কেন জেনারেল মইন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি?

| আপডেট :  ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ওয়ান-ইলেভেনের নায়ক জেনারেল মইন ইউ আহমেদ প্রে’সিডেন্ট হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধিবাম। সহকর্মীরা আপত্তি তুললেন। এক পর্যায়ে জেনারেল মইন গেলেন ভোটে। ২০০৭ এর আগস্টে তিনি ৩০ জন জেনারেলকে নিয়ে মিটিং করলেন। জেনারেলদের নিয়ে ভোটাভুটিতে গেলেন। ২৮ জন না বললেন। মাত্র দুইজন উনার পক্ষে থাকলেন।

সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গেল তার আর প্রে’সিডেন্ট হওয়া সম্ভব না। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন তৎকালীন প্রে’সিডেন্টের সা’মরিক স’চিব লে. জেনারেল (অব.) আমিনুল করিম চৌধুরী। অতি সম্প্রতি আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক কনক সারোয়ারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল করিম ১/১১ কীভাবে আসলো তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

১/১১-এর প্রাক্কালে তিন বাহিনীর প্রধানকে বঙ্গভবনে ঢোকার জন্য রাস্তা করে দিয়েছিলেন এই মর্মে যে অ’ভিযোগ রয়েছে তার বি’রুদ্ধে তা তিনি খোলাসা করেছেন। বলেছেন, ১/১১-এর দিন ল’ অ্যান্ড অর্ডার কমিটির মিটিং চলছিল। এবং সেদিন বিকালে আমাদের ক্যাবিনেট মিটিং হওয়ার কথা ছিল। মিটিং চলা অবস্থায় প্রে’সিডেন্টের এডিসি আমাকে বললেন, আ’র্মি চিফ আপনাকে খুঁজছেন। আমি অফিসে এসে রেড ফোনে জেনারেল মইনের সাথে কথা বলি।

তিনি বললেন, জাতিসংঘ থেকে একটা চিঠি এসেছে। তুমি প্রে’সিডেন্টকে বলো। অন্য দুই বাহিনীর প্রধানসহ আমরা আসছি। প্রে’সিডেন্টের কাছে গেলাম। কেবিনেট অ্যাডভাইজার রুহুল আলম চৌধুরীও ওখানে ছিলেন। তিনিও একই কথা বলছেন। আসতে বললেন সবাইকে। এয়ারফোর্স ও নেভাল চিফকেও বললাম আসতে। উনারা আসলেন। গেটে মিলিটারি সেক্রেটারি কোনোদিন যায় না। মিনিস্টার, জাস্টিসদের, বাহিনীর গাড়ি এলে রিসিভ করে- এটাই প্রটোকল। কিন্তু আমি কোনোদিন যাইনি।

প্রে’সিডেন্টের পারমিশনেই তারা বঙ্গভবনে যান। আর সে’নাবা’হিনীর প্রধান প্রায়শই আসতেন। আমি ইয়াজউদ্দিন সাহেবকে বলেছিলাম, ওদের এতো ডাকবেন না। সে’নাবা’হিনী একটা টাইগারের মতো। আমার ফিলোসোফি হচ্ছে, আ’র্মিদের রাজনীতিতে কখনোই ইন্টারফেয়ার করা উচিত নয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহে তিনি আসতেন। আমি ভেবেছিলাম নরমাল কেস।

তিনি আরও বলেন, ৭ তারিখে সে’নাবা’হিনীর প্রধান বঙ্গভবনে এসেছিলেন। প্রে’সিডেন্টের সঙ্গে তিনি এক্সক্লুসিভ মিটিং করেন সেদিন। আমাকে সেই মিটিংয়ে ডাকা হয়নি। মিটিং শেষে তিনি খুশি ছিলেন বেশ। আমার সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি বললেন, আমিন প্রে’সিডেন্ট তো আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা নিতে বললেন। বলেই তিনি চলে গেলেন। আমি সে কথাটা সংশ্লিষ্ট সকলকে জানিয়েছিলাম, দেশের ক্ষ’তি হয়ে যাবে।সে সময় ডিজিএফআই-এর রিপোর্টেও বলা হতো, দেশে একটা ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করা উচিত। ক্যা’ন্টনমেন্ট থেকেও ইন্ডিকেশন পাচ্ছিলাম।

তখন উপ-নির্বাচন হয়ে গেছে। বিএনপির ১৯ জন বিনা প্রতিদ্ব’ন্দ্বিতায় জয়ী হন। আমি বললাম, আপনারা সমঝোতা করেন, নির্বাচন বাতিল করেন, না হলে অনেক বড় ক্ষ’তি হয়ে যাবে। নির্বাচন স্থগিত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন পাঠানোর কথা ছিল, কিন্তু প্রে’সিডেন্ট রাজি না থাকায় তা আর পাঠানো হলো না।

জেনারেল করিম বলেন, প্রে’সিডেন্ট যখন চিফ অ্যাডভাইজার হলেন তার কয়েকদিন পর দুই পার্টিকে ডাকা হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এসেছিল। তাদের বলা হলো, পলিটিকাল প্রসেস এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। সেদিন রাত ১২ টা, ১টার দিকে এডিসি ফোন করে বললেন, স্যার আপনাকে প্রে’সিডেন্ট ডাকছেন।

দ্রুততার সাথে যাওয়ার পর তিনি বললেন, কাল থেকে আ’র্মি মোতায়েন হবে। আমি বললাম, কিছুক্ষণ হলো খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা দলবল নিয়ে চলে গেছেন। তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। আমি রেফারেন্স দিয়ে বললাম, এটা মনে হয় ঠিক হবে না। আপনি ক্যাবিনেট মিটিং ডাকেন। প্রে’সিডেন্ট বললেন, দ্যাটস ফাইনাল ফর মি।

তিনি বলেন, আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি, এটা পলিটিক্যালি সমাধান হোক। এখানে কোনোভাবে আ’র্মি জড়িয়ে না পড়ুক। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসছে না, কীভাবে তাদের আনা যায় এ নিয়ে আলোচনা চলছিল। এরই মাঝে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ফোন দিলেন, বললেন, আমিন তুমি এসব কাজে বেশি বাড়াবাড়ি করো না। আমি বললাম, প্রে’সিডেন্টের সাথে তো আমাকে থাকতেই হবে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাথে বৈঠক চলছে। দেড়টার সময় আমরা ঐক্যে পৌঁছালাম। আওয়ামী লীগ রাজি হলো যে- তারা নির্বাচনে আসবে। বিএনপি বললো, আমরা আওয়ামী লীগের কথা বিশ্বাস করি না। রাতের মধ্যে বলতে হবে, তারা নির্বাচনে আসবে। এরপর রাতেই জলিল সাহেব ভিডিওতে বললেন, নির্বাচনে যাবেন। পরদিন সকালে সব টিভিতে স্ক্রল করা হলো। আমরা সকলে খুশি হলাম।

জেনারেল মইনের চিঠির বি’ষয়ে তিনি বলেন, এটা একটা ভুয়া চিঠি ছিল। পরে আমি অরজিনাল কপি দেখেছি । পার্থক্য ছিল শুধু- সে’নাবা’হিনী প্রত্যাহার করা হবে এটা লেখা ছিল না। এই এক্সকিউজ দিয়েই ইমার্জেন্সি দেয়া হয়।

১/১১ কেন সফল হলো না?

এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেনারেল মইন আসলে বুঝতে পারছিলেন না কি করতে হবে। আপনার কোনো লক্ষ্য না থাকলে, কোনো ভিশন না থাকলে, ডিরেকশন না থাকলে আপনি একটা স্টেট চালাতে পারেন? কয়েক দিনের মাথায় একজন আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, প্রফেসর জিল্লুর রহমান খান, উনি আমার বাসায় দাওয়াতে আসছিলেন। তখন আমি জিল্লুর রহমান খানকে বললাম, স্যার জেনারেল মইন তো ফেইল। খান সাহেব বললেন -কি বলো? আমি বললাম, স্যার দেশ চা’লানোর মতো ক্ষমতা উনার নাই। একটা মডার্ন দেশকে চা’লানোর মতো ওই এবিলিটি নাই, ভিশন নাই। ওনার কোনো প্রজ্ঞা নাই, শিক্ষা নাই। পরে কথা শুনে বুঝলাম, জিল্লুর রহমান খান সবই জানেন। সবকিছুর খবর রাখেন। আর উনি তো নামকরা প্রফেসর।

তাহলে আমরা এক কথায় বলতে পারি, জেনারেল মইন ইউ আহমেদের অদক্ষ’তা,অযোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা, উচ্চাভিলাষের কারণে তার টোটাল ওয়ান-ইলেভেনের বি’ষয়টি ফেইল করে? হ্যাঁ, বলতে পারেন। উনার স্টাফরা ভালো ছিল না। তিনি আগে জেনারেলদের এটা ব্রিফিং করেননি।

সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনারেল আমিনুল করিম চৌধুরী বলেন, ২০০৬ এর ২৮শে অক্টোবর বায়তুল মোকাররমের সামনে লা’শের ও’পর লাফালাফির ঘটনার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও বিএনপির মহাস’চিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়াকে বঙ্গভবনে ডাকা হয়।

আলোচনার এক পর্যায়ে প্রে’সিডেন্ট বলে দিলেন, আমি চিফ অ্যাডভাইজার হয়ে যাই। জলিল সাহেব বললেন, আলহাম’দুলিল্লাহ। ধরে নেন আমা’রা মেনে নিয়েছি, কিন্তু আমাদের একটু নেত্রীর সাথে কথা বলতে হবে। এক ঘণ্টা পর জানানলেন আমরা মেনে নেব। কিন্তু আপনাদের ৫টা অপশন মেনে নিতে হবে।

ওয়ান-ইলেভেনে পার্শ্ববর্তী দেশের কোনো প্রভাব ছিল কি-না, এর জবাবে জেনারেল করিম বলেন, ১/১১-এর পর দেখলাম ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার খুব শক্তিশালী হয়ে গেলেন। প্রভাব তো ছিলই।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে প্রভাবশালী এই সে’না কর্মকর্তা বলেন, তিন বছর চার মাস আগেই তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সময়টা এমন, জেনারেল মইনকে কেউ মানছিল না। উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিল সবাই। মইন টোটালি ব্যর্থ। তার স্টার খুলে ফেলা হচ্ছিল। অনেক ক’ষ্টে তা আ’টকিয়েছি। কথাবার্তা হয়তো বেশিই বলেছি। সে’নাপ্রধান আমাকে বানানো হবে না, এসব কারণে হয়তো আমাকে আগেই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সূত্রঃ মানবজমিন