একা গাজীপুর চালানো জাহাঙ্গীর নিজেই একা

| আপডেট :  ২২ নভেম্বর ২০২১, ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ নভেম্বর ২০২১, ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ

কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার আশীর্বাদে একাই গাজীপুর চালাতেন জাহাঙ্গীর আলম। ছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু তিন বছর পার হলেও সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নির্বাচন করেননি তিনি। দলের মহানগর কমিটির মেয়াদ দুই বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী প্রথম সভার ৩০ দিনের মধ্যে প্যানেল মেয়র নির্বাচন করার বিধান আছে। কিন্তু কয়েকজন কাউন্সিলর বারবার চাইলেও তা করেননি জাহাঙ্গীর। ফলে জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদ থেকে অপসারণ করা হলে কে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব নেবেন তা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে।

গত শুক্রবার জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে ব’হিষ্কার করা হয়। জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তি ও মুক্তিযু’দ্ধের ইতিহাস বি”কৃতির জন্য তাঁর বি’রুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। আলোচনা আছে তাঁর মেয়র পদ হা’রানো নিয়েও। এ অবস্থায় নিমিষেই গাজীপুরে জাহাঙ্গীর আলমের সব আধিপত্য যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আজমত উল্লাহ খান, আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাহিদ আহসান রাসেলের মতো নেতারা দলকে নতুনভাবে গোছানোর কাজে নেমেছেন।

গাজীপুর থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক শরিফ আহমেদ শামীম জানান, স্থানীয় স’রকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনে মেয়র ও কাউন্সিলররা দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সভার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্যানেল গঠন করার বিধান রয়েছে। তিন সদস্যের প্যানেলে দুজন সাধারণ কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত নারী সদস্য থেকে একজন নির্বাচিত হবেন। অ’সুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে মেয়র দায়িত্ব পালন করতে না পারলে বা তাঁর অনুপস্থিতিতে মেয়রের প্যানেল থেকে সিনিয়র একজন মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন। ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্যানেল মেয়র নির্বাচন করতে না পারা আইনের ল’ঙ্ঘন।

কাউন্সিলর আসাদুর রহমান বলেন, ‘দল থেকে জাহাঙ্গীর আলমকে ব’হিষ্কারের পর আমরা রবিবার স্থানীয় স’রকার মন্ত্রী ও স’চিবকে বি’ষয়টি অবহিত করে দ্রুত প্যানেল মেয়র নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানিয়েছি। তাঁরা বি’ষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।’ ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মামুন মণ্ডল বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের সভায় বারবার প্যানেল মেয়র নির্বাচনের জন্য মেয়রকে চা’প দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আইন ল’ঙ্ঘন করে প্যানেল মেয়র নির্বাচন থেকে বিরত থেকেছেন।’

৪৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম বলেন, তিনিসহ আরো তিন-চারজন কাউন্সিলর প্যানেল মেয়র প্রার্থী হয়ে প্রচারণা শুরু করেছিলেন। সিটি করপোরেশনের প্রথম সভায় তাঁরা বি’ষয়টি উপস্থাপনও করেছিলেন। কিন্তু মেয়র জাহাঙ্গীর পরের সভায় এ বি’ষয়ে আলোচনার কথা বলে নির্ধারিত সময়ে আর সভা ডাকেননি। পরবর্তী সময়ে যিনিই প্যানেল মেয়র নির্বাচনের কথা বলেছেন তিনিই মেয়রের চক্ষুশূল হয়েছেন। করপোরেশনের সভা হলেও কাউন্সিলররা বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেতেন না। তিনি নিজে কথা বলে তড়িঘড়ি সভা শেষ করতেন।

জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম জানান, প্যানেল মেয়র না থাকায় পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে এ বি’ষয়ে ম’ন্ত্রণালয়ই সিদ্ধান্ত নেবে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানান তিনি। গতকাল করপোরেশনের অফিসে আসেননি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সারা দিন বাসায় ছিলেন বলে জানা গেছে। মহানগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আতাউল্লাহ ও মতিউর রহমান

জাহাঙ্গীর আলমকে ব’হিষ্কারের পর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল ও মতিউর রহমান। গাজীপুর-২ আসনের সং’সদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেলের অনুসারীরা চাইছেন মতিউর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করতে। মতিউর প্রয়াত সং’সদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারের ছোট ভাই।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ শূন্য হলে তিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বিভিন্ন সময় স্থানীয় বাস্তবতার কারণে দুই বা তিন নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককেও দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে গতকাল পর্যন্ত এ বি’ষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অনেক সময় কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকেও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। তবে গাজীপুরের বি’ষয়ে এখনো কেন্দ্রীয় কমিটি কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।

মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি
আওয়ামী লীগের জে’লা ও মহানগর পর্যায়ের কমিটির মেয়াদ তিন বছর। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন হয় ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর। সেই কমিটিতে টঙ্গী পৌরসভার সাবেক মেয়র আজমত উল্লাহ খান সভাপতি ও জাহাঙ্গীর আলম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। দুই বছরের বেশি সময় ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে।

জাহাঙ্গীর এখন একা
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, গাজীপুর-১ আসনের সং’সদ সদস্য আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর-২ আসনের সং’সদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল গাজীপুরের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকলেও এত দিন যেন জাহাঙ্গীরের আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর জামানা শেষ হওয়ার ইঙ্গিত এখন স্পষ্ট। ফলে দলেও চলছে নতুন হিসাব-নিকাশ।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৫টি জাহিদ আহসান রাসেলের নির্বাচনী এলাকায় এবং ১৮টি আ ক ম মোজাম্মেল হকের নির্বাচনী এলাকার মধ্যে পড়েছে। জাহাঙ্গীর আলমকে ব’হিষ্কারের পর এই তিন নেতা সমঝোতার মধ্য দিয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগকে পরিচালনা করতে চাইছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে এমনটা জানিয়েছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলেন, ২০১৩ সালে আজমত উল্লাহ খানকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু তিনি বিএনপির প্রার্থী আব্দুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। এর পেছনে জাহাঙ্গীর আলমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন আজমত উল্লাহর কর্মী-সমর্থকরা। সেই নির্বাচনের পর থেকে দুই নেতার বি’রোধ ছিল। ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর জাহিদ আহসান রাসেলের অনুসারীদের সঙ্গেও এক ধরনের দূরত্ব বাড়ে। দলীয় নেতাদের মধ্যে এসব মেরুকরণে কোনো পক্ষ নেননি মুক্তিযু’দ্ধবি’ষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তবে এবার জাহাঙ্গীরকে ব’হিষ্কারের পর সব পক্ষই খুশি।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান বলেন, নিজস্ব কিছু লোক নিয়ে চলতেন জাহাঙ্গীর। দলের নেতাকর্মীরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। তিনি ব’হিষ্কার হওয়ায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে। আওয়ামী লীগের পুরনো, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা এখন ঐক্যবদ্ধভাবে দলকে এগিয়ে নেবেন।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা। মতিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরকে সরিয়ে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। জাহাঙ্গীর ছাড়া গাজীপুরের অন্য গুরুত্বপূর্ণ সব নেতা ঐক্যবদ্ধ আছেন। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি। আমাদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব নেই, হবেও না। এখানে অনেক ভালো নেতা আছেন। তাঁদের নেতৃত্বে সংগঠন এগিয়ে যাবে।’

এরই মধ্যে জাহাঙ্গীরের অনুসারীরা বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হা’রানোর ভ’য়ে আছেন। গতকাল ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনিরের সমর্থকদের সঙ্গে প্রতিপক্ষের সং’ঘর্ষে একজন আ’হত হয়। সুত্রঃ কালের কন্ঠ