দুই হাত হারিয়েও জীবনযুদ্ধে পরাজিত হননি কামরুল

| আপডেট :  ৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:০০ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রায় আড়াই বছর আগে বিদ্যুতের লাইন ঠিক করতে গিয়ে দুই হাত হারিয়েছেন কামরুল (৩৪)। সে-যাত্রায় জীবন নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে ফেরেন তিনি। এরপরও তিনি জীবনযুদ্ধে পরাজিত হননি। দুই হাত নেই তাতে কী, দুই পা দিয়েই সব কাজ করতে শিখে নিয়েছেন তিনি। পা দিয়ে কাজ করেই নিজের জীবিকা তো বটেই, চালিয়ে নিচ্ছেন পরিবারের ভরণপোষণও। কামরুল এখন অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সব বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়ার রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন।

ফরিদপুর সদরের সম্প্রসারিত পৌরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে কাফুরা এলাকায় একটি মুদিদোকান চালাচ্ছেন কামরুল। ওই এলাকার কুমার নদের পূর্ব পাশে কাফুরা-বাখুন্ডা সড়কের পাশেই এই দোকান। মুদিদোকান হলেও সেখানে ফ্লেক্সিলোড, বিকাশ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কাজও করে থাকেন কামরুল। ওই দোকানে বিকিকিনি থেকে হিসাব রাখা—সব কাজই কামরুল করেন দুই পা দিয়ে। গেল সপ্তাহে সরেজমিনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

আসুন, জানা যাক হার না মানা কামরুলের জীবনের গল্প। কাফুরা মহল্লার শেখ আইউব আলী ও আমেনা বেগমের ছেলে কামরুল। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। তাঁর স্ত্রী জুলিয়া বেগম (২৩) গৃহিণী। কামরুল-জুলিয়া দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। শৈশবে সংসারে অভাবের কারণে পড়াশোনা বেশি দূর করতে পারেননি কামরুল। পঞ্চম শ্রেণিতে পাস করার পরই তাঁকে নেমে পড়তে হয় জীবনসংগ্রামে। প্রথমে কাঠমিস্ত্রির কাজ দিয়ে শুরু, পরে রিকশা চালানো ও মাটি কাটার কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। পরে নিজ দক্ষতায় শিখে নিয়েছেন ইলেকট্রিকের কাজ।

২০১৪ সাল থেকে বিদ্যুৎ লাইনের শ্রমিক হিসেবে পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) ফরিদপুরের অধীনে বাখুন্ডা ফিডারের অধীনে কাজ শুরু করেন কামরুল। সেখানে কর্মরত অবস্থাতেই ২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় দুটি হাত হারাতে হয় তাঁকে।

ওই দিন সকাল থেকে কামরুল বিদ্যুৎ বিল বিলি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সেদিন এলাকায় বিদ্যুৎ–বিভ্রাট দেখা দিলে দুপুর ১২টার দিকে ফিডার ইনচার্জ আব্দুল্লাহ তাঁকে ফোন করে ওই এলাকায় বিদ্যুতের লাইনে ত্রুটি খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেন। ত্রুটি ধরা পড়ে খালেক বাজার এলাকায় আলাউদ্দীনের ইটভাটার সামনে। ত্রুটি বের করার পর ইনচার্জকে লাইনের বিদ্যুৎ–সংযোগ বন্ধ করতে বলেন কামরুল। তিন দফা এ কথা বলার পর অফিস থেকে বলা হয়, বিদ্যুৎ–সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনি বিদ্যুতের তারে মই লাগিয়ে কাজ শুরু করেন।

সেদিনের বর্ণনা দিয়ে কামরুল বলেন, ‘মই লাগিয়ে উঠে তারে দুই হাত দিয়ে ত্রুটি মেরামতের কাজ শুরু করি। এতটুকুই আমার মনে আছে। তারপর কী ঘটেছে, বলতে পারব না। জ্ঞান ফেরার পরে দেখি, আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। পাশে বসা মা।’

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঝলসে যায় কামরুলের দুটি হাত। তাঁকে প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখান থেকে ঢাকায় নিতে বলা হয়। ওজোপাডিকো ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন মো. মোরশিদ আলম। তিনিই সব ব্যবস্থা করেন।

১ মাস ১৪ দিন কামরুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ডান হাত এবং ১০ দিনের মধ্যে বাম হাত কেটে ফেলা হয়।

কামরুল বলেন, ‘সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আমি দুই চোখে অন্ধকার দেখতে পাই। মনে মনে ভেবেছি, আমার মৃত্যু হলো না কেন, সেটাই তো বেশি ভালো হতো। কীভাবে পরিবার চালাব, কীভাবে খরচ আসবে ভেবে ভেবে আমি চরম হতাশার মধ্যে পড়ে যাই। অনেকে আমাকে নিয়ে তামাশা করত। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ আমার হাসপাতালের সব খরচ বহন করে এবং নগদ দুই লাখ টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়ে চারটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে ভাড়া দিতে শুরু করি।’

এর মধ্যে কামরুলের পরিচয় হয় চরভদ্রাসন উপজেলার হাজীগঞ্জ বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী লুৎফর খালাসির সঙ্গে। তিনি কামরুলকে সাহস জোগান। তিনি তাঁকে বলেন, হাজীগঞ্জ বাজারে মো. জসীম (২২) নামে এক ব্যবসায়ী আছেন, তাঁরও দুই হাত নেই। তারপরও তিনি দুই পা দিয়ে দোকান চালান। শুধু তা–ই নয়, জসীম নদীতে সাঁতার কাটতে পারেন, বাইসাইকেলও চালাতে পারেন।

লুৎফরের কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে কামরুল জসীমের সঙ্গে দেখা করার জন্য হাজীগঞ্জ যান। জসীমের কাছে গিয়ে তিনি কীভাবে দুই পা দিয়ে সব কাজ করেন, দোকানে বেচাকেনা করেন, তা দেখে আসেন। এরপর থেকে কামরুলের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তিনি বাড়িতে এসে রিকশা বিক্রি করে নিজের বাড়ির সামনের সড়কে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ছেলে জিহাদের নামে ‘জিহাদ ভ্যারাইটি স্টোর’ নামে একটি মুদিদোকান দেন। এরপর দুই পা দিয়ে সব কাজ করতে শিখে যান কামরুল। এখন পা দিয়ে কাজ করতে কোনো সমস্যা হয় না তাঁর। তিনি এখন সাঁতারও কাটতে পারেন, চালাতে পারেন বাইসাইকেলও।

কামরুল বলেন, সব মিলিয়ে এখন তিনি সুখী। দোকানের কাজে তাঁর স্ত্রী জুলিয়া এবং শাকিল (১৮) নামের প্রতিবেশী এক তরুণ তাঁকে সাহায্য করেন।
কামরুলের স্ত্রী জুলিয়া বলেন, স্বামীর দুই হাত কেটে ফেলার পর চরম দুঃখ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছিলেন। ভয় হয়েছিল কীভাবে বেঁচে থাকবেন, আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে ভেবে। আজ তাঁরা সুখী।

শাকিল বলেন, ‘বাড়িতে সারা দিন বেকার বসে থাকি। অলস সময় পার না করে কামরুল ভাইকে একটু সাহায্য করি। কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে ভালো লাগে।’
ওজোপাডিকো ফরিদপুরের বিদ্যুৎ ও বিতরণ বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোরশিদ আলম বলেন, অসাধারণ মানসিক শক্তির অধিকারী কামরুল। এ শক্তির জোরেই তিনি জীবনের চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি তিনি মেধাবীও। তাঁর পাশে সব সময় থাকবে বিদ্যুৎ বিভাগ।