ইউএনওর বাসভবনে হামলার নেপথ্যে মেয়র-প্রতিমন্ত্রীর দ্বন্দ্ব

| আপডেট :  ২০ আগস্ট ২০২১, ০১:২৬ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২০ আগস্ট ২০২১, ০১:২৬ অপরাহ্ণ

বরিশাল সদর উপজে’লা নির্বাহী কর্মকর্তার স’রকারি বাসভবনে হা’মলার নেপথ্যে বেরিয়ে আসছে বরিশাল আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের দ্ব’ন্দ্বের নানা চিত্র। তাদের একপক্ষে রয়েছেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। অপর পক্ষে রয়েছেন জে’লা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, সদর আসনের সং’সদ সদস্য এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল অব: জাহিদ ফারুক শামীম।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকেই বরিশাল আওয়ামী লীগের একক নিয়ন্ত্রণ করেন সেরনিয়াবাত পরিবার। এখনো বরিশাল আওয়ামী লীগের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সং’সদের চিফ হুইপ। তখন তার দাপটের প্রভাবে নানা বি’তর্কি’ত ঘটনার জন্ম দেন আওয়ামী লীগের কিছু বি’তর্কি’ত নেতাকর্মী। সেসব ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপকভাবে ইমেজ স’ঙ্কটে পড়ে আওয়ামী লীগ।

২০০১ সালে চারদলীয় জোট স’রকার ক্ষমতায় এলে সপরিবারে এলাকা ছাড়েন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও স’ন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জ’ড়িত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তখন বি’রোধী দলে থেকে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও জে’লা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন ডা: মোখলেছুর রহমান ও অ্যাডভোকেট তালুকদার মো: ইউনুস। আর মহানগর আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শওকত হোসেন হিরণ ও অ্যাডভোকেট আফজালুল করিমসহ অন্যরা।

বিএনপির ঘাঁটিতে তারা (আওয়ামী লীগ) তাদের সাংগঠনিক দক্ষ’তায় ২০০৭ সালের নির্বাচনে মেয়র পদে শওকত হোসেন হিরণকে বিজয়ী করতে সক্ষম হন। ২০০৮ সালের জাতীয় সং’সদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে একে একে বরিশালের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে সেরনিয়াবাত পরিবারের হাতে। জে’লা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। আর যুবলীগ থেকে মহাগর আওয়ামী লীগে অভিষেক ঘটান নিজের ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে। পাইয়ে দেন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদ।

সেই পদে থেকেই দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সিটি মেয়র নির্বাচিত হন সাদিক আবদুল্লাহ। এরপর সাদিক আবদুল্লাহ আসীন হন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। এভাবেই জে’লা আওয়ামী লীগে একক নিয়ন্ত্রণ চলে- বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর এবং মহানগর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর। তাদের নেতৃত্বের বাইরে বরিশাল আওয়ামী লীগে অন্য কিছু ভাবাও যেন অন্যায়। আস্তে আস্তে কোণঠাসা হয়ে পড়েন সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারীরা।

এরই মাঝে ২০১৮ সালের জাতীয় সং’সদ নির্বাচনে বরিশাল সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সং’সদ সদস্য নির্বাচিত হন কর্নেল অব: জাহিদ ফারুক শামীম। প্রধানমন্ত্রী তাকে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। এদিকে নেতৃত্বহারা হিরণপন্থী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিমন্ত্রীর অনুসারী হন। কিন্তু এমপি জাহিদ ফারুক শামীম সবসময় দ্ব’ন্দ্ব সং’ঘাত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তার অনুসারীরা নগরীতে কোনো ব্যানার পোস্টার টানালে মুহূর্তের মধ্যেই তা হাওয়ায় মিলে যায়। মেয়রের অনুসারীরাই প্রকাশ্যে এই কাজ করেন বলে অ’ভিযোগ প্রতিমন্ত্রীর অনুসারীদের।

সর্বশেষ ১৮ আগস্ট রাতের ঘটনাও সেই ব্যানারকে কেন্দ্র করেই। এবারের জাতীয় শো’ক দিবসে বরিশাল নগরীর সর্বত্র মেয়র অনুসারীদের শত শত ব্যানার পোস্টার দেখা গেলেও দেখা যায়নি প্রতিমন্ত্রীর কোনো ব্যানার পোস্টার। শুধুমাত্র বরিশাল সদর উপজে’লা পরিষদ কম্পাউন্ডে শো’ক দিবসের বেশ কিছু ব্যানার লাগান প্রতিমন্ত্রীর অনুসারীরা। সেই ব্যানার ছিঁড়তেই ১৮ আগস্ট রাতে মেয়রের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা থানা কাউন্সিলে গিয়ে ইউএনওর বাসভবনে হা’মলা চা’লায়।কারা ছিলেন সেই হা’মলায়, কার নির্দেশে ব্যানার ছিঁড়তে গেছেন তারা? সব চিত্র উঠে এসেছে ইউএনওর বক্তব্য এবং সিসি টিভির ফুটেজে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের ছয় কাউন্সিলর প্রতিমন্ত্রীর অনুদানের চাল বিতরণ করেন। এতে ক্ষু’ব্ধ হন মেয়র। এরপর ওই ছয় কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে বিসিসির কর্মচারীদের তুলে নেয়া হয়। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন ২৩ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার, ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিচুর রহমান, ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান দুলাল এবং ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউর রহমান বিপ্লব। ওই দ্ব’ন্দ্বের জের ধরে বুধবার রাতে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী প্রতিমন্ত্রীর ছবি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করতে গেলে হা’মলা ও সং’ঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ ব্যাপারে সদর উপজে’লা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মুনিবুর রহমান বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের অফিস কম্পাউন্ডের পাশে ঘোরাঘুরি করছিলেন। তখন আনসার সদস্যরা আমাকে জানায়, বেশ কিছু ছেলে আমাদের কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেছে। এটা সিকিউর এলাকা তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এটা বলেছে। তখন তাদের আমি চলে যেতে বলার জন্য আনসার সদস্যদের বলি।

এর পরপরই জে’লা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দিয়ে রাজীব নামে এক ব্যক্তি কারো পারমিশন না নিয়ে, কারো তোয়াক্কা না করে আমার বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। আমি নিচে নামার আগেই তাদের ঘরের দরজার সামনে দেখতে পাই। সে তার পরিচয় দেয়ার পর আমি বললাম এত রাতে কী কারণে এসেছেন এখানে। তখন সে জানায় নির্দেশনা রয়েছে তাই তারা ব্যানার ছিঁড়ছে। তখন আমি বললাম এটা স’রকারি কম্পাউন্ড, এখানে স’রকারি অফিস-আ’দালত রয়েছে, আমরা স’রকারি অফিসাররা এখানে থাকি।

আর এত রাতে এখানে এগুলো শোভন নয়, কাইন্ডলি আপনারা চলে যান, কালকে যেটা করার করবেন। পার্টির যা সিদ্ধান্ত সেটা পরে বাস্তবায়ন করার অনুরোধ জানালেও সে বের হয়ে যাচ্ছে না, তো যাচ্ছে না। পরে আমি দাঁড়িয়ে থেকে তারা চলে গেলে মেইন গেট আনসার সদস্যদের সহায়তা আ’টকে দেই। এরপর আমরা উপরে বাবা মায়ের সাথে বসা। তখন হঠাৎ করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ৬০ থেকে ৭০ জন লোক এখানে আসে।

আনসার সদস্যরা ভ’য়ে দৌড়ে উপরে উঠে এসে আমাকে জানায়, স্যার আপনার বাংলোর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ জন ঢুকছে। তারা যখন আমার বাংলোর সামনে, তখন আমি ঘর থেকে বের হয়েছি। তখন একজন আমাকে পরিচয় দিলেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ হাসান বাবু। তার পাশে বহু লোকজন, সেখান থেকে একজন খুব উচ্চস্বরে আমার বৃ’দ্ধ বাবা-মায়ের নাম ধরে গা’লিগা’লাজ করছিলেন। তখন আমি তার কাছে জানতে চেয়েছি ভাই আপনার পরিচয়টা।

তিনি তখন তার নাম সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত বলে জানায় এবং বরিশাল জে’লা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দাবি করেন। এ সময় তার পাশ থেকে একজন বলছিলেন তুই পরিচয় দিয়ে কি করবি? এক সময় কথা বলতে বলতে যখন আমার পেছন দিকে লোকজন আসতে শুরু করে, তখন আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাকে ঘিরে ধরা হচ্ছে। তখন আনসার সদস্যদের ইশারা দিলে তারা আমার কাছে চলে আসে। আনসাররা বাঁশি বাজালেও যখন তারা সরছিলেন না, তখন আনসার সদস্যরা ফোর্স করছে।

তখন যে যার মতো করে দৌড়াইছে। আর তখন আমি নিজে মাহামুদ হাসান বাবুর হাত ধরে ফে’লেছিলাম এবং আনসারের হাতে তুলে দেই। তাদের বের করে দিয়ে আমাদের গেট আ’টকে দিয়েছি। তারপরে ২ শ’, তিন শ’, চার শ’ না পাঁচ শ’ আমি জানি না, বহু লোক এসে আমাদের স’রকারি গেটটাকে ভে’ঙে তচনছ করে ভেতর থেকে ঢুকে আমার ঘরের বারান্দা পর্যন্ত চলে আসে। ভাগ্যিস আমার উপজে’লার অফিসাররা চলে এসে তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা আ’টকে উপরে নিয়ে যায়। কারণ ওরা নিচতলায় ঘরের ভেতর পর্যন্ত চলে এসেছিলেন। যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্য দিয়ে না গেলে বোঝা যাবে না। সূত্রঃ নয়া দিগন্ত