চরম অর্থক’ষ্ট ঋণের চা’প স্বামীর অ’ক্ষমতা ও প্র’লোভনের চা’পে ছিলেন সেই মা

| আপডেট :  ২৩ মার্চ ২০২২, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৩ মার্চ ২০২২, ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

”সোফাই সর্দার আমার কাছে জানতে চায়- তার বিয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি কিনা। দুই পুত্র নিয়ে পুনরায় বিয়ের বি’ষয়ে অস্বস্তির কথা বলি তাকে। তখন সে বলে, পথের কাঁটা কীভাবে দূর করতে হয় জানি। এর আগে রাইস মিলের মহিলাকর্মী আনু মালার মাধ্যমেও আমাকে প্রস্তাব দেয় সোফাই। তখনও বলেছি, সোফাই এবং আমার দু’জনের সংসার আছে। আমার পক্ষে স’ন্তানসহ বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমার স’ন্তান না থাকলে রাজি হতাম। এরপর আরও দু’বার প্রস্তাব এলে না করেছি।” যে ফোন ব্যবহার করে সোফাই সর্দারের সঙ্গে রিমা যোগাযোগ রাখত সেটি ঘটনার পরপরই চালকলের কর্মী আনু মালার মাধ্যমে তার কাছে ফেরত পাঠায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই শি’শুর মৃ’ত্যুর ঘটনায় তাদের মা রিমা বেগম ওরফে লিমার আ’দালতে দেওয়া জ’বানব’ন্দি এবং পুলিশের জি’জ্ঞাসাবাদে এ ঘটনার আদ্যোপান্ত তার জবানিতে জানা যায়। জ্বরের সিরাপ খেয়ে দুই শি’শু মা’রা গেছে- শুরুতে এমন খবরে দেশব্যাপী তোলপাড় হয়েছিল। পরে পুলিশ জানায়, সিরাপ নয়, মায়ের দেওয়া বি’ষ মাখানো মিষ্টি খেয়ে মর্মন্তুদ ওই জোড়া মৃ’ত্যুর ঘটনা ঘটে। মাকে গ্রে’প্তার করা হয় এবং বিস্ময় সৃষ্টি হলেও সামাজিকমাধ্যমে অনেকে মহিলাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান।

তবে দুই শি’শু ইয়াছিন ও মোরসালিনের মা কী পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছিলেন তা অজানা ছিল। চ’রম অর্থক’ষ্ট, ঋ’ণের চা’প, স্বামীর অক্ষমতা ও ভালো জীবনের নিশ্চয়তার প্রলোভনের তীব্র চা’পে ছিলেন সেই মা। রিমাকে বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে তার দুই স’ন্তানকে হ’’ত্যা করার ছক করে চালকলের সর্দার সোফাই। সমাজের পিছিয়ে পড়া জীবনসংগ্রামী নারীকে ফাঁ’দে ফেলার টোপটা ভালোভাবে দিতে পেরেছে ‘সর্দার’। অ’সুস্থ বাচ্চাদের নিয়ে যখন হাসপাতালে রিমা তখনও সোফাই সর্দার গিয়ে তাদের দেখভালের নাটকটাও ভালোমতো সেরেছে।

দুই শি’শুর বাবা দৃষ্টিপ্রতিব’ন্ধী ইসমাইল হোসেন সুজন সমকালকে বলেন, ‘সিলেটে ইটভাটায় ছোটখাটো কাজ করতাম। ছেলের মৃ’ত্যুর সংবাদ শুনে গ্রামে আসি। এক দিন যাওয়ার পরই হঠাৎ রিমা জানায়, তার মোবাইল হা’রিয়ে গেছে। এরপরই কেন যেন আমার স’ন্দেহ হয়। মোবাইল কোথায় আর ছেলেদের আসলে কী হয়েছে এটা না জানালে আত্মহ’’ত্যা করব বলে জানাই। তার এক দিন পরই রিমা জানায়, মোবাইল সোফাই সর্দারের কাছে রয়েছে। তখন স্থানীয় চেয়ারম্যানকে ঘটনা জানাই। তারা প্রশাসনের লোক এনে রিমাকে জি’জ্ঞাসাবাদ করলে আসল ঘটনা বের হয়ে আসে।’

রিমা স্বী’কারোক্তিতে জানিয়েছেন, এক যুগ আগে পারিবারিকভাবে আশুগঞ্জের ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় তার। তার অজান্তে রিমার মা এই বিয়ে ঠিক করেছিলেন। বিয়ের পর জানতে পারেন স্বামীর দুটি চোখেই দৃষ্টি নেই। তেমন কোনো ধরনের কাজকর্মও করতে পারেন না। বিয়ের ১৫ দিন পর বাবার বাড়িতে রিমা গেলে মাকে জানিয়ে দেন, ওই সংসার চা’লানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন রিমার মা বলেন, ‘ঝি গো, আমরা গরিব, সংসার চা’লানোর চেষ্টা করো।’ পরবর্তী সময়ে ইসমাইল তার চাচাত ভাইকে নিয়ে রিমাকে হাত-পা ধরে বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর ইসমাইলের মা-বাবা, ভাই-বোন রিমার সঙ্গে খা’রাপ ব্যবহার করতে থাকেন।

রিমা ও ইসমাইলকে আলাদা করে দেন। ভাগে ইসমাইল তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া আধা শতাংশ জমি বিক্রি করে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পান। বিয়ের এক বছরের মাথায় রাইস মিলে কাজ নেন রিমা। কাজ করে স্বামীর জমি উ’দ্ধার করেন। তবে অনেক ঋ’ণের বোঝায় চা’পা পড়েন। বিয়ের দুই বছরের মাথায় বড় ছেলের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় রহিম। জন্মের দুই দিনের মাথায় সে মা’রা যায়। অ’সুস্থ শরীর নিয়ে আবার কাজে যোগ দেন রিমা। স্বামীর বিক্রি করা আধা শতক জমি আবার ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর দ্বিতীয় স’ন্তান ইয়াছিনের জন্ম হয়। এরপর দেড় বছরের মাথায় তৃতীয় পুত্র মোরসালিনের জন্ম। রিমার জ’বানব’ন্দি, ‘অ’সুস্থ শরীর নিয়েই টানা সাত বছর কাজ করছি।’

দুই স’ন্তানের মা আরও জানান, দীর্ঘ সময় তিনি একাই সংসার চা’লিয়ে নিচ্ছেন। স্বামীকে ঘরে প্রস্রাব-পায়খানা করাতে সহায়তা করতেন রিমা। এরপর আগের কর্মস্থল ছেড়ে এক সময় এস আলম রাইস মিলে কাজ শুরু করেন তিনি। সংসার চালাতে ক’ষ্ট হতো। অনেক ঋ’ণ তোলেন। মাসে ১০ হাজার টাকা কিস্তি। সঞ্চয় দিতে হতো এক হাজার টাকা। এস আলম মিলে গিয়েই সোফাই সর্দারের সঙ্গে পরিচয় হয়। দুই মাস পার হওয়ার পরই সোফাই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। দু’বার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর সোফাই তাকে সুন্দর জীবনের লোভ দেখান। স্বামীর অক্ষমতা এবং ক’ষ্টকর জীবন থেকে মুক্তির জন্য সোফাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। একটানা সাত দিন বিশ্বরোডে আবাসিক হোটেলের তৃতীয় তলায় সোফাই ও রিমা একসঙ্গে ছিলেন। রিমা জানান, দু’জনের মধ্যে ফোনে কথা হতো। হোটেলে যেতে কখনও রাজি না হলে সোফাই মারতো। ভালোবেসে সে একটি শ্যাম্পু, একটি লোশন, এক জোড়া জুতা, দুটি কাঁকড়া ব্যান্ড ও ক্রিম উপহার দিয়েছে।

রিমা আরও জানান, চলতি মাসের ৭ তারিখ সোফাই তাকে ফোন করে পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দেন। শাশুড়ি বাড়ি নেই জেনে রিমাকে মিষ্টির পলিথিন দিয়ে যান সোফাই। এও বলেন, দুই স’ন্তানকে বি’ষ মাখানো মিষ্টি খাওয়ানোর পর পথের কাঁটা শেষ হয়ে যাবে। রিমাকে ৫টি মিষ্টি দেন সোফাই। এরপর আবারও ফোন করে রিমার শাশুড়িকে তার কাছে পাঠাতে বলেন। শাশুড়ি যাওয়ার পর রিমার বিলের ২ হাজার টাকা তার হাতে দেন। টাকা নিয়ে ফেরার পর দুই ছেলের জন্য নাপা সিরাপ আনতে শাশুড়িকে ফার্মেসিতে পাঠান রিমা। এরপরই খালি বাসায় দুই ছেলেকে সোফাই সর্দারের নির্দেশ মতো বি’ষ মেশানো মিষ্টি খাওয়ানো হয়। এরই মধ্যে শাশুড়ি ফিরলে তাদের নাপা সিরাপ খাওয়ানো হয়।

সোফাই সর্দার তাকে শিখিয়ে দেন বি’ষ মাখানো মিষ্টি খাওয়ানোর পর দুই ছেলের মৃ’ত্যুর কারণ হিসেবে জ্বরের ও’ষুধের কথা বলতে। নাপা খাওয়ানোর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে বমি শুরু করে দুই স’ন্তান। ওদের মাথায় পানি ঢালা শুরু করেন। এরপর স’ন্তানদের ‘মইনুল ডাক্তারের’ দোকানে নিয়ে যান। মইনুলের পরামর্শে আশুগঞ্জ উপজে’লা স্বা’স্থ্য কমপ্লেক্সে রিমা তার দুই স’ন্তানকে ভর্তি করেন। আসল ঘটনা গো’পন করে চিকিৎসককে জানানো হয়, নাপা খাওয়ার পর থেকে দুই শি’শু অ’সুস্থ। জরুরি বিভাগ থেকে বলা হয়, ‘টকমিশ্রিত পানি খাওয়ালে’ ঠিক হয়ে যাবে। এরপর হাসপাতাল থেকে দুই স’ন্তানকে বাসার দিকে নিয়ে যান রিমা ও তার শাশুড়ি। ছোট ছেলে পথে পানি চাইলে শাশুড়ি তা দেন। পানি খেয়েই সিএনজি অটোরিকশার মধ্যে নিথর হয়ে যায় ছোট ছেলে। বাড়িতে ফিরে বিছানায় শোয়ানোর পর সে নিস্তেজ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, ঘটনার দিন সোফাই সর্দারের সঙ্গে ১৫ বার ফোনে কথা বলেন রিমা। ফোন কলের সূত্র ধরেই পুলিশ ত’দন্ত শুরু করে। এরপরই হ’’ত্যা পরিকল্পনার কথা বেরিয়ে আসে।পুলিশের অপর এক কর্মকর্তা জানান, দুই শি’শুর ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। যে ফার্মেসি থেকে নাপা সিরাপ কেনা হয়েছে সেখান থেকে আটটি নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে ক্ষ’তিকর কোনো উপাদান পায়নি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।ইসমাইল হোসেনের দা’য়ের করা মা’মলায় সোফাইকে আ’সামি করা হয়। পুলিশ তাকে এখনও ধরতে পারেনি।