সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এমপিরা পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না: ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই

| আপডেট :  ৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৪:২৮ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৪:২৮ অপরাহ্ণ

‘বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু চামচা নেতা আছেন, যাঁরা বলেন অমুক নেতা তমুক নেতার নেতৃত্বে বিএনপির দুর্গ ভে’ঙেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটা আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা দরজা খুঁজে পাবে না পালানোর জন্য। এটাই হলো সত্য কথা। সত্য কথা বলতে হবে। আমি সাহস করে সত্য কথা বলছি।’

কথাগুলো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার। তাঁর সাম্প্রতিক এ বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় দলীয় কিছু নেতাকে ইঙ্গিত করে আবদুল কাদের মির্জাকে বলতে শোনা যায়, ‘নোয়াখালীর মানুষজন বলে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

এটা সত্য। কিন্তু আপনাদের জনপ্রিয়তা বাড়েনি। আপনারা প্রতিদিন ভোট কমান। টাকা দিয়ে বড় জনসভা করা, মিছিল করা কোনো ব্যাপার নয়। টাকা দিলে, গাড়ি দিলে আমিও অনেক লোক জড়ো করতে পারব। না হয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেব।’

আগামী ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে আবদুল কাদের মির্জা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজে’লার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। এ উপলক্ষে ৩১ ডিসেম্বর সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরভবন চত্বরে ইশতেহার ঘোষণাকালে ওই বক্তব্য দেন তিনি। তিনি নোয়াখালী জে’লা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সহসভাপতি। এ নিয়ে টানা তৃতীয়বার বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেন।

আবদুল কাদের মির্জা তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘নোয়াখালীর রাজনীতি অতি ক’ষ্টের। এই বৃহত্তর নোয়াখালীতে আমাদের নেতা ওবায়দুল কাদের, মওদুদ সাহেব (বিএনপির মওদুদ আহম’দ), আবু নাছের সাহেব (জামায়াতের)—এই তিনজন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের সমমর্যাদার কেউ নেই। কোনো নেতা সৃষ্টি হয়নি। এখন তো ওবায়দুল কাদের, মওদুদ আহম’দের নাম বিক্রি করি। তাঁরা তিনজন তো অ’সুস্থ, তাঁরা মা’রা গেলে কার নাম বিক্রি করবে, কেউ নাই।’

কারও নাম উল্লেখ না করে আবদুল কাদের বলেন, ‘প্রকাশ্যে দিবালোকে পু’ড়িয়ে মানুষ হ’’ত্যা করেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। টে’ন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা লু’টপাট যাঁরা করেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। পুলিশের, প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি দিয়ে যাঁরা পাঁচ লাখ টাকা নেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। গরিব পিয়নের চাকরি দিয়ে তিন লাখ টাকা যাঁরা নেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা।’

জে’লা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সমালোচনা করে আবদুল কাদের বলেন, ‘সাবেক সে’নাপ্রধান মঈন উ আহম’দের ছোট ভাই জাবেদ (মিনহাজ আহমেদ জাবেদ)। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো কোনো নেতা তখন (এক-এগারোর সময়কালে) নিজেদের রক্ষা করেছেন। এখন সেই জাবেদ এবং হাওয়া ভবনের মানিক (আতাউর রহমান ভূঁইয়া ওরফে মানিক) আজ জে’লা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। অথচ কোম্পানীগঞ্জ উপজে’লা পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিনের মতো ত্যাগী ও নি’র্যাতিত ব্যক্তিকে করা হয়েছে উপদেষ্টা। এটা হলো আমাদের কমিটি।’
আবদুল কাদের মির্জা বলেন, দলের প্রয়াত সাবেক তিন নেতা আবদুল মালেক উকিল, শহীদ উদ্দিন এস্কেন্দার ও নুরুল হক সাহেবের নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগে অপরাজনীতি চলছে। এই অপরাজনীতি চলতে পারে না। তাই তিনি সবাইকে অপরাজনীতির বি’রুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

বৃহস্পতিবারের ওই বক্তব্যের পর গতকাল রোববার সকালে উপজে’লা পরিষদের সভাকক্ষে নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালন বি’ষয়ে মতবিনিময় সভায় আবদুল কাদের যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিও এখন ভাইরাল। গতকাল তিনি বলেন, ‘দুঃ’খজনক হলেও সত্য, গত উপজে’লা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সহধর্মিণীর (ইশরাতুন্নেসা কাদের) সঙ্গে চ’রম দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকজন নেতা ষ’ড়যন্ত্র করে আমার এখানে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য অ’স্ত্র পাঠিয়েছেন।’ বক্তব্যের এই পর্যায়ে জে’লা প্রশাসক ‘আর কিছু বলবেন কি না’ জানতে চাইতেই আবদুল কাদের ডিসির বি’রুদ্ধে বক্তব্যে বা’ধা দেওয়ার অ’ভিযোগ তুলে সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। এরপর যথারীতি সভাটি চলে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সভা থেকে বেরিয়ে আবদুল কাদের মির্জা পৌরসভা কার্যালয়ে গিয়ে দলীয় নেতাদের বি’রুদ্ধে বিভিন্ন অ’ভিযোগ তুলে চি’ৎকার-চেঁচামেচি করেন। একপর্যায়ে তিনি অ’সুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বেলা ১১টার দিকে তিনি শহরের জিরো পয়েন্টে বঙ্গবন্ধু চত্বরে অবস্থান নেন। ততক্ষণে সেখানে হাজির হন কয়েক হাজার দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে টায়ার জ্বা’লিয়ে হাতে ঝাড়ু নিয়ে বি’ক্ষো’ভ প্রদর্শন করেন সমর্থকেরা। বি’ক্ষো’ভকারীরা ডিসি, এসপির অপসারণ দাবি করে তাঁদের বি’রুদ্ধে নানা অশালীন স্লোগান দেন।

এরপর দুপুরে জিরো পয়েন্টে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মী ও দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আবদুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, কিন্তু ভোটের অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। দু’র্নীতি, টে’ন্ডারবাজি বন্ধ হয়নি। তাই ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর অবস্থান কর্মসূচিতে অনড় থাকবেন। তাঁর পাশে কেউ না থাকলে প্রয়োজনে তিনি একা লড়ে যাবেন বলেও উল্লেখ করেন।

সূত্র জানায়, বিকেল পাঁচটার দিকে জে’লা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী বসুরহাটে যান। তিনি আবদুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করাসহ জে’লা আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে উত্থাপিত অ’ভিযোগগুলো নিয়ে পৌর নির্বাচনের পর বসার আশ্বাস দিলে অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন আবদুল কাদের। এরপর জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী দলীয় নেতা-কর্মীরা সরে যান এবং যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।

কী প্রেক্ষাপটে আবদুল কাদের মির্জার সাম্প্রতিক এই বক্তব্য, এই প্রশ্নের জবাবে কোম্পানীগঞ্জ উপজে’লা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযো’দ্ধা খিজির হায়াত খান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন আগে আবদুল কাদের মির্জা চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি শপথ করেছেন, দেশে ফিরে সত্য কথা বলবেন। অন্যায়ের প্র’তিবাদ করবেন। সে শপথের অংশ হিসেবেই তিনি এসব বলছেন। আবদুল কাদের মির্জার এই বক্তব্যের প্রতি তাঁরা সবাই একমত রয়েছেন।

একই বি’ষয়ে জানতে চাইলে জে’লা আওয়ামী লীগে সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল কাদের মির্জা যেসব কথা বলছেন, অ’ভিযোগ করেছেন, তার কোনোটিই মি’থ্যা নয়। এসব বি’ষয় নিয়ে শিগগিরই দলীয় ফোরামে আলোচনা হবে। আবদুল কাদের মির্জা দলের জন্য অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন এই বর্ষীয়ান নেতা।