ছিনতাই চক্রের নেতা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, মাঠে পাইলট-ঈগল!

| আপডেট :  ২ মে ২০২২, ০৪:১২ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২ মে ২০২২, ০৪:১২ অপরাহ্ণ

রাজধানীর মগবাজার ও মোহাম্মদপুর পশ্চিম কাটাসুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এ সময় ৩৪ লাখ টাকা, চার হাজার পিস ইয়াবা, দুইটি দামি মোটরসাইকেলসহ ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।পুলিশ বলছে, এই ছিনতাই চক্রের মূল হোতা একজন প্রকৌশলী। তিনিই পরিকল্পনা করতেন ছিনতাইয়ের। তার নির্দেশে যারা মাঠে মোটরসাইকেল নিয়ে ছিনতাই করতেন, তাদের নাম দেওয়া হয়েছে পাইলট ও ঈগল।

সোমবার (২ মে) ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। তিনি জানান, রোববার (১ মে) অভিযান চালিয়ে এই চক্রের চার সদস্য— লেলিন শেখ, আশরাফুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান খান ও সাইফুল ইসলাম শাওনকে গ্রেফতার করা হয়।

ডিবি পুলিশের দাবি, এই চার জন দুইটি দল হয়ে ছিনতাই করে আসছিল। এর মধ্যে আশরাফুল ইসলাম একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি ধানমন্ডির একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। ‘বাড়তি আয়ের চিন্তা’ থেকেই ছিনতাইয়ে নাম লেখান তিনি। চক্রের বাকি তিন সদস্যই গাড়িচালক।

চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসা তথ্যের বরাত দিয়ে ডিবি বলছে, ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে আশরাফুলের বেতন কিছুটা কমে যায়। ওই সময় টেক্সটাইল সামগ্রী আনা-নেওয়া করতে গিয়ে পরিচয় হয় মিনি ট্রাকের চালক লেলিন শেখের সঙ্গে। লেলিন আগে থেকেই ‘ছিনতাইয়ের গুরু’ হিসেবে পরিচিত ছিলন ওই এলাকার অপরাধীদের কাছে। তার কাছে ছিনতাইয়ের কলাকৌশল শুনে লোভে পড়েন যান আশরাফুল। এক পর্যায়ে লেলিনকে গুরু মানতে শুরু করেন আশরাফুল।

গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুপুর পৌঁনে ২টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় ১১ লাখ টাকা প্রথম ছিনতাই করেন লেলিন ও আশরাফুল। একজন সরকারি কর্মকর্তা তার বোনের এমব্রয়ডারি মেশিন বিক্রি করা ১১ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেলে করে রিকশার পেছন দিক থেকে লেলিন ও আশরাফুল ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে যান। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় একটি মামলা হয়।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ছিনতাইয়ের কাজে মোটরসাইকেল চালানোর দায়িত্ব যার ওপর থাকে, তাকে চক্রের সদস্যরা ‘পাইলট’ বলে ডাকে। আর যিনি ছো মেরে ব্যাগ বা অন্য কিছু ছিনিয়ে নেন, তাকে বলা হয় ‘ঈগল’। এক্ষেত্রে আশরাফুল সবসময়েই একজন পাইলট হিসেবে কাজ করতেন। কারণ আশরাফুল ঢাকা শহরের অলিগলি চিনতেন। ছিনতাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব অলিগলি দিয়ে নিমেষেই উধাও হয়ে যেতে পারতেন। আর লেলিন শেখ পালন করতেন ঈগলের ভূমিকা। মোবাইল কিংবা ব্যাগ— টান দিলেই তর হাতে চলে আসত।

এদিকে, গত ১৪ মার্চ মিরপুর ১১ নম্বরের সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে চার লাখ ৯ হাজার ৭০০ টাকা তুলে মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়াম হয়ে ১০ নম্বরের দিকে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। জিল্লুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম শাওন মোটরসাইকেলে করে তাদের অনুসরণ করেন এবং টাকা ভর্তি ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে ৬ নম্বরের দিকে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় একটি মামলা হয়।

ডিবি জানিয়েছে, জিল্লুর ও শাওন ১৪ মার্চের ছিনতাইয়ের কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি জিল্লুর পাইলট ছিলেন এবং শাওন ঈগলের ভূমিকায় ছিলেন বলেও স্বীকার করেছেন। তারা দু’জন মগবাজারে একটি ক্লিনিকের অ্যাম্বুলেন্সের চালক ছিলেন।ডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই চার জন দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে ছিনতাই করলেও তারা একে অন্যকে চিনতেন। তারা সবাই যে ছিনতাইয়ে জড়িত, সেটিও সবাই জানতেন। চার জনের মধ্যে একজন ইঞ্জিনিয়ার হলেও বাকি তিন জনই ড্রাইভার।

একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়েও কেন আশরাফুল ছিনতাইয়ে জড়িত হয়েছেন— এ বিষয়ে ডিবি কর্মকর্তা হাফিজ আক্তার বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যা জানতে পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে— মূলত লোভ থেকেই ছিনতাইয়ে জড়িয়েছেন তিনি। তার পরিবারও জানত না এই কথা। সম্প্রতি যেসব ছিনতাইকারীকে ধরেছি আমরা এর মধ্যে একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন প্রাথমিক শিক্ষক, একজন মাদকাসক্ত ডাক্তারও পেয়েছি।

আরেক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, ছিনতাইকারীরা প্রথমেই ফাঁকা কোনো জায়গা বেছে নিয়ে রেকি করে নিত। তারপর তারা ছিনতাইয়ের টার্গেট ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণ করত। ব্যাংক বা বিপণীবিতানগুলোর সামনে তারা ওঁৎ পেতে থাকত। এরপর টার্গেটকে অনুসরণ করতে করতে হঠাৎ ছোঁ মেরে তার সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিত।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ বলেন, গত এক বছরে এই চক্র দুই শতাধিক ছিনতাই করেছে বলে ডিবির কাছে স্বীকার করেছে। ছিনতাইয়ে যারা টাকা হারিয়েছেন, তারা প্রমাণপত্রসহ যোগাযোগ করলে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে ফাঁকা ঢাকার নিরাপত্তা বিষয়েও কথা বলেন গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হাফিজ। বলেন, ঢাকা শহর এখন নীরব। ট্রাফিক বিভাগ এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড দিয়েছে। কেউ যেন ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে গাড়ি না চালান, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে পুলিশ। ইদকেন্দ্রিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপকসংখ্যক টহল পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। থানা পুলিশ যেন এলাকাভিত্তিক নিরাপত্তা বাড়াতে পারে, সেজন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বাসাবাড়ির প্রহরীদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন।