রাত বা’ড়লেই রজাধানীতে বসে নি’শি রা’নীদের ‘হা’ট’

| আপডেট :  ১৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৫:২৩ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

অনলাইন ডেস্কঃ রাত বাড়তেই বাতাসে ভেসে আসে সস্তা প্রসাধনীর ঘ্রাণ। মুখে উটকো মেকআপ। চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক। বাহারি পোশাকে তারা দাঁড়িয়ে থাকেন খদ্দেরের অপেক্ষায়। সংকেত মিলে চোখের ইশারায়। কাছে ভিড়লেই বিড়বিড় করে কথা বলে ঠিক হয় দরদাম। তারপর গো’পন আস্তানায় নিশি রানীরা খদ্দেরের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবেই পুরো রাত একের পর এক খদ্দেরের সঙ্গে সময় কাটে নিশি রানীদের।

ঢাকার ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজে নিশি রানীদের আনাগোনা পথচারীদের প্রায়ই চোখে পড়ে। অনেকের মতে এই ব্রিজে রাতের বেলা নারীর হাট বসে। রাত চুক্তিতে কেনা-বেচা হন নিশি রানীরা। আশেপাশের কয়েকটি হোটেলকে ঘিরেই এমন কার্যকলাপ হচ্ছে। এ নিয়ে বিব্রত স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীরা। পরিবার-পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে এই ব্রিজ দিয়ে এখন অনেকেই যেতে চান না। আর এই ব্রিজ ছাড়া ব্যস্ততম এই এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার উপায় নাই। এ ছাড়া এই ব্রিজ ও অ’বৈধ এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে নানা অ’পরাধ হচ্ছে। মা’দক ব্যবসা থেকে ছি’নতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন আগে এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একটি হ’’ত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ জানিয়েছে, বারবার অ’ভিযান চা’লিয়ে অনেক নিশি রানীদের গ্রে’প্তার করে জে’লে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা জা’মিনে বের হয়ে ফের এই কাজ শুরু করে।

প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকার প্রা’ণকেন্দ্র ফার্মগেটের ত্রিমুখী ওভারব্রিজে আনাগোনা বাড়ে নিশি রানীদের। রাত ১০টার পর থেকে ব্রিজের হকাররা দোকান গোছাতে থাকেন। রাত গভীর হলে পথচারীদের আনাগোনা কমলেও বাড়তে থাকে নিশি রানী এবং খদ্দেরদের ভিড়। গত রোববার রাতে সরজমিন দেখা গেছে, ত্রিমুখী এই ব্রিজে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অন্তত অর্ধশত নিশি রানী বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। পথচারীরা পাশ দিয়ে গেলেই চোখ দিয়ে ইশারা দিচ্ছেন। আবার অনেক সময় পথচারীদের কাছে গিয়ে বলছেন ‘যাবেন ভাই, ভালো জায়গা আছে, কোনো স’মস্যা হবে না’।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ধ্যার পরে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আসা নিশি রানীদের হাট জমে, ওই ব্রিজ ও আনন্দ-ছন্দ সিনেমা হলের পাশে। দালালের মাধ্যমেই তারা এখানে আসেন। এখানে আসার পর আবার তাদের রাত চুক্তিতে বিক্রি করে দেয়া হয় ছোট দালালদের কাছে। রাতভর খদ্দেরের মনোরঞ্জন করে যা আয় হয় তার একটি অংশ পায় নিশি রানীরা। মনোরঞ্জনের জন্য ফার্মগেটের কয়েকটি হোটেলের সঙ্গে চুক্তি করা থাকে। প্রতি ঘণ্টায় হোটেলের সিট ভাড়া দিতে হয় ৫০০ টাকা। আবার চাইলে বেশি টাকা দিয়ে বাসা বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া যায়। যদিও হোটেলেই বেশি আগ্রহ দেখান নিশি রানীরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে থেকে আগত নিশি রানীরা সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করে যা আয় হয় সেটি নিয়েই বাসায় ফিরেন। আর ঢাকার নিশি রানীরা রাতভর কাজ করেন। তবে ঢাকার নিশি রানীদের মধ্যে দুটি গ্রুপ। একটি গ্রুপ খদ্দেরের মনোরঞ্জন করে অর্থ উপার্জন করেন। আর অন্য গ্রুপ ব্ল্যা’কমেইলিং করে টাকা কামান। ব্ল্যা’কমেইলিংয়ের পন্থা হিসেবে তারা খদ্দেরের সঙ্গে অন্য নিশি রানীদের মতোই ঘণ্টা বা রাত চুক্তি করেন। পরে হোটেলে বা বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তারা রাস্তায় ব্ল্যা’কমেইল করেন। সিএনজি অথবা রিকশায় যাওয়ার পথে নিশি রানীদের সহযোগীরা তাদেরকে ঘিরে ধরে ছি’নিয়ে নেন টাকা, মোবাইলসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী। ভু’ক্তভোগীরা লোক-লজ্জার ভ’য়ে কিছু বলতে পারেন না।

নিশি রানী কবিতা ও প্রিয়া। কবিতা এসেছেন গাজীপুর থেকে আর প্রিয়া সাভার থেকে। দু’জনের দাবি, কোনো দালাল নয় তারা নিজেরাই এসেছেন। বিকাল বেলা আসেন, রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করে বাসায় চলে যান। কবিতা বলেন, স্বামী জানে ঢাকার একটি হাসপাতালে কাজ করি। তাই প্রতিদিন দুপুরের পর বাসা থেকে বের হয়ে যাই। স্বাভাবিক পোশাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে বসে মেকাপ করি। তারপর ব্রিজে খদ্দেরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। একটি হোটেলের সঙ্গে চুক্তি করা আছে।

এখানকার অন্য নারীরা রাতভর ছেলেদের সঙ্গে ব্ল্যা’কমেইল করে টাকা আদায় করে। হোটেলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সিএনজিতে তুলে সবকিছু নিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেয়। তাদের সহযোগীরাই সিএনজি চা’লায়। যা আয় হয় সেটি তারা ভাগভাটোয়ারা করে নেয়। এই নারীদের বয়সও বেশি। তাদেরকে কেউ পছন্দ করে না। বয়স আড়াল করতে বোরকা পরে থাকে। তাই বিকল্প পদ্ধতিতে তারা টাকা আয় করে। কবিতা বলেন, স্বামী নাই। ঘরে ছেলেটারে রেখে আসছি। দুপুরে খাওয়াতে পারি নাই। রাতে চাল ও অন্যান্য বাজার করে নিয়ে ছেলেটারে খাওয়াতে হবে। এখনো একটা কাজ করতে পারলাম না। চাল কিনমু কি দিয়ে? কা’ন্নাকাটি করে কবিতার নানা আকুতি মিনতি। হোটেলে গেলে নানা স’মস্যা হয় বলতে কবিতা বলেন, এখানে কোনো স’মস্যা হবে না। একটিবার তাকে বিশ্বাস করার জন্য। একবার বিশ্বাস করলে পরেরবার তাকে খুঁজে বের করতে হবে। মুখের মাস্ক খুলে চেহারা দেখিয়ে বলেন, আপনি বি’পদে পড়লে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েন।

খদ্দের সেজে গত রোববার রাতে ব্রিজের ও’পর দাঁড়াতেই নিশি রানী ইয়াসমিন চোখের ইশারা দিয়ে কাছে এসে বলেন, কাজ-কাম নাই, যাবেন?
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে কেন এই পথে এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, ছোট্টকালে আছিলাম বাপ মায়ের সঙ্গে। হঠাৎ বাপ মা’রা যায়। বাড়ি আমাগো বরিশাল। মায়ে বিয়া করে আরেকটা। সৎ বাপ বেইচ্যা দেয়। তিনদিন চোখ বান্ধা থাকার পর দেখি দৌলতদিয়া পল্লীতে। তখন বয়স হইবো ১৪ কি ১৫। পরে শুনছি বাপে আমারে ২০ হাজার টাকায় বেইচ্যা দিচে। সেই হানেই কা’টাইছি ২০-২২ বছর। এরপর বয়স হইল। কামের লোক পাই না। চইলা আইলাম ঢাকায়। এখন রায়ের বাজার বস্তিতে থাকি আর টুকটাক কাম করি।

আমার দুইডা বাচ্চা হইছিলো। দুডাই পোলা। বড় পোলাডার মুখটাও দেখি নাই। ছোট পোলাডা আমার লগে তিন মাস আছিল। হেরেও বেইচা দিছে দালালরা। ভালোই হইছে বেইচা দিয়া। আমার লগে থাকলে হেও চোর ছি’নতাইকারী হইত। হুনছি ভালো ফ্যামিলিতে বেইচা দিছে। কথা আর না বাড়িয়ে ইয়াসমিন বলেন, পেটের দায়ে আইছি ভাই। মজা নিতে না।

নিশি রানী রেশমি আক্তার কাছে এসে বলেন, ভাই কাজ পাই না। আমারে যদি নিয়া যাইতেন। বাড়িতে দুইটা বাচ্চা। আমার স্বামী থাকে কাতারে, কোনো খোঁজখবর নেয় না। খুব টাকার দরকার। ব্ল্যা’কমেইলিংয়ের শি’কার হওয়া সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি শিল্পী নামের এক নারীর সঙ্গে দেড় হাজার টাকা চুক্তি করেছিলাম। আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সিএনজিতে তুলে। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ করে চালক সিএনজি থামিয়ে দেয়। তখন গাড়িতে থাকা শিল্পী আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে যা আছে সবকিছু দিতে হবে। আর চি’ৎকার করলে উল্টো ফাঁ’সিয়ে দেয়ার হু’মকি। কথা বলতে না বলতে আরো দুইজন ব্যক্তি এসে বলে সময় ন’ষ্ট করিস না। যা আছে সব দিয়ে দে। আমরা সবাই এক। তারপর উপায়ান্তর না পেয়ে তাদেরকে সবকিছু দিয়ে দেই। পরে তারা আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদ খান মানবজমিনকে বলেন, কিছুদিন ধরে এদের উৎপাত বেড়েছে। একটি হ’’ত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আমরা নিয়মিত অ’ভিযান চালাই। ধরে এনে চালান করে দেই। কিন্তু তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জা’মিনে বের হয়ে ফের একই কাজ করে। আমাদের অ’ভিযান অব্যাহত আছে, থাকবে। তবে তাদেরকে নিয়ে কাউন্সিলের প্রয়োজন আছে। না হলে শুধু আইনি পদক্ষেপ নিয়ে তাদেরকে এ পথ থেকে ফেরানো যাবে না। আমরা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তারা বলে এই কাজ ছাড়া তারা আর কিছু পারে না। সূত্রঃ মানবজমিন