‘মামা-ভাগ্নে’ চক্রের টোপে পাচার ২০০ নারী

| আপডেট :  ১৭ আগস্ট ২০২১, ০৫:০৬ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৭ আগস্ট ২০২১, ০৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

‘পাচারকারীদের হাত থেকে মেয়েকে উদ্ধারে এক মা তার নিজের জীবন বিপন্ন করে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেননি। সন্তানের প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি। র‌্যাব এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে।’ বাংলাদেশ থেকে পাচার করে ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে

নারী বিক্রির সঙ্গে জড়িত ‘মামা-ভাগ্নে’ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ কথা বলেন। গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলন হয়। ‘মামা-ভাগ্নে’ নামে পরিচিত সংঘবদ্ধ চক্রটি গত পাঁচ বছরে রাজধানীর মিরপুর, তেজগাঁও এবং গাজীপুর

থেকে ২০০ নারীকে পাচার করেছে। একেকজনকে দালালদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকায়। তাদের অধিকাংশকেই মার্কেট ও বিউটি পার্লারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল রাজধানীর পল্লবী ও মাদারীপুরের শিবচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামা-ভাগ্নে চক্রের মূল হোতা মো. কালু ওরফে কাল্লু, তার ভাগ্নে মো. সোহাগ ওরফে নাগিন সোহাগ এবং বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যেভাবে মিলল চক্রের সন্ধান :মামা-ভাগ্নে চক্রের ফাঁদে পড়ে পল্লবীর এক তরুণী চলতি বছরের জানুয়ারিতে পাচার হন ভারতে। একদিন হঠাৎ পরিবারের কাছে ফোন করার সুযোগ পান তিনি। ফোনে ওই তরুণী তাকে বাঁচানোর আকুতি জানান। বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার না পেয়ে তরুণীর মা নিজেই মেয়েকে উদ্ধারের প্রয়াস চালান। পরিচয় গোপন করে সেই পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। তাদের টোপে পড়ার ভান করে চলে যান ভারতে। তারপর সেখান থেকে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে মেয়েকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন দেশে।

গত ১৩ আগস্ট সমকালের প্রথম পাতায় ‘ব্যতিক্রমী এক মায়ের গল্প’ শিরোনামে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। গতকাল গ্রেপ্তার হয় ‘মামা-ভাগ্নে’ চক্রের মূল হোতাসহ তিনজন। তাদের গ্রেপ্তারের পর গতকাল সেই মা প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। যাতে আর কোনো মা-বাবাকে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।’

চক্রে রয়েছে ২০-২৫ জন :গতকালের সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, চক্রটির মূল টার্গেট ছিল দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণীরা। তাদের প্রতারণা ও প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে পাচার করা হতো। মামা কালু ও ভাগ্নে সোহাগের এই চক্রটিতে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২০-২৫ জনের সংশ্নিষ্টতা মিলেছে। নারী সদস্যও রয়েছে এ চক্রে। গ্রেপ্তার বিল্লাল সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচারের কাজকর্ম সমন্বয় করত। পাচার চক্রে নারী সদস্যও রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পাচারকারীরা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজ করত। প্রথম ধাপে সোহাগ ও তার সহযোগীরা তরুণীদের পাশের দেশে ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলত। এর পর তরুণী বা তরুণীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো মূল হোতা কালুর কাছে। দ্বিতীয় ধাপে কালু নিজে অথবা তার সহযোগী সোহাগ এই তরুণীদের নিয়ে যেত সাতক্ষীরা সীমান্তে সমন্বয়কারী বিল্লালের সেফ হাউজে। বিল্লাল চারটি সেফ হাউজ পরিচালনা করত।

কমান্ডার আল মঈন বলেন, তৃতীয় ধাপে এসব তরুণীকে অবৈধভাবে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে নৌ ও স্থলপথে সীমান্ত পারাপার করানো হতো এবং প্রতিবেশী দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকদিন লুকিয়ে রাখা হতো। এরপর তাদের সড়কপথে চাহিদামতো বিক্রি করে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। মিরপুর থেকে পাচার করা তরুণীটিকে বিক্রি করা হয়েছিল ভারতের পাঞ্জীপাড়া যৌনপল্লিতে।

৮-১০ বছর ধরে সক্রিয় চক্র :সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, মামা-ভাগ্নে চক্রের হোতা গ্রেপ্তার কালু ৮-১০ বছর ধরে মানব পাচারে যুক্ত। ৪-৫ বছর আগে সে কারাভোগ করেছে। তার সহযোগী ভাগ্নে গ্রেপ্তার সোহাগ ৫-৬ বছর ধরে নারী পাচারে যুক্ত। মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত সে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। সোহাগ ২০১৭ সালে মাদক মামলায় দুই বছর কারাভোগ করেছে।

গ্রেপ্তার বিল্লাল ৫-৭ বছর ধরে এ সিন্ডিকেটে যুক্ত। সে এবং তার স্ত্রী রাজিয়া খাতুন ২০১৮ সালে পল্লবী থানায় মানব পাচার মামলায় এক বছর কারাভোগ করেছে।

‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা খতিয়ে দেখবেন’ :মেয়েকে পাচারের বিষয়ে পুলিশের মিরপুর বিভাগের কাছে এক মা অভিযোগ করলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ কেন নেওয়া হয়নি- সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পুলিশ একটি পেশাদার বাহিনী। তবুও এমন কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।’ সুত্রঃ সমকাল