তেলের পর দৌড়াচ্ছে পিয়াজ, বেড়েছে ডিম দুধের দামও

| আপডেট :  ১৩ মে ২০২২, ০১:৩৮ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৩ মে ২০২২, ০১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ভোজ্য তেলের পর ছুটছে পিয়াজের দাম। বেড়েছে ডিম আর দুধের দামও। দুইদিনের ব্যবধানে পিয়াজের কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। গত কয়েক দিন ধরেই ভোজ্য তেল নিয়ে ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। দুশ’ টাকা লিটারের তেলের সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এমন অবস্থার মধ্যে নতুন পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে অসহায় সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে দুধ ডিমের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন অনেকে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে পণ্যটি আমদানি বন্ধ হওয়ার কারণে দেশের খুচরা ও পাইকারি বাজারে পিয়াজের দাম বেড়েছে বলে অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল সরজমিন রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, কাওরান বাজারসহ কয়েকটি বাজার ও পাড়া-মহল্লার দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুইদিনের ব্যবধানে খুচরায় প্রতি কেজি পিয়াজের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

এখন বাজারে প্রতিকেজি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। যদিও কয়েকদিন আগে এই পণ্যটির দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। এদিকে পিয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তরল দুধের দামও বেড়েছে লিটারে ৫ থেকে ১০ টাকা পাশাপাশি একই হারে বেড়েছে ডিমের দামও। হঠাৎ এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যগুলোর দাম বাড়ায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভোক্তারা।

ওদিকে সরকার বলছে, কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় সরকার আপাতত পিয়াজ আমদানির অনুমোদন দেবে না। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে বুধবার কৃষিমন্ত্রী বলেন, কয়েক দিন আগে পিয়াজের ভরা মৌসুমে কৃষক দাম পায়নি। কৃষক যাতে তাদের উৎপাদিত পিয়াজের দাম পায় সে জন্যই আমদানি কিছুটা সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ কৃষক উৎপাদন খরচ তুলতে না পারলে আগামী বছর পিয়াজ চাষে আগ্রহী হবে না। এখন দাম একটু বৃদ্ধির সুবাদে কৃষক পিয়াজের মূল্য পাচ্ছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে পিয়াজের দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ২৯ শতাংশ। টিসিবি’র হিসাব অনুযায়ী, এক সপ্তাহ আগে দেশে পিয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ২৮ থেকে ৩০ টাকা। এখন তা বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। সে হিসাবে দর বেড়েছে ২৯.৩১ শতাংশ। আমদানি করা পিয়াজও বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ২৫ থেকে ৩৫ টাকা, দরবৃদ্ধির হার ২৫ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার কৃষকের কথা বিবেচনা করে পিয়াজ আমদানি বন্ধ রাখলেও তার সুফল কৃষক তেমন একটা পান না। কারণ দাদন বা ধারে টাকা নিয়ে কৃষক পিয়াজ চাষ করেন। ফসল ?তুলে তাৎক্ষণিক তা বিক্রি করেই তারা দাদন বা ধারের টাকা শোধ করেন। তাই কৃষকের কাছে এখন আর তেমন পিয়াজ নেই, যা আছে তা স্থানীয় আড়তদার ও বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। এখন এরাই মুনাফা ঘরে তুলছে।

খিলগাঁও কাঁচাবাজারের ফেনী জেনারেল স্টোরের জহিরুল ইসলাম বলেন, দু’দিন আগেও ৩৫ টাকা পিয়াজ বিক্রি করেছি। আর আজকে পাইকারদের থেকে আমাদের কিনতে হয়েছে ৪২ টাকা দিয়ে। দাম কেন বাড়ছে তা জানি না। পাইকারদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথাই বলা যায় না। দাম বাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে খারাপ ব্যবহার করে। অন্য পাইকার থেকে কিনতে বলে। জোবায়ের স্টোরের জোবায়ের আহমেদ বলেন, পাইকাররা সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়। ভোক্তারা আমাদের দোষারোপ করেন।

মা জেনারেল স্টোরের বাবু বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ছে। মানুষ শুধু তেল নিয়ে পড়ে আছে। পিয়াজ, শুকনা মরিচ, সাবান, আদা এগুলার দামও বাড়ছে। তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নাই। শুধু তেল নিয়ে হইচই। আজকে কেজিতে ২০ টাকা বেশি দিয়ে শুকনা মরিচ কিনছি।

পিয়াজের দাম বৃদ্ধির জন্য ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ার অজুহাত দিচ্ছেন পাইকাররা। তারা বলছেন, ভারত থেকে এখন পিয়াজ আসা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই দেশি পিয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। এজন্য দাম বেড়ে গেছে। পিয়াজ আসা শুরু করলে আবার দাম কমবে। গতকাল কাওরান বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা ৩৮ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে পিয়াজ বিক্রি করেছেন। যদিও কয়েকদিন আগেও ২৫-২৬ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছিল। পিয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ী কামাল শেখ বলেন, এখন ভারতীয় পিয়াজ আসছে না। তাই দেশি পিয়াজের চাহিদা অনেক বাড়ছে। একটা না থাকলে আরেকটার দাম বাড়া স্বাভাবিক।

শামীম হোসেন নামের আরেক পাইকার বলেন, ঈদের পর দোকান খুলেছে। এখন পণ্যের অর্ডার বেশি হচ্ছে। তাই দামও বাড়িয়ে দেয়া হইছে। এ ছাড়া ভারতের পিয়াজও আমদানি বন্ধ। বৃষ্টি বাদলের জন্যও পিয়াজের দাম কিছুটা বাড়ছে।

পিয়াজের দাম আরও বাড়ার শঙ্কায় এক শ্রেণির ভোক্তারাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্রয় করছেন। তারা বলছেন, গত বছর পিয়াজের দাম ২৫০ টাকায় ঠেকেছিল। এতে তাদের পণ্যটি নিয়ে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল। তাই এবার অতিরিক্ত দাম বাড়ার আগেই কিনে রাখছেন।
এদিকে অনেক ভোক্তা প্রশ্ন করছেন, ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হলে দেশি পিয়াজের দাম বাড়বে কেন? পিয়াজের এই মূল্যবৃদ্ধি অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বলেও দাবি করেন তারা। মালিবাগ কাঁচাবাজারে পিয়াজ কিনতে আসা মহসিন নামের এক ক্রেতা বলেন, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা এতদিন তেল নিয়ে কারচুপি করে দাম ২০০ টাকায় নিয়ে গেছে। এখন আবার পিয়াজ নিয়ে শুরু করছে। তাদের এসব কারচুপি বন্ধ না হলে বাজার কখনো স্থিতিশীল হবে না। আবির হোসেন বলেন, বাজারে এখন সবকিছুর দামই বেশি। পণ্য কিনতে এসে শান্তি নাই। যার যেভাবে ইচ্ছা দাম বাড়াচ্ছে। এসব দেখারও কেউ নাই।

গত ৫ই মে পর্যন্ত ভারত থেকে পিয়াজ আমদানির জন্য ইমপোর্ট পারমিটের (আইপি) মেয়াদ ছিল। সর্বশেষ ৩০শে এপ্রিল ৬৮টি ট্রাকে ১,৯০২ টন পিয়াজ আমদানি হয়। এরপর ঈদের ছুটি শেষে ৭ই মে থেকে বন্দর দিয়ে আমদানি শুরু হলেও পিয়াজ আসা বন্ধ রয়েছে।

এদিকে গত চার মাসে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে ১৬,৮৯১ টন পিয়াজ আমদানি হয়েছে। তবে ১লা এপ্রিল থেকে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়েও পিয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। রাজধানীর শ্যামবাজারের পিয়াজ আমদানিকারক মোহাম্মদ মাজেদ বলেন, পিয়াজ আমদানির অনুমতি না থাকায় আমরা ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছি না। সেজন্য আমদানি বন্ধ রয়েছে। তবে বাজারে পিয়াজের সংকট নেই।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পিয়াজের চাহিদার বড় অংশই দেশীয় ফলন দিয়ে মেটানো হয়। দেশে বছরে পিয়াজের চাহিদা রয়েছে ২৫ লাখ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯ লাখ ৫৫ হাজার টন পিয়াজ উৎপাদন হয়েছে। জমি থেকে তোলার সময় নষ্ট হওয়া, নিম্নমান ও পচে যাওয়ার কারণে প্রায় ২৫ শতাংশ পিয়াজ ফেলে দিতে হয়। ফলে বছরে ৬ থেকে ৭ লাখ টন আমদানি করা হয়ে থাকে। আমদানি করা পিয়াজের ৮ থেকে ১০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণে নষ্ট হয়। দেশে মোট আমদানি করা পিয়াজের ৮০ শতাংশের বেশি আসে পাশের দেশ ভারত থেকে।

এদিকে বাজারে নিত্যপণ্যের দামের অস্থিরতায় পিছিয়ে নেই ডিমও। দুইদিনের ব্যবধানে ডজনে দাম বেড়েছে ১১ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর কাওরান বাজারে খুচরা পর্যায়ে ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন ১২০ থেকে ১২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে পাড়া-মহল্লায় তা ১২০ থেকে ১২৫ টাকা রাখা হচ্ছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে ডিমের সরবরাহ কমে গেছে। এ কারণে দাম বাড়ছে। কাওরান বাজারের ডিম বিক্রেতা শাহ আলম বলেন, ডিমের চাহিদা বাড়লে পাইকাররা দাম বাড়িয়ে দেন। তখন খুচরা বিক্রেতাদেরও বাড়তি দরে বিক্রি না করে উপায় থাকে না।

ডিমের দাম বাড়ার বিষয়টি দেখা গেছে টিসিবি’র দৈনন্দিন বাজারের চিত্রেও। সংস্থাটির তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ১২ শতাংশ দাম বেড়েছে ডিমের। বর্তমানে সর্বনিম্ন ১০৫ থেকে ১২৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ডিমের ডজন।

এদিকে মিল্ক ভিটা তরল দুধের দামও বেড়েছে। মিল্ক ভিটার বেঁধে দেয়া ১ লিটার প্যাকেটজাত দুধের দাম ৭৫ টাকা। হাফ লিটারের দাম ৪০ টাকা। ২৫০ এমএল ২৫ টাকা। ২০০ এমএল ২২ টাকা। তবে এই দামে খুব কম দোকানেই ন্যায্যমূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। দাম বেড়েছে অন্য কোম্পানির দুধেরও। ওদিকে আলুর দামও কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫ টাকা। গত বুধবার ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া আলু রাজধানীতে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। সুত্রঃ মানবজমিন