পেটের দায়ে রিকশা চালিয়ে দিলেন বিসিএস, চাকরি পেয়ে মাকে চড়ালেন স্বপ্নের বিমানে

| আপডেট :  ২ জানুয়ারি ২০২১, ১২:১২ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২ জানুয়ারি ২০২১, ১২:১২ অপরাহ্ণ

বিমানের আওয়াজ কানে বাজলেই যেকোনো কেউ একবার হলেও আকাশের দিকে তাকান। গ্রাম হলে তো কথাই নেই; বাচ্চাদের সঙ্গে বৃদ্ধরাও বিমান দেখতে ঘর থেকে দৌড়ে উঠানে চলে আসেন। তেমনই একজন গীরু বালা রায়।

আকাশে ওড়া বিমান দেখতে দেখতে প্রায়ই আফসোস করে বলতেন, ‘একদিন যদি চড়তে পারতাম….’ এ বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতেন। কারণ গীরু বালা রায়ের সংসারে অনটন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা। আর বিমানে চড়া তো এভারেস্টের চূড়ায় উঠার মতোই দুঃস্বপ্ন। তবু মাকে কথা দিয়েছিলেন ছোট ছেলে শিপন রায়। বলেছিলেন চাকরি হলেই পূরণ করবেন মায়ের স্বপ্ন। অবশেষে মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

গত বুধবার বিকেলে ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে চড়িয়ে মাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আনেন আদরের ছোট ছেলে শিপন রায়। এর আগের দিন মঙ্গলবারেই ৩৮তম বিসিএসের নন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন তিনি।

শিপন রায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। এমফিল করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর মধ্যেই এলো মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা ছেলেটির চাকরির সুখবর।

যদিও শিপনের উঠে আসার গল্পটা অনেক সংগ্রামের। কী করেননি এ জীবনে। ১০ বছর বয়স থেকেই শুরু হয় তার লড়াই। রিকশা চালিয়ে প্রথম রোজগার। নরসুন্দরের কাজ, ধান রোপণ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঁকড়া, তেল, সবজি, মাছ-শুঁটকি বিক্রি সব পেশাতেই হাত বসাতে হয়েছে শিপনের। শুধু তাই নয়; জীবনের তাগিদে গরুর গোবর দিয়ে লাকড়ি বানিয়েও বিক্রি করেছেন। করোনায় গ্রামে গিয়ে ৭০ শতক জমিতে নিজেই আমনের বর্গাচাষ করছেন। এবার পূরণ করলেন মায়ের স্বপ্ন।

শিপন রায় বলেন, নন ক্যাডারে সরকারি মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক (বাংলা) হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত হতেই তড়িঘড়ি করে মায়ের স্বপ্ন পূরণে নেমে পড়ি। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে প্রায় মধ্যরাতে জোগাড় করি বিমানের টিকিট। বুধবার ভোরে ফেনীর সোনাগাজীর চরচান্দিয়ার বাড়ি থেকে রওনা হই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। বিকেল তিনটার ফ্লাইটে চড়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে নামি। সেখান থেকে পুনরায় ঘরে ফেরা।

মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে শিপন রায়ের মুখেও হাসি ফুটেছে। শিপন বলেন, ‘মায়ের বয়স বাড়ছিল। এখন ৬২ বছর। জীর্ণশীর্ণ শরীরে নানা ধরনের রোগও বাসা বেঁধেছে। তাই ক্রমাগত মনের ভেতর ঘুরফাঁক খেত একটা প্রশ্ন, মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো তো? সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, চাকরিটা দ্রুতই হলো।’

বিমানবন্দর আর বিমানের ভেতরে মায়ের সঙ্গে স্মারক হিসেবে নানা ছবি তুলে রেখেছেন শিপন রায়। তার একটি ছবিতে দেখা যায়, ধবধবে সাদা শার্ট পরা ছেলের পাশে বসে আছেন মা গীরু বালা রায়। মুখজুড়ে উপচে পড়ছে হাসির ঢেউ। হাত উঁচিয়ে ছেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেখাচ্ছেন ভি চিহ্ন।

চট্টগ্রামে নামার পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে গীরু বালা রায় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, এ জীবনে আমার দুটি স্বপ্ন ছিল। ছেলের চাকরির খবর শোনা আর বিমানে চড়া। দুদিনে দুটোই পূরণ হয়ে গেছে। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।

২০০৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শিপন। তখনই বাবা স্বপ্ন রায়কে হারান তিনি। অভাবের সংসারে দুঃখ-কষ্ট লেগে ছিল সারা বছরই। শিপনের মা গীরু বালা রায়ের সারাজীবনই কেটেছে এ ঘরে ও ঘরে কাজ করে। এখন ৬২ বছর বয়স বলে সেটিও আর পারেন না।

শিপনের এক ভাই নরসুন্দরের কাজ করেন। আরেক ভাই চালান রিকশা। বিয়ে করে তারা দুজনই আলাদা সংসারে উঠেছেন। তিন ভাই মিলে মায়ের খরচ জোগান। বলতে গেলে মাথা গোঁজার জন্য বসতভিটা তোলার এক টুকরো জায়গাও তাদের নেই।

সেজন্য পড়ালেখা চালিয়ে নিতে প্রায় সব কাজেই হাত দিতে হয়েছে শিপনকে। শিপন হাসতে হাসতে বলেন, ২৮ বছরের জীবনে ২৬ ধরনের কাজ করেছি। নাপিতের কাজ করেছি প্রায় ১০ বছর। টয়লেটও পরিষ্কার করেছি। কদিন আগেও জমিতে কাজ করলাম।

অবশ্য এ দীর্ঘ জীবন সংগ্রামে মানুষের নানা সহযোগিতাও পেয়েছেন শিপন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের শুরু থেকেই পাচ্ছেন ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ‘পে ইট ফরওয়ার্ডের’ বৃত্তিও। করোনায় টিউশনি হারালে আবারো পাশে দাঁড়ায় এ সংগঠন। এখান থেকে পাওয়া ১০ হাজার টাকায় নিজের গ্রামে ৭০ শতক জমিতে আমনের বর্গাচাষ করেছেন। এখন সেই ধান ঘরে তুলেছেন।

মানুষের এ ঋণ পরিশোধে প্রায় সময় অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন শিপন। করোনার সময়ে গ্রামে লাশ সৎকারে এগিয়ে গেছেন। গড়ে তুলেছেন প্যারেন্টস কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সংগঠনও। যার মাধ্যমে তিনি রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মানসিক প্রতিবন্ধীদের চুল-দাড়ি কেটে দিয়ে প্রশান্তি জোগান। অন্যের কাছ থেকে কাপড়চোপড় এনে তুলে দেন তাদের গায়ে।

শিপন বলেন, এখন চাকরি হওয়ায় মানুষকে আর্থিকভাবেও সহায়তা করতে পারবো। এর চেয়ে আনন্দ হয় না। তবে সব আনন্দ যেন মাকে বিমানে চড়িয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে পারার আনন্দের কাছে ছাপিয়ে গেছে।