পরীমণির পরিণতি ও সাবেক আইজিপির বক্তব্য

| আপডেট :  ২২ আগস্ট ২০২১, ০৮:১৮ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ আগস্ট ২০২১, ০৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

পরীমণির ঘটনাটি আমাদের সামাজিক জীবনে পচনশীলতার রূপ তুলে ধরেছে। এটি শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারী নি’র্যাতন নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামন্তবা’দী যুগের কুমারী বলি দেওয়ার প্রথাও। ভিন্ন ধর্মের অনুসারী পূর্বপুরুষদের প্রথার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারিনি। রাজশাহীর এক ইংরেজ ম্যা’জিস্ট্রেট, ভারতে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হওয়ার গোড়ার দিকের একটি ঘটনার কথা তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন, হালে তা প্রকাশিত হয়েছে।

ঘটনাটি হলো, ইংরেজ ম্যা’জিস্ট্রেট সাহেব একদিন ঘোড়ায় চড়ে সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। শহরের এক প্রান্তে বহু লোকের জটলা, উল্লাস, বাদ্যযন্ত্রের বাজনা শুনে দাঁড়ালেন। দেখলেন মঞ্চের ও’পর দেবীমূর্তি, সামনে আ’গুন জ্ব’লছে। ধা’রালো অ’স্ত্র হাতে সেখানে এক ব্যক্তি দ’ণ্ডায়মান। সিংহাসনের মতো উঁচু আসনে জমিদার বসে আছেন। দেবীমূর্তির কাছে প্রায় নিরাবরণ এক কি’শোরী দাঁড়িয়ে কাঁপছে।

খোঁজ নিয়ে ম্যা’জিস্ট্রেট সাহেব জানলেন, শহরের ওই এলাকায় কলেরার উপদ্রব হয়েছে। জমিদার ভাবছেন দেবীর কাছে কোনো অ’পরাধ হয়েছে। দেবীর ক্রোধ নিবারণের জন্য এই কি’শোরীকে ধরে এনে বলি দেওয়ার আয়োজন। কি’শোরী জমিদারের এক দরিদ্র প্রজার মেয়ে। তাকে ধরে এনে স্নান করিয়ে পট্টবস্ত্র পরিয়ে এই বলিদানের প্রস্তুতি চলছে। ইংরেজ ম্যা’জিস্ট্রেট ওই কি’শোরীর ভ’য়ার্ত মলিন মুখ দেখে শিহরিত হলেন। তখনই পুলিশ ডাকলেন। কি’শোরীকে উ’দ্ধার করলেন। জমিদার এই ইংরেজ ম্যা’জিস্ট্রেটের বি’রুদ্ধে অ’ভিযোগ তুললেন, তিনি তাদের ধর্মাচরণে বা’ধা দিয়েছেন।

কুমারী বলিদানের ব’র্বর প্রথাটি এখন বাংলাদেশে নেই। আমার মনে হয়, এই প্রথাটি নতুন রূপ ধরে আমাদের সমাজে ফিরে এসেছে। এই নতুন রূপটির উদাহরণ আছে। গ্রামের একটি ত’রুণীকে প্রথমে নানা অ’ভিযোগে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরপুরুষে আসক্ত হওয়ার) অ’ভিযুক্ত করে তার বিচারের নামে গ্রাম্য বিচার সভা বসানো। বিচারক হন গ্রামের মাতবর, ধর্মীয় নেতা এই ধরনের লোক। মেয়েটির জন্য শা’স্তি আগেই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তাকে আধা উ’লঙ্গ করে একশবার বেত্রাঘাত। এই বেত্রাঘাতে ত’রুণীর অনেক সময় মৃ’ত্যু হয়। তাকে বেত্রাঘাত করার সময় উপস্থিত দর্শকরা এক ধরনের বি”কৃত আনন্দ উপভোগ করে থাকে। স’রকারের হস্তক্ষেপে এই ধরনের ব’র্বর বিচার অনেকটা কমেছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি। গ্রামের কোনো মেয়ে সুন্দরী ও স্মার্ট হলে তাকে দোষ না করেও দো’ষী হতে হয়। একদল তার বিচারক সাজে, আরেকদল তাকে শা’স্তি পেতে দেখে বি”কৃত আনন্দ উপভোগ করে।

পরীমণির ব্যাপারেও তাই ঘটতে দেখা গেছে। পুলিশ অথবা র‌্যা’ব গ্রাম্য বিচারের মতো কোনো গ্রে’প্তারি পরোয়ানা, তল্লা’শি পরোয়ানা ছাড়া ভ’য়ানক স’ন্ত্রাসী ধরার মতো যু’দ্ধ সাজে তাকে ধরেছে। ধরার সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণির মিডিয়ার কী নর্তন-কুর্দন। গ্রামে মেয়েটির বিচারের সময় তাকে ন’গ্ন করার কাজে একদল যুবকের যেমন উৎসাহ ও উল্লাস দেখা যায়, পরীমণির চরিত্র হননের ব্যাপারে একশ্রেণির মিডিয়ার মধ্যে এই উৎসাহ ও উল্লাস দেখা গেছে। গ্রামের মেয়ের বিচার সভায় দর্শকদের চাইতে আমাদের এই একশ্রেণির মিডিয়া উন্নত রুচির পরিচয় দেখিয়েছে কি?

প্রাচীনকালের কুমারী বলি দেওয়া সামন্তবা’দী যুগের নারী নি’র্যাতন, ধনবা’দী যুগে নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে গণ্য করাকে আমাদের রাষ্ট্রশক্তি এখনও প্রথা বলে মেনে চলেছে। আমাদের সমাজও এটিকে স্বাভাবিক প্রথা হিসেবে দেখছে। যেহেতু সময় পাল্টেছে, তাই নারী নি’র্যাতনের চেহারাটা পাল্টেছে। কিন্তু নি’র্যাতনটা রয়ে গেছে। বাংলাদেশে পরীমণির ঘটনাটি তারই প্রমাণ। কোনো কোনো নব্য ধনী দেখালেন রাষ্ট্রশক্তি তাদের বা’ধ্যগত। সেই বা’ধ্যগত শক্তির সাহায্যে কত সহজে এক সম্ভাবনাময় ত’রুণীর জীবন তারা ধ্বং’স করে দিতে পারেন, তার প্রমাণ দেখালেন।

বাংলাদেশের নব্য ধনীদের কেউ কেউ একটু বেশি দাম্ভিক এবং বেশি আগ্রাসী। বিশেষ পরিস্থিতিতে বৈধ-অ’বৈধ পথে তারা অনেকেই অতি দ্রুত ধন আহরণ করেছেন বটে, কিন্তু অতো দ্রুত ভদ্রতা, বিনয়, শিক্ষাগত রুচি ও সামাজিক শ্নীলতা অর্জন করতে পারেননি। এজন্য আমাদের নব্য ধনীদের অনেকেই এডুকে’টেড, কিন্তু কালচার্ড নন। নেহরু একবার তার এক মন্ত্রীর ও’পর রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি একজন ইল্লিটারেট গ্র্যাজুয়েট।’ এই ইল্লিটারেট গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা আমাদের নব্য ধনী, মন্ত্রী, এমপির মধ্যে বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে। ক্ষমতা ব্যবহারেও যে সভ্যতা ও শালীনতা থাকে তা তাদের মধ্যে পাওয়া যায় না।

আমি দীর্ঘকাল বিদেশে থাকি। দেশ ছাড়ার সময় পাকিস্তান আমলের ঘুষখোর পুলিশ দেখেছি। কুড়ি-একুশ বছর পর দেশে ফিরে দেখেছি নতুন ড্রেসে মডার্ন পুলিশ। নারী পুলিশ অফিসারও দেখেছি। তাদের মধ্যে সততা, দেশপ্রেম ঝলকাচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু অসৎ অফিসারও যে রয়ে গেছে, পরীমণির ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে। পরীমণির চরিত্র ভালো কি মন্দ, তা আমার বিচার্য নয়। আমার কাছে বিচার্য, একজন পুলিশপ্রধান কী করে বোট ক্লাবের প্রে’সিডেন্ট হন। তার ভাইস প্রে’সিডেন্ট একজন নব্য ধনী। তার বি’রুদ্ধে এক চিত্রতারকার অ’ভিযোগ, তিনি ওই নায়িকাকে ধ”ণের চেষ্টা করেছিলেন। অ’ভিযোগ সত্য হতে পারে, নাও হতে পারে। আ’দালত তার বিচার করবে।

সেই বিচারের জন্য অপেক্ষা না করে এই নায়িকাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বং’স করার ষ’ড়যন্ত্র এঁটে ওই নায়িকাকে শিক্ষা দেওয়া হলো- দ্যাখো আমাদের শক্তি কত। রাষ্ট্রশক্তিও তোমাকে নিরাপত্তা দেবে না। বরং তারা আমাদের সহায়। পাকিস্তান আমলে পুলিশের এই বাড়াবাড়ি দেখেছিলাম। ইলা মিত্র ছিলেন কৃষক আন্দোলনের নেত্রী। পুলিশ তাকে ধরতে পারছিল না। যখন ধরতে পারল, তখন পুলিশ কাস্টডিতে থাকার সময় তাকে উপর্যুপরি ধ”ণ করে মৃ’ত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তাকে র’ক্তদানের আবেদন জানানো হলে আমিও ছাত্রজীবনে তাকে র’ক্তদানের জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম।

মুম্বাই এবং কলকাতার অনূ্যন পাঁচজন সুন্দরী চিত্রনায়িকা ধনীদের লালসার চ’ক্রে পড়ে কেউ আত্মহ’’ত্যা করেছেন, অনেকে র’হস্যজনকভাবে খু’ন হয়েছেন। মুম্বাইয়ে এক সুন্দরী চিত্রনায়িকার ঘটনা তো হুবহু পরীমণির সঙ্গে মেলে। তাকে খুবই প্রভাবশালী মাড়োয়ারিপুত্র ধ”ণের চেষ্টা করেছিলেন। মহিলা তার হাত থেকে কোনো রকমে আত্মরক্ষা করে নিজ ঘরে ফিরে তার বি’রুদ্ধে মা’মলা করেন। পরিণতি পরীমণির মতো। তাকে পুলিশ প’তিতাবৃত্তির দায়ে গ্রে’প্তার করে। পুলিশই এজন্য তার কিছু সাজানো খদ্দের দাঁড় করায়। পরে উচ্চ আ’দালতের বিচারে পুলিশপ্রধানের ষ’ড়যন্ত্র ধরা পড়ে এবং তিনি চাকরিচ্যুত হন। বর্তমান বাংলাদেশে পরীমণি এই ধরনের সুবিচার পাবে কি? আমার স’ন্দেহ আছে।

গত ১৯ আগস্টের সমকালে ‘অ’ভিযুক্তদের গ্রে’প্তার এবং গাফ্‌ফার চৌধুরীর আবেদন’ শীর্ষক এ. কে. এম শহীদুল হকের লেখাটি আমি পড়েছি। তার লেখাটি জ্ঞানগর্ভ। তিনি সাবেক আইজিপি এবং উচ্চশিক্ষিত মানুষ। তার লেখায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমার বক্তব্যই সমর্থন করা হয়েছে। আমার দুঃখ, পরীমণিকে গ্রে’প্তারের ব্যাপারে র‌্যা’বের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারটি তিনি কেন সমর্থন করতে গেলেন? সাবেক আইজি সাহেবকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করি, পরীমণির বাড়িতে যদি মিনি বার থাকা আইনের পরিপন্থি হয়, তাহলে গুলশান-বারিধারায় কত ম্যাক্সি বার আছে এবং তাদের সেই বারে কত ধরনের নৈশ পার্টি হয় এবং তাতে ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর থেকে কত সুন্দরী নর্তকী আম’দানি করা হয়, তিনি কি তা জানেন না? তাহলে পরীমণিকে ধরার আগে গুলশান-বারিধারার দিকে র‌্যা’বের চোখ পড়ে না কেন?

পরীমণির বাড়িতে সত্যই নি’ষিদ্ধ মা’দকদ্রব্য পাওয়া গেছে কি? না, তা প্ল্যান্টেড? র‌্যা’বের অনেক ঊর্ধ্বতন অফিসার যে সাধুসন্তুতি নন, তার প্রমাণ নারায়ণগঞ্জের সাত খু’ন। আর বাংলাদেশের পুলিশ সম্পর্কে মিডিয়ায় এই মাসের রিপোর্ট, ‘দুই মা’দক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দিয়ে তার ইয়াবা ও অর্থ লু’ট করেছে সাতকানিয়ার তিন পুলিশ কর্মচারী। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘শুধু ইয়াবা বিক্রি ও পা’চার নয়, সোনার বার লু’ট করাসহ নানা অ’পরাধে ঝুঁকে পড়েছে পুলিশের একশ্রেণির সদস্য। চট্টগ্রামে দুই দশকে পুলিশ সদস্যদের বি’রুদ্ধে ৩৮টি ফৌজদারি মা’মলা হয়েছে। ইয়াবা ও অ’বৈধ সোনা ব্যবসায়ে নাম পাওয়া গেছে ৫৩ জন পুলিশ সদস্যের।’

সভ্য বলে দাবিদার একটি দেশে দেখলাম, ২৮ বছরের এক ত’রুণী ফিল্ম নায়িকার বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিনা নোটিশে, বিনা গ্রে’প্তারি পরোয়ানায় হা’না দিয়ে শক্তির বড়াই কতটা দেখাতে পারে। কী করে বিচারের আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার আগে এই বাহিনী তাকে ‘রাতের রানী’ আখ্যা দিয়ে একশ্রেণির মিডিয়া-শৃগালের কাছে পা বাঁ’ধা মুরগির ছানার মতো তুলে দিতে পারে? এটা আমার কাছে এক বিস্ময়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে পুলিশি স্টেটের এই দৌরাত্ম্য দেখব, তা কোনো দিন ভাবিনি।

লন্ডন, ২০ আগস্ট, শুক্রবার ২০২১
সুত্রঃ সমকাল