কেন ভেঙে যায় মন

| আপডেট :  ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

‘কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব।’ এ কথা বলেছিলেন ‘বিখ্যাত’ অমিত রায়, মানে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাসের নায়ক। প্রেমিকা লাবণ্যকে দিঘির সঙ্গে তুলনা করেও অমিত কিন্তু বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেতকীকে। কেন? ওই যে, ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তোলা যায়, ব্যবহার করা যায়!

বাঙালি পুরুষের (পড়ুন, অধিকাংশ পুরুষের) মনস্তত্ত্বটা ঠিকই ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্ত্রী মানে ঘরের চৌহদ্দিতে থাকা সহজলভ্য একটি ‘বস্তু’। স্বামীটি তাঁকে ভালোবাসেন না তা নয়, কিন্তু তাঁর যে আলাদা মর্যাদা আছে, গুরুত্ব আছে, এ কথা যেন মনেই থাকে না। এ দেশে যুগে যুগে কমবেশি এ রকমই চলেছে। কিন্তু এখন আর ঠিক সেভাবে চলছে না।

আপনি হয়তো বলবেন, কেন, বেশ তো চলছে, সমস্যা কোথায়?

সমস্যা কোথায় জানতে নিজের চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পারেন, অথবা সমস্যাটির গুরুত্ব বুঝতে চোখ বুলিয়ে নিন পত্রিকার পাতায়। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, ২২ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে বিবাহবিচ্ছেদ হয় ৩৯টি, প্রতি মাসে সম্পর্কচ্ছেদ করছেন গড়ে ১ হাজার ১৯৪ দম্পতি। এসব বিচ্ছেদের ৭০ শতাংশ আবেদন এসেছে স্ত্রীর পক্ষ থেকে। একই প্রতিবেদনে দেশের অন্য দুটি শহরের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা-ও প্রায় অভিন্ন। চট্টগ্রামে প্রতিদিন বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা গড়ে ১৮টি, আর সিলেটে গত বছরের তুলনায় বিচ্ছেদের আবেদন বেড়েছে ১০ গুণ।

দেখে–শুনে মনে হয় না, দাম্পত্য সম্পর্ক আর আগের মতো নেই? অবশ্য, এই সম্পর্ক এখনকার তুলনায় আগে অনেক মধুর ছিল এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আগে মেয়েদের সহ্যশক্তি ও ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা বা বাধ্যবাধকতা বেশি ছিল। এখন এ অবস্থা পাল্টেছে। ‘সাত চড়ে রা কাড়ে না’ এমন সর্বংসহা মেয়ের সংখ্যাও কমেছে। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে আত্মসম্মানবোধও বেড়েছে বলে সবকিছু মুখ বুজে সয়ে নেওয়ার বদলে প্রতিবাদ করা বা সম্পর্কচ্ছেদ করাটাকে শ্রেয় মনে করছেন তাঁরা।

একতরফা সব দোষ পুরুষের কাঁধে চাপালে অবশ্য সমস্যার মূল জায়গায় হাত দেওয়া হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর কারণেও সম্পর্কে চিড় ধরে, সংসার ভেঙে যায়। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে বর্তমান বছরটি নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা দরকার। কারণ, এ বছরটি ব্যতিক্রমী একটি বছর। এই সময়কালটি দুঃসহ, দুর্বহ একটি কাল। রোগ-শোক-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক অদ্ভুত দুঃসময় পার করছি আমরা। এর প্রভাব আমাদের দাম্পত্য জীবনেও পড়েছে। এ বছর তুলনামূলক বেশি বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে আতিমারির অভিশাপকেই বিবেচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই করোনাকালে অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

চাকরি হারিয়েছেন কেউ, কেউবা হারিয়েছেন ব্যবসার পুঁজি। জীবন ও জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তা মানুষকে অসহিষ্ণু করে তুলেছে। আর এই মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ তো ঘটে নিজের ঘরেই। এর ফল ভোগ করতে হয় সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে। এ রকম দুরবস্থায় স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে সান্ত্বনা জোগানোর কথা, পরস্পরের আরও কাছে থাকার কথা। কিন্তু অভাব যে স্বভাবটাকেও নষ্ট করে।

যে পুরুষটি উপার্জনের পথ হারিয়ে ঘরে বসে আছেন, তাঁর কাছে সংসারের এটা–ওটা প্রয়োজনের কথা বলতে এলে স্ত্রীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন তিনি। ক্ষোভে-দুঃখে স্ত্রীটির প্রতিক্রিয়াও হয়তো অশোভন হয়ে পড়েছে। ‘ভাত দেবে না কিলের গোঁসাই’কে কে সহ্য করবে বলুন? এই অসহিষ্ণুতা একসময় বড় আকার নিয়ে ভাঙনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে দাম্পত্য জীবনকে। অথবা যে নারীটি চাকরি করে এত দিন পরিবারের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতেন, করোনাকালে চাকরি হারানোর পর স্বামীর কটুকাটব্য শুনে হয়তো সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি। ‘অকৃতজ্ঞ’ স্বামীকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাগে-অভিমানে।

শুধু আর্থিক সমস্যা বা অভাব-অনটনের মধ্যেই ভাঙনের সব কারণ সীমাবদ্ধ নয়। আগের তুলনায় ঘরে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে সহজাতভাবে বহির্মুখী স্বভাবের পুরুষ। ঘরের খুঁটিনাটি নিয়ে এত দিন মাথা ঘামাতেন না। এখন সবকিছুতেই নজর, সবকিছু নিয়েই খিটিমিটি। এমনকি স্ত্রীর ফেসবুক ব্যবহার, মুঠোফোনে কথোপকথন—এসব নিয়েও আপত্তি। স্ত্রীও হয়তো একইভাবে স্বামীর ওপর নজরদারি করছেন বেশি। শুরু হলো পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস। এই সন্দেহ জিনিসটা হলো দুধারী তলোয়ারের মতো, যেতেও কাটে আসতেও কাটে। এভাবে ভাঙনের মুখে পড়ল তিলে তিলে গড়ে তোলা দাম্পত্য!

করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা যে অনেক গুণ বেড়েছে, দেশ-বিদেশের একাধিক জরিপে উঠে এসেছে এ তথ্য। এটা একটা সময়ের চিত্র। যেহেতু এর পূর্বাভাস ছিল না, তাই এর নিদান খোঁজার সুযোগও তেমন ছিল না। এখন আমরা শুধু আশায় দিন গুনতে পারি, এই মহামারির অবসান হলে সহিংসতার প্রবণতাও যদি বন্ধ হয়।

কিন্তু করোনাকালের কথা বাদ দিলেও কয়েক বছর ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের হার ঊর্ধ্বমুখী এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শুরুতে বলেছি, স্ত্রীর প্রতি অবজ্ঞা-উপেক্ষা অধিকাংশ পুরুষের সহজাত প্রবণতা। এই মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। একইভাবে অভিযোগপ্রবণ না হয়ে নারীরও হয়ে উঠতে হবে সহযোগিতাপ্রবণ। মোদ্দা কথা, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা তো বটেই, শ্রদ্ধারও একটা জায়গা থাকতে হবে। বিত্ত ও সামর্থ্যের অভাবের জন্য স্বামীকে অন্য একজন পুরুষের কাছে খাটো করতে থাকলে সংসার আনন্দময় হবে না। তেমনি স্ত্রীর ছোটখাটো ত্রুটিকে অনেক বড় করে দেখিয়ে তাকে অপমান-অসম্মান করতে থাকলেও ধীরে ধীরে সঞ্চিত ক্ষোভ একদিন অনেক বড় রূপ নিতে পারে। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন।’ এই কাব্য পঙ্‌ক্তিরই প্রতিধ্বনি ঘটে জীবনে। আগে মন ভেঙে যায়, তারপর সংসার ভাঙে।

পরস্পরের ভুলত্রুটিগুলোর দিকে আঙুল না তুলে, তাঁর গুণগুলো শনাক্ত করুন। তাঁর প্রতি মুগ্ধতার কথা জানান। ক্ষমা, মমতা, সহিষ্ণুতা, অনুরাগ ও শ্রদ্ধা প্রভৃতি শব্দগুলোকে অভিধানের পাতা থেকে তুলে এনে নিজেদের জীবনে স্থান দিন। জলসিঞ্চনে গাছের চারা পরিপূর্ণ বৃক্ষ হয়ে ওঠে, একইভাবে ডালপালা পত্র ও পল্লবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে আমাদের দাম্পত্য জীবনও।