‘মিস্টার ক্রাইসিস ম্যান’ চলে যাওয়ার ৩ বছর

| আপডেট :  ৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫২ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের শুদ্ধ রাজনীতির আইকন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এই জানুয়ারি মাসেই তিনি জন্মেছিলেন, আবার এই জানুয়ারিতেই তিনি চলে গেছেন চিরদিনের মতো। ময়মনসিংহ শহরে ১৯৫২ সালের পহেলা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০১৯ সালের আজকের দিনে (৩রা জানুয়ারি) রাজধানীর ২১ বেইলী রোডের স’রকারি বাসা খালি করে তিনি চলে যান চিরদিনের জন্য। এই সময়েই তিনি আস্তানা গাড়লেন বাংলার কোটি মানুষের বক্ষস্থলে; মানুষের বুকের যে অঞ্চলে অমর মানুষের বসবাস।

মুক্তিযু’দ্ধকালীন বাংলাদেশ স’রকারের অস্থায়ী প্রে’সিডেন্ট শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের স’ন্তান ৪ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ছিলেন রাজনীতির এক অনন্য কবি। তার কবিতার কারুকার্যে আজও মোহিত বাংলাদেশ।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন গেরিলা মুক্তিযো’দ্ধা। প্রে’সিডেন্টের ছেলে হয়েও রণাঙ্গণে যু’দ্ধ করেছেন। যু’দ্ধকালীন প্রে’সিডেন্টের ছেলে হয়েও শুকনো রুটি খেয়েছেন, স্টেনগান হাতে মাটিতে বুকে ভর দিয়ে যু’দ্ধ করেছেন। ভারতীয় জেনারেল উবান স্বাধীনতা যু’দ্ধ নিয়ে তার বইয়ে যে সাদামাটা, শান্ত আর বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ যো’দ্ধা আশরাফের কথা বলেছিলেন, তিনিই বাংলাদেশের সৈয়দ আশরাফ।

থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ৬ মাস মৃ’ত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২০১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে সৈয়দ আশরাফ পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। এর আগে তার শা’রীরিক অবস্থার অ’বনতি হলে ২০১৮ সালের ৩রা জুলাই তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়। কি’শোরগঞ্জ সদর আসনের টানা পাঁচবারের নির্বাচিত সং’সদ সদস্য, আওয়ামী লীগের দুই বারের সাবেক সফল সাধারণ সম্পাদক, সাবেক এলজিআর’ডি ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নেই আজ ৩ বছর। এই ৩ বছরে রাজনৈতিকভাবে যেমনি অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছে কি’শোরগঞ্জ, তেমনি বাংলাদেশ অনুভব করছে বিরল এই রাজনীতিকের শূন্যতাকে।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃ’ত্যুতে আজও কাঁদে কি’শোরগঞ্জ, কাঁদে বাংলাদেশ। ৩ বছর পর এসেও তার জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। আওয়ামী লীগের চ’রম বিরুদ্ধবা’দীরাও বলছেন, এ এক অপূরণীয় মৃ’ত্যু। দলের ভেতরে-বাইরে জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয় এমন রাজনীতিবিদ কোনো দলেই সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। সৈয়দ আশরাফের এই কারিশমার র’হস্য আজো অজানাই রয়ে গেছে, যা তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শা’রীরিক মৃ’ত্যু সেখানে একেবারেই তুচ্ছ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কা’রাগারে ব’ন্দি থাকায় মুক্তিযু’দ্ধকালীন বাংলাদেশ স’রকারে বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা পূরণ করেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এক-এগারোতে সে’না সমর্থিত স’রকার আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রে’প্তার করলে সৈয়দ আশরাফ ওনার শূন্যতা পূরণ করেছিলেন। রাজনীতিতে দুই প্রজন্মে এমন অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়ার মতো সৌভাগ্য কেবল আওয়ামী লীগেরই হয়েছে।

স্বাধীন বাংলা স’রকারের অস্থায়ী প্রে’সিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম একজন নির্লোভ, দেশপ্রেমিক ও আত্মত্যাগী নেতা হিসেবে আমৃ’ত্যু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত স্বজন ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু হ’’ত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন খু’নি মোশতাক চ’ক্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করায় তাকে কারাজীবন বেছে নিতে হয়। আরও তিন জন সতীর্থের সঙ্গে জে’লহ’’ত্যাকাণ্ডে নুশংসতার শি’কার হয়ে জীবন দিতে হয়।

যোগ্য পিতার যোগ্য স’ন্তান হিসেবে যুক্তরাজ্যের মূলধারার রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ডাকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলেন। দেশে ফেরার পর অংশ নিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সং’সদ নির্বাচনে। ১৯৯১ সালে বিএনপির কাছে হা’রানো কি’শোরগঞ্জ সদর (তৎকালীন কি’শোরগঞ্জ-৩) আসনটি ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে রাজনীতিতে অবিস্মরণীয় প্রত্যাবর্তন হয় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের।

এই প্রত্যাবর্তনের পর একজন ভদ্র, বিনয়ী ও অজাতশ’ত্রু রাজনীতিবিদ হিসেবে দলের সবার শ্রদ্ধা ও স্নেহ কুড়াতে বেশি সময় নেননি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চ’রম ভরাডুবি ঘটলেও সৈয়দ আশরাফ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সং’সদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৭তম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এক-এগারোতে সে’না সমর্থিত স’রকার রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার নীল-নকশা নিয়ে যখন এগোচ্ছিল, বয়সের ভারে ন্যূব্জ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান একা সবকিছু সামাল দিয়ে পেরে উঠছিলেন না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল কা’রাগারে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন ‘মিস্টার ক্রাইসিস ম্যান’ খ্যাত সৈয়দ আশরাফ। সেই ক্রান্তিলগ্নে দৃঢ়চিত্ত আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে উ’দ্ধার করে শেখ হাসিনাকে মুক্ত ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। দল ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৪শে জুলাই অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৮তম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

২০১২ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় কাউন্সিলে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিলে তিনি জায়গা পান প্রেসিডিয়ামে। তখন আরেক দফা তার প্রতি নেতাকর্মীদের আবেগ অনুভূতি ও সমর্থন দৃশ্যমান হয়। ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।

টানা পাঁচবার সং’সদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সং’সদে একবারই মাত্র বি’রোধী দলের আসনে বসতে হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নেয়ার আগেই পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। বাকি তিনবারই তিনি বসেছেন সং’সদের ট্রেজারি বেঞ্চে। এই তিন স’রকারে মন্ত্রিত্ব ছাড়াও টানা দুইবার তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কি’শোরগঞ্জে নানা আনুষ্ঠানিকতায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের তৃতীয় মৃ’ত্যুবার্ষিকী পালন করা হবে। জে’লার মসজিদে মসজিদে দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।