিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এ জন্য নিয়মিত দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ এবং দুই দেশের মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের গুরুত্বের বি’ষয়টিও তিনি তুলে ধরেন। সার্কের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থনের কথা জানিয়ে ইমরান খান বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যৌথভাবে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃ’দ্ধির মাধ্যমে টেকসই শান্তি ও উন্নয়নে কাজ করতে পারে। ফোনালাপে ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থা বি’ষয়ে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেন ইমরান খান।

একই সঙ্গে তিনি শেখ হাসিনাকে পাকিস্তান সফরেরও আমন্ত্রণ জানান। ফোনালাপ প্রশ্নে ঢাকা ও ইসলামাবাদের বক্তব্য স্পষ্ট হওয়ার পর পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন ছিল মুক্তিযু’দ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবি’রোধী অ’পরাধের বিচারের বি’রুদ্ধে পাকিস্তানের প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে জটিল অবস্থায় পৌঁছেছে পাকিস্তানের স’রকার প্রধান তা ‘সহজ’ করতে চাইছেন। এ ফোনের নেপথ্যে যে পাকিস্তানের বরাবরের বন্ধু চীন রয়েছে- সেটাও বলছিলেন বিশ্লেষকরা। ১২ মাসে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ৩ দফা সংলাপে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বরফ এতটাই গলেছে যে, ডিসেম্বর মাসেও পাকিস্তান দূত স’রকার প্রধানের দেখা পেয়েছেন।

কূটনৈতিক অঙ্গনে এমন গুঞ্জন আছে ৩রা ডিসেম্বর গণভবনে পাকিস্তানের হাইকমিশনার নাকি রীতিমতো অনুযোগ করে এসেছেন। মন্ত্রী-এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের দেখা না পাওয়ার বি’ষয়ে তিনি স’রকার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার নালিশ যে বৃথা যায়নি তার প্রমাণ নতুন বছরের সূচনাতেই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎ। ওই সাক্ষাতে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম স্পষ্ট করেই বলেন, সম্পর্ক বাড়াতে চাইলে পাকিস্তানকে আগে ক্ষমা চাইতে হবে। একই সঙ্গে অমীমাংসিত সব ইস্যুর নিষ্পত্তি করতে হবে। জবাবে পাকিস্তান দূত ’৭৪ সালে সম্পাদিত বহুল আলোচিত ত্রিদেশীয় চুক্তির একটি কপি হস্তান্তর করে জানান, তারা এরইমধ্যে বাণিজ্য বা’ধা নিরসন এবং বাংলাদেশিদের জন্য পাকিস্তানকে উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্য সব ধরনের ভিসা জটিলতা দূর করেছেন।

নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া প্রশ্নে বাংলাদেশের ক’ঠোর মনোভাবের বিপরীতে পাকিস্তানের ‘সব কিছু সহজ করার’ ঘোষণাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে কূটনৈতিক অঙ্গনে চাউর হয়েছে- স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর উজ্জ্বল মুহূর্তে অর্ধশত বছর বয়সী বাংলাদেশকে নিয়ে পাকিস্তানের পরিবর্তিত নেতৃত্ব এবং দেশটির নতুন প্রজন্মের যে উপলব্ধি তার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ নাকি আগামী ২৬শে মার্চের আগেই ঘটতে যাচ্ছে! ৭১ প্রশ্নে পাকিস্তানের উপলদ্ধি প্রসঙ্গে ঢাকার কর্তারা আগাম কোনো মন্তব্য করার ঝুঁ’কি নিতে চাননি। তারা মাথা নেড়ে, শা’রীরিক ভাষায় এটা বুঝিয়েছেন যে, কিছু একটা আছে। তবে তা এখনো ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’র ব্র্যাকে’টে ব’ন্দি। সূত্রঃ মানবজমিন