৩০ হাজার টাকায় ব্যবসা শুরু, এখন রপ্তানিই ২৮ কোটি টাকা

| আপডেট :  ২৪ মে ২০২২, ০৭:১৪ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৪ মে ২০২২, ০৭:১৪ অপরাহ্ণ

১৯৯৩ সাল। উচ্চমাধ্যমিকে পাস করার পর চট্টগ্রাম কলেজে রসায়ন বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হলেন ছৈয়দ মুহাম্মদ শোয়াইব হাছান। পাশাপাশি পাথরঘাটায় নিজের বাড়ির ছাদে ৫০০ মুরগি নিয়ে শুরু করলেন পোলট্রি ফার্ম। পুঁজি ৩০ হাজার টাকা। তাতেও মুনাফা ভালোই হচ্ছিল। মুরগির খামারটি বড় করতে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়ে একজনকে অংশীদারও করলেন। তাতে ফল হলো উল্টো। কয়েক দিন বাদেই সেই অংশীদার ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দিলেন চম্পট। তখন ৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে আরেকজন অংশীদার নিয়ে খামারের মুরগির সংখ্যা ১ হাজারে উন্নীত করলেন।

মুরগির খামারের পাশাপাশি বাড়ির ছাদে চাষ করা ঝাউপাতা ও চারাগাছ বিক্রি করতেন শোয়াইব। পরে শুরু করলেন অ্যাকুয়ারিয়ামে ফিশ ব্রিডিং। সকালে বাসায় ছাত্রছাত্রীও পড়াতেন। সব মিলিয়ে মাসে তখন ৫০ হাজার টাকা আয়। বাবার হোটেলেই খাওয়াদাওয়া। তাই খরচ কম, সঞ্চয় বেশি। বছর তিনেকের মধ্যে ৫-৬ লাখ টাকা জমল। হঠাৎ মাথায় কী যেন ভূত চাপল, ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে হাতে থাকা সব টাকাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলেন। সময়টা ১৯৯৬ সাল। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই শেয়ারবাজারে বড় ধস দেখা দেয়। ফলে মুনাফা তো দূরের কথা, পুঁজির সিংহভাগই হারিয়ে বসলেন। রাগে–দুঃখে শেয়ারের সব কাগজ ছিঁড়ে ফেললেন শোয়াইব হাছান। প্রতিজ্ঞা করলেন, আর ওমুখো হবেন না।

শেয়ারবাজারে সর্বস্ব খোয়ালেও হাল ছাড়েননি ছৈয়দ মুহাম্মদ শোয়াইব হাছান। নতুন উদ্যমে নতুন ব্যবসায় নামেন। বড় চাচার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে পুরান ঢাকার নারিন্দা থেকে নুডলস উৎপাদনের মেশিন কিনে নিজের বাড়িতে বসালেন। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। ১৯৯৮ সালে এভাবেই ‘হিফস অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ’–এর নবযাত্রা শুরু হলো। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। শোয়াইবের বাবার নারকেল তেলের ব্যবসা ছিল। সেটির কারখানাও ছিল নিজেদের বাড়িতে। বাবার প্রতিষ্ঠান হিফসের নামেই নিজের নতুন ব্যবসা খোলেন চট্টগ্রামের এই তরুণ উদ্যোক্তা।

শুরুতে শোয়াইব দেশের বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বিক্রি করে নিজের ব্যবসার ভিত্তি শক্ত করলেন। তারপর নজর দিলেন বিদেশের বাজারে। বর্তমানে ১৮টি দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয় ও মসলা রপ্তানি করেন। গত বছর হিফস অ্যাগ্রোর রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২৮ কোটি টাকার সমান। বর্তমানে চট্টগ্রামের পাথরঘাটা ও চাক্তাই এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁর তিনটি কারখানায় কাজ করেন ৫০০-৫৫০ শ্রমিক (স্থায়ী ও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে)।

চট্টগ্রামের সফল এই উদ্যোক্তা বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা (পুরুষ) ক্যাটাগরিতে ‘জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার ২০২১’ পেয়েছেন। আজকের অবস্থানে আসার গল্প জানতে গত মঙ্গলবার শেষ বিকেলে মুঠোফোনে দীর্ঘ আলাপ হলো হিফস অ্যাগ্রোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছৈয়দ মুহাম্মদ শোয়াইব হাছানের সঙ্গে।

শোয়াইব বললেন, ‘নুডলস উৎপাদনের জন্য নিজের বাসার ৬০০ বর্গফুট জায়গায় কারখানা স্থাপন করলাম। প্রথম দিকে আমি আর আমার ভাই শামায়েল হাসান ও তিনজন শ্রমিক উৎপাদনের কাজ করতাম। বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধিরা আমাদের পণ্য বিক্রিতে সহায়তা করতেন। কিছুদিন পর এক ব্যবসায়ী লাচ্ছা সেমাই তৈরির পরামর্শ দিলেন। সে অনুযায়ী ছাদের ওপর যেখানে মুরগির খামার করেছিলাম সেখানে লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন শুরু করলাম। তখন বাজারে যেসব প্রতিষ্ঠানের লাচ্ছা সেমাই ছিল সেগুলো তৈলাক্ত ধরনের ছিল। সেটি দূর করতে আমরা লাচ্ছা সেমাই ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিতাম। তাতে বেশ সাড়া পেলাম। প্রথম বছর রোজার মাসে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হলো। সব খরচ বাদ দিয়ে মুনাফা হলো ৫০ হাজার টাকা।’

রমজান মাসের পর লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা কমে যায়। তখন কারখানাটি বন্ধ না রেখে চানাচুর তৈরি শুরু করলেন শোয়াইব। শুরুতে পিপি ব্যাগে চানাচুর ভরে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে শুরু করলেন। তবে বড় কোম্পানির পণ্যের ভিড়ে সাড়া পাচ্ছিলেন না। পরে প্লাস্টিকের জারে ভরে চানাচুর ব্র্যান্ডিং করলেন। সেটি বাজারে দ্রুত জনপ্রিয় হলো। এভাবেই ধীরে ধীরে পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে লাগলেন শোয়াইব।

মাঝে কিছুদিন ব্যবসার পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের খুঁটিনাটি জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষক এম এ মালেকের প্রতিষ্ঠানে কাজ নিলেন শোয়াইব। মাসে বেতন ৩০ হাজার টাকা। এম এ মালেকের কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে এসে নিজের কারখানায় উৎপাদন করতেন। প্রতি শুক্রবার ঢাকায় এসে তাঁকে রিপোর্ট দিতেন। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় ২০০৪-০৫ সালে শোয়াইব লন্ডনে প্রথমবারের মতো কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতে শুরু করেন। বাজারে চাহিদা থাকায় তখন তিনি চীন থেকে লিচির জেলি তৈরির মেশিন আনেন।

দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লিচি ড্রিংকস সরবরাহের আদেশ পেয়ে ২০০৮ সালে ২০-২২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন শোয়াইব। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো ক্রয়াদেশ পান। তিনি যে পণ্য উৎপাদন করে সরবরাহ করতেন, তা ভারতে রপ্তানি হতো। তারপর প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ক্রয়াদেশ দিচ্ছি দেব বলে ঘোরাচ্ছিলেন। এভাবে ছয় মাস কেটে যায়। তখন সেই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তার পরামর্শে শোয়াইব নিজেই যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। ভারতের বিভিন্ন শহর ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে করিমগঞ্জ পর্যন্ত যান। সেখানে কয়েকজন ক্রেতা খুঁজে পান। তারপর নিজেই ভারতে রপ্তানি শুরু করেন।

বর্তমানে শোয়াইবের তিন কারখানায় পাঁচটি ভিন্ন আকারের জেলি, লিচি ড্রিংকস, আইসপপ, নুডলস, পাস্তা, চানাচুর, ঝালমুড়ি, চিপস, মসলাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন হয়। এখন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে পৈতৃক জমিতে নতুন কারখানা করছেন। পাথরঘাটার কারখানাটি সেখানে স্থানান্তর করা হবে। বর্তমানে তাঁর তিনটি কারখানার দুটি ভাড়া জায়গায়। কারণ অনেক চেষ্টা করেও বিসিক ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা করার জন্য জায়গা পাননি।

বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানির পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। শোয়াইব বলেন, ‘প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি এক হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা এখনো বৈশ্বিক চাহিদাসম্পন্ন খাবার তেমন একটা তৈরি করতে পারিনি। আমরা মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য দেশীয় খাবার রপ্তানি করি। কিন্তু বিভিন্ন দেশের মানুষের জন্যও খাবার রপ্তানির বড় সুযোগ রয়েছে। সেই বাজারই বড়। তা ছাড়া চীন থেকে বর্তমানে এক কনটেইনার পণ্য মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাতে ৮ হাজার ডলার লাগছে। আমাদের দেশ থেকে সেটির পরিমাণ ৩ হাজার ডলার। সব মিলিয়ে সম্ভাবনা আছে।’

শোয়াইব আরও বলেন, ‘পণ্যের মানোন্নয়ন নিশ্চিতের পাশাপাশি উন্নত মানের প্যাকেজিংয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নত মানের কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি মান নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা, সহজ শর্তে জমি ও ঋণের ব্যবস্থা, মোবাইল কোর্টের পরিবর্তে সার্ভিলেন্স অডিট (নিরীক্ষা) এবং একক তদারককারী কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে ছৈয়দ মুহাম্মদ শোয়াইব হাছানের সংসার। আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমার হবি (শখ) হচ্ছে ব্যবসা করা। আমি কখনো বিরক্ত হই না। ব্যবসাতেই আনন্দ পাই। জীবনের বড় অংশই ব্যয় করেছি ব্যবসার পেছনে। জীবনের সব পুঁজি বিনিয়োগ করেছি কারখানায়।’ সূত্রঃ প্রথম আলো