২০ কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব ফাঁস

| আপডেট :  ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:২৬ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

অর্থনীতিঃ আবদুর রাজ্জাক। পদে তিনি ঢাকার সন্নিকটবর্তী মাধ্যমিক দশ স্কুল প্রকল্পের গবেষণা কর্মকর্তা। তার আরেক পরিচয়, তিনি হিসাববিজ্ঞান পাঠ্যবই ও সাহিত্যের লেখক। তাকেই ২০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বৃ’দ্ধিসহ অবাধ দু’র্নীতির সুযোগ চেয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সাবেক পিডি আমিরুল ইসলাম। ম’ন্ত্রণালয়সহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে এ বি’ষয়ে অ’ভিযোগও দিয়েছিলেন। উল্টো ভিত্তিহীন অ’ভিযোগে তাকেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অথচ প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তাকে প্রকল্প থেকে সরিয়ে দেয়া হলেও বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ত’দন্তে দশ মাধ্যমিক স্কুল প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা দু’র্নীতির নীলনকশা আয়োজনের প্রমাণও পায় শিক্ষা ম’ন্ত্রণালয় থেকে গঠিত ত’দন্ত কমিটি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। চাঞ্চল্যকর আরও ভ’য়াবহ সব তথ্য ফাঁ’স করে আ’দালতে এখন বিচারপ্রার্থী হয়েছেন আবদুর রাজ্জাক।

জানা যায়, দু’র্নীতির মহাপরিকল্পনা ফাঁ’স করে কয়েক মাস ধরে নানাভাবে হ’য়রানির শি’কার হচ্ছেন আবদুর রাজ্জাক। এমনকি ৮ মাস ধরে খোরপোষ ভাতাও পান না তিনি। জালিয়াতি করে তার খোরপোষ ভাতার টাকা দেয়া হয়েছে আরেকজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এসব কিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন ক্ষমতাধর সাবেক সেই পিডি। অ’ভিযোগ আছে, দায়িত্বশীল শিক্ষা ক্যাডারের শীর্ষ কর্মকর্তারা দু’র্নীতিবাজ এই আমিরুল ইসলামকে আড়াল করতে ব্যস্ত। এ বি’ষয়ে গঠিত একাধিক ত’দন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পরও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষো’ভে চাঞ্চল্যকর অ’ভিযোগ নিয়ে অবশেষে আ’দালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রকল্প পরিচালক আমিরুল ইসলাম ও মাউশির সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য স’চিব দিল আফরোজ বিনতে আছিরসহ ৫ জনের বি’রুদ্ধে ঢাকার চিফ জু’ডিশিয়াল ম্যা’জিস্ট্রেটের আ’দালতে মা’মলা করা হয়েছে। মা’মলায় অপর তিন আ’সামি হলেন শিক্ষা ম’ন্ত্রণালয়ের অধীন নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সরোজিত কুমার ঘোষ ও মাউশির মহাপরিচালক এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক ও শিক্ষা ম’ন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সারবিন চৌধুরী। বৃহস্পতিবার দা’য়ের করা আবদুর রাজ্জাকের এজাহার আমলে নিয়ে বিচারক বাকী বিল্লাহ ১৫ দিনের মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) ত’দন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার আদেশ দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, গত ৩০ ডিসেম্বর ১০ স্কুল নির্মাণ প্রকল্পে ‘জমি অধিগ্রহণে তিনশ কোটি টাকা লোপাটের আয়োজন’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর স’রকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে একটি বিশেষ গো’য়েন্দা সংস্থার ৮টি টিম সরেজমিন ত’দন্তে নামে। ত’দন্তে প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা প্রমাণিত হয়। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে স’রকারের প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে নীলনকশা করার বি’ষয়টি প্রতীয়মান হয়। দু’র্নীতি করতে গিয়ে আলোচিত এই প্রকল্পের জমিতে থাকা একটি কড়ই গাছের ক্ষ’তিপূরণ ধরা হয় ৪ কোটি টাকা। একটি নারকেল গাছের দাম হাঁকা হয় প্রায় কোটি টাকা। একটি টিনশেডের ক্ষ’তিপূরণ হিসেবে দাম ধরা হয় ২ কোটি টাকা। একপর্যায়ে শিক্ষা ম’ন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত স’চিব (মাধ্যমিক-২) মোমিনুর রশীদ আমিনকে সভাপতি করে তিন সদস্যবিশিষ্ট ত’দন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি প্রকল্পের সাবেক পিডি ড. আমিরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক দিল আফরোজ বিনতে আছির, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সার্ভেয়ার, কানুনগোসহ ৬ জনকে দায়ী করে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা ম’ন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষা বিভাগের স’চিবের কাছে এ সংক্রান্ত বিশদ প্রতিবেদন জমা পড়ে। এরপরই আমিরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়। নিয়মানুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় মা’মলা রজু হওয়ার কথা। কিন্তু র’হস্যজনক কারণে গত তিন মাসেও এ বি’ষয়ে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি।

এজাহারে গু’রুতর যত অ’ভিযোগ : মা’মলার বা’দী আবদুর রাজ্জাক অ’ভিযোগে উল্লেখ করেন, বিবা’দীরা একে অপরের সহযোগী। দশ মাধ্যমিক স্কুল প্রকল্পে তিনি প্রেষণে গবেষণা কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। তাকে প্রকল্পের অর্থ ও হিসাবের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় তিনি সাবেক পিডি আমিরুল ইসলাম স’রকারের কমপক্ষে ৪৭৮ কোটি টাকা আ’ত্মসাতের নীলনকশার প্র’তিবাদ করেন।

এক পর্যায়ে দু’র্নীতির টাকা ভাগবাটোয়ারার জন্য এই সিন্ডিকে’টের সহায়তায় তৈরি করা ৩শ’ টাকার জু’ডিশিয়াল স্ট্যাম্পে করা অ’বৈধ চুক্তিপত্রের সন্ধান পান। আমিরুল ইসলাম দু’র্নীতি প্রক্রিয়ায় শামিল হতে তাকে চা’প প্রয়োগ করে। কিন্তু তিনি সম্মত না হওয়ায় গত বছরের ২১ নভেম্বর সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে তাকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘সব প্রকল্পেই ডিসবার্সমেন্ট (ভাগবাটোয়ারা) হয়। এখানে (দশ স্কুল প্রকল্প) বরং কম হচ্ছে। তুমি লাখ বিশেক টাকা নিয়ে চুপ থাক। তোমাকে কিছু করতে হবে না।’ এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এজাহারে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা মহিউদ্দিন শেখ নামে একজনকে উদ্দেশ করে আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘ও (আবদুর রাজ্জাক) তো পাগল। একটা গাধা। ওকে (আবদুর রাজ্জাক) বোঝাও। আমি না চাইলে ও দশ স্কুল প্রকল্পেই থাকতে পারবে না। ওকে আমিই প্রকল্পে এনেছি। আমি বলছি- ওকে বোঝাও।’ পরে ওই ঘটনার দু’দিন পর ২৪ নভেম্বর দুপুর ১২টায় প্রকল্পের পিডির কক্ষে আবদুর রাজ্জাককে ডেকে নিয়ে আমিরুল ইসলাম ২০ কোটি টাকার প্রস্তাব দেন। রাজ্জাক ঘুষ নিতে রাজি না হওয়ায় প্রকল্প থেকে তাকে সরিয়ে দিতে একের পর এক উল্টো মি’থ্যা অ’ভিযোগ আনতে শুরু করেন। আমিরুল ইসলামের দু’র্নীতির নীলনকশার বি’ষয়টি আবদুর রাজ্জাক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স’চিবকে অবহিত করেন। এরপরই নিষ্পত্তিকৃত পারিবারিক একটি বি’ষয় পুনরায় সামনে এনে সংঘবদ্ধ দু’র্নীতিবাজ চ’ক্রটি তাকে ভূতাপেক্ষভাবে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করানোর ব্যবস্থা করে।

এজাহারের এক স্থানে বলা হয়, শিক্ষা ম’ন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত স’চিব মোমিনুর রশীদ আমিনসহ তিন সদস্য ত’দন্ত কমিটি আলোচ্য শিক্ষা প্রকল্পের ভ’য়াবহ দু’র্নীতি ও দায়ীদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেয়। পরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের স’চিব মো. মাহবুব হোসেনের কাছে আমিরুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক দিল আফরোজ বিনতে আছিরসহ ৬ জনের বি’রুদ্ধে দেয়া প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে আমিরুল ইসলাম ও দিল আফরোজ বিনতে আছিরের বি’রুদ্ধে বিভাগীয় মা’মলার অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু বৃহৎ সিন্ডিকে’টের সহায়তায় এখন পর্যন্ত তাদের বি’রুদ্ধে বিভাগীয় মা’মলা বা শা’স্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়ার পর যে খোরপোষ ভাতা আবদুর রাজ্জাক পাওয়ার কথা সেই টাকা থেকেও আমিরুল ইসলাম তাকে বঞ্চিত করেছেন- এমন অ’ভিযোগও করা হয়েছে। এ বি’ষয়ে বলা হয়, গত বছরের ২৪ নভেম্বর থেকে এ বছরের ৩ মার্চ পর্যন্ত রাজ্জাকের খোরপোষ ভাতা ষ’ড়যন্ত্র করে অন্য আরেকজনের ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়। এ সময়ে পরিবার নিয়ে অ’মানবিক জীবনযাপন করেছেন। এজাহারে উল্লেখিত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তারা আমিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশ করে এই জালিয়াতি করেছেন বলে অ’ভিযোগ করা হয়েছে। মাস্টার প্ল্যান ও একে অপরের যোগসাজশ ছাড়া দাফতরিক আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। এটা এখতিয়ারবহির্ভূত ও মানি লন্ডারিং আইন-২০১২ এর ৪(২) ধারায় অ’পরাধ। গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের (সিজিএ) উপহিসাব মহানিয়ন্ত্রক বি’ষয়টি ত’দন্ত করেছেন। ত’দন্তে জালিয়াতির বি’ষয়টি প্রমাণিতও হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বি’রুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অ’ভিযোগের বি’ষয়ে বক্তব্য জানতে দশ স্কুল প্রকল্পের সাবেক পিডি ড. আমিরুল ইসলামকে মুঠোফোনে কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।