শুভ জন্মদিন: বাংলাদেশের মুকুটমণি

| আপডেট :  ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৭:০৮ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:১৬ পূর্বাহ্ণ

হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নামক বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় বিজ্ঞাপন। পাকিস্তানের বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাংবাদিক এবং উন্নয়ন পরামর্শক জাইঘাম খান পাকিস্তানের ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় ‘দ্য বাংলাদেশ মডেল’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ করেছেন, যেখানে তিনি পাকিস্থানকে উন্নয়ন করতে হলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

তারও পূর্বে এক টেলিভিশন টকশোতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের উন্নয়ন যদি ঘটাতে চান, সুইডেনকে না দেখে বাংলাদেশের দিকে তাকান; পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মতো বানান।’

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির পিতার জীবনাদর্শ তথা মুজিববাদকে ধারণ করে তারই স্বপ্নের সোনারবাংলা বিনির্মাণে নিয়ত কাজ করে চলেছেন। ১৯৭০ সালে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার। সে জন্যই হয়তো স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা বলেছিল—আগামী ১০০ বছরের মধ্যেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক হাজার ডলার ছাড়াবে না। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ২২৭ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ দিয়ে প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার হিসেবে প্রায় সাড়ে ১১ মাস সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশ উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও করোনাকালীন বাস্তবতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা এশিয়ার সর্বোচ্চ।

২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ শতাংশ। বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭৩ বছর, মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭৫ বছর এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৭১ বছর। করোনাকালীন কঠিন সময়েও সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছে। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বেরেছে; করোনা অতিমারির মধ্যেও সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট তিন হাজার ৮৭৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের (৩৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন) পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।

উন্নয়নের বিস্ময় বাংলাদেশে অনেক বড় বড় প্রকল্প চলমান রয়েছে, বড় বড় ফ্লাইওভার করা হয়েছে, মেট্রোরেল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিতের পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা দূরদর্শী নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রকাশ, বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মানযোগ।

বিদ্যুৎ উন্নয়নে অসামান্য সাফল্য এসেছে, ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, বর্তমানে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয় হয়েছে এবং ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি-বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় মনে করেন—‘কাউকে অনুকরণ করে নয়, নিত্য-নতুন উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে নিজের আত্নপরিচয় তুলে ধরবে।’

তাইতো আইটি খাত এখন বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি। আইটি খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে ২০১৮ সালেই। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো ২৪ লাখ, বর্তমানে ১১ কোটি ৭৩ লাখ ১০ হাজার। বিটিআরসির তথ্যমতে, বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৭ কোটি ৫২ লাখ ৭০ হাজার। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল নিয়ে করোনা অতিমারির মধ্যেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে।

করোনা সংকট মোকাবেলায় ‘বৈঠক’ ‘সুরক্ষা, প্রবাসবন্ধু, টেলি-হেলথ সেন্টার, একদেশ, ফুড ফর নেশন, এডুকেশন ফর নেশন, করোনা ট্রেসার বিডি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় কল সেন্টার ৩৩৩ ডায়াল করলেই সরকারি সেবা, ত্রাণ ও তথ্য মিলছে; ৯৯৯ এ মিলছে জরুরি সেবা, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ১০৯ এবং ১০৬ ডায়াল করলেই দুদকের জরুরি সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণেই দক্ষতার সঙ্গে মহামারি করোনা মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে এবং বিশ্বের বড় বড় দেশকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ প্রথম সারির দেশ হিসেবে কোভিড-১৯ এর টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে এবং দ্রুত গতিতে টিকাদান কর্মসূচি এগিয়ে চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারী ব্যাংক গোল্ডমান স্যাকস মনে করে—নেক্সট ইলিভেন এর ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময়। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) ‘ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক লিগ টেবল ২০২১’ নামের এক রিপোর্টে পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি।

বর্তমানে বাংলাদেশ ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা গবেষণা সংস্থা ‘ক্যাপিটাল ইকনোমিকস’ বাংলাদেশকে এশিয়ার নতুন টাইগার হিসেবে অভিহিত করেছে।

‘ম্যালিস টুওয়ার্ডস নান?’ শিরোনামে বিখ্যাত এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না ইনস্টিটিউটের গবেষক ডানকান বারটলেট লিখেছেন, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ পররাষ্ট্রনীতিতে তার কন্যা শেখ হাসিনা আস্থা রেখেছেন। বারটলেটের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে যেমন ভারতের সম্পর্ক ভালো, ঠিক তেমনি চীন, ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো। তিনি মনে করেন, এটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক মুনশিয়ানার পরিচয় বহন করে।

ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে দেশটিতে সহায়তা পাঠানো ৪০টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। গত ১৮ মে ভারতকে ২ হাজার ৬৭২টি বক্স অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ ও সুরক্ষা সরঞ্জাম দিয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে ৬ মে ভারতকে রেমডেসিভিরের ১০ হাজার শিশি দিয়েছে দেশটি। শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে ২০ কোটি ডলার প্রদান করে পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

আইএমএফের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সুদানকে ৬৫ কোটি টাকার সমান ‘ঋণ মওকুফ’ সুবিধা দিয়েছে। আর এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তির জানান দিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি এই শক্তি ব্যবহার করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কও গভীর করছে।

প্রতিনিয়ত পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়েছেন শেখ হাসিনা। টানা ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি এবং টানা তৃতীয় মেয়াদসহ মোট ৪ মেয়াদের সফল প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার, সম্মাননা ও স্বীকৃতি নেহাত কম নয় তার।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস সাময়িকীর করা তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ২৬তম স্থানে এবং ২০২০ সালের তালিকায় ৩৯তম স্থানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পিপলস অ্যান্ড পলিটিকস-এর বিশ্বের সবচেয়ে সৎ পাঁচজন সরকারপ্রধানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন তিনি। এছাড়া ২০১৪ সালে এশিয়ার প্রভাবশালী শীর্ষ ১০০ ব্যক্তির তালিকায় ২২তম অবস্থানে ছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ফরেন পলিসির বিশ্বের শীর্ষ ১০০ চিন্তাবিদের তালিকায় ‘প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা’ ক্যাটাগরিতে ১০ জনের মধ্যে নবম স্থানে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার প্রশংসা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আমি আনন্দিত যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে তার সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। একাত্তরে যে দেশটার জন্ম হল—তারা আজ পাকিস্তানকে ফেলে কোথায় এগিয়ে গেছে! আজ কোথায় বাংলাদেশ, আর কোথায় পাকিস্তান!’

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় ছিল পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া’ ম্যাগাজিন বাংলাদেশের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে। এতে পূর্ণ পৃষ্ঠাব্যাপী শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে শিরোনাম করেছে ‘Fifty Years of Bangladesh-The Rising Sun!’ (বাংলাদেশের ৫০ বছর—উদীয়মান সূর্য!)।

দেশরত্ন শেখ হাসিনা ভিশন-২০২১ দিয়েছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যম বাংলাদেশ আধুনিক এবং উন্নত দেশে পরিণত হবে। তিনি বাংলাদেশের সবার প্রেরণা ও অর্জনের বাতিঘর; উন্নয়নের মডেল। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশের মুকুটমণি, উন্নয়নের অগ্রদূত দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

এম. এ. বাসার
লেখক ও গবেষক
ই-মেইল: [email protected]