ছয় মাস আগেই বাবা-মা-বোনকে হ’’ত্যার পরিকল্পনা করে মেহজাবিন!

| আপডেট :  ২১ জুন ২০২১, ০৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২১ জুন ২০২১, ০৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

মা-বাবা ও বোনের প্রতি চ’রম ক্ষু’ব্ধ ছিলেন মেহজাবিন ইসলাম মুন। তাই ছয় মাস আগে তিনজনকেই হ’’ত্যার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এরপর একটি-দুটি করে ঘুমের ও’ষুধ সংগ্রহ শুরু করেন। শুক্রবার রাতে সেই ট্যাবলেট গুঁড়া করে চা, কফি ও পানিতে মিশিয়ে দেন। সেগুলো খেয়ে সবাই অ’চেতন হয়ে পড়লে শ্বা’সরো’ধে তিনজনকে হ’’ত্যা করা হয়। এ ঘটনার দুই মাস আগেও একবার তরমুজের জুসে ঘুমের ও’ষুধ মিশিয়ে পরিবারের সদস্যদের হ’’ত্যার চেষ্টা চালান মুন।

রাজধানীর কদমতলীর মুরাদপুর এলাকার লাল মিয়া স’রকার রোডের বাসায় তিন খু’নের ঘটনায় গ্রে’প্তার মুন জি’জ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর আগে শনিবার রাতে তার বি’রুদ্ধে কদমতলী থানায় হ’’ত্যা মা’মলা করেন তার চাচা সাখাওয়াত হোসেন। এতে তার স্বামী শফিকুল ইসলামকেও আ’সামি করা হয়েছে। ওই মা’মলায় গতকাল রোববার মুনকে জি’জ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রি’মান্ডে নেয় পুলিশ। চিকিৎসাধীন শফিকুলকেও এ মা’মলায় গ্রে’প্তার দেখানো হয়েছে।

পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ সমকালকে বলেন, জি’জ্ঞাসাবাদে মুন একাই তিনজনকে হ’’ত্যার কথা স্বীকার করেন। তবে তার স্বজনরা বলছেন, অর্থ ও সম্পত্তির জন্য এ হ’’ত্যাকাণ্ড। এতে শফিকুলও জ’ড়িত। এ বি’ষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মুনকে রি’মান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার স্বামীকেও আজকালের মধ্যে রি’মান্ডে নেওয়া হবে।

শনিবার সকালে নিজেদের বাসা থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করে তিনজনকে হ’’ত্যার কথা জানান মুন। পরে পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে তার বাবা মাসুদ রানা, মা মৌসুমী ইসলাম ও ছোট বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীর হাত-পা বাঁ’ধা লা’শ উ’দ্ধার করে। অ’চেতন অবস্থায় পাওয়া যায় মুনের স্বামী শফিকুল ও তাদের মেয়ে মারজান তাবাসসুম তৃপ্তিকে।

ত’দন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, পরিবারটির সদস্যদের মধ্যে জটিলতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বিয়ের আগে আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবক মুনকে প্রাইভেট পড়াতেন। এ সময় ছাত্রীর সঙ্গে তার প্রেম ও শা’রীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে ওই গৃহশিক্ষক ছাত্রীর মা মৌসুমীর সঙ্গেও অ’নৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দু’জনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ভিডিও করে রেখেছিলেন আমিনুল। সেটি হয়ে ওঠে তার হাতিয়ার। ভিডিও প্রকাশের ভ’য় দেখিয়ে তিনি মা-মেয়েকে জি’ম্মি করে অ’নৈতিক সম্পর্ক চা’লিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকি তিনি মুনের ছোট বোন মোহিনী ও তার এক আত্মীয়ের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপন করেন। এই বহুমুখী জটিলতাপূর্ণ সম্পর্কের একপর্যায়ে মুনকে শফিকুলের সঙ্গে বিয়ে দেন মৌসুমী। এতে ক্ষি’প্ত হন আমিনুল। তিনি মুনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও তার স্বামীকে দেখান। এতে মুনের সংসারে দাম্পত্য ক’লহ শুরু হয়। অন্যদিকে মৌসুমীও তখন আমিনুলের ও’পর বির’ক্ত। শেষে শফিকুল, মৌসুমী ও তার এক বোন মিলে আমিনুলকে ডেকে নিয়ে হ’’ত্যা করেন। ওই ঘটনায় মুন আ’সামি হলেও পরে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ অপর তিনজনের বি’রুদ্ধে অ’ভিযোগপত্র দেয়।

পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পড়ালেখায় ভালো ছিলেন মুন। এসএসসি পরীক্ষায় তার জিপিএ ৫ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার মা আগেই দুই মেয়েকে অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হতে বা’ধ্য করেছেন। এমনকি পরীক্ষা চলাকালেও তাকে ছাড় দেওয়া হয়নি। এ কারণে এসএসসিতে জিপিএ ৪.৮ পান মুন। কৈশোরে অসামাজিক কার্যকলাপে জ’ড়িত করায় তিনি মায়ের ও’পর ক্ষু’ব্ধ ছিলেন। আবার তার বাবা মাসুদ রানা প্রবাসে আরেকটি বিয়ে করেছেন, দুই মেয়ের ব্যাপারে তিনি কোনো মনোযোগ দেননি। মায়ের নি’র্যাতন থেকে মেয়েদের বাঁচাতে কোনো ভূমিকা না রাখায় তার প্রতিও ক্ষো’ভ জমে ছিল মুনের। আর শ্যালিকা মোহিনীর সঙ্গে অ’নৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন শফিকুল। এতে সংসার ভাঙার উপক্রম হওয়ায় ছোট বোনকেও দুনিয়া থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেন মুন। সে অনুযায়ী দুই মাস আগে প্রথমবার তিনি মা-বাবা-বোনকে হ’’ত্যার চেষ্টা চালান। সেদিন মা ও বোন ঘুমের ও’ষুধ মেশানো জুস খেয়ে অ’চেতন হয়ে পড়েন। তবে ডায়াবেটিস রো’গী হওয়ায় খেতে রাজি হননি বাবা মাসুদ। ফলে পরিকল্পনা সফল হয়নি।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তরমুজ খাওয়ার পর মা-মেয়ে এত ঘুমাচ্ছেন কেন? তরমুজ সম্ভবত পচা ছিল, তাই বি’ষক্রিয়া হয়েছে- এমন ব্যাখ্যা দিয়ে প্রসঙ্গ কাটিয়ে দেন মুন। সে ঘটনা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এত অল্প মাত্রার ও’ষুধে হবে না। হ’’ত্যা করতে হলে মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে। এ কারণে তিনি শুক্রবার দুই মিলিগ্রাম মাত্রার ৪০টি ট্যাবলেটের গুঁড়া পানীয়তে মেশান। অথচ এই ও’ষুধ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ চার মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেন।

এদিকে, মুন হ’’ত্যার দায় স্বীকার করলেও ঘটনাটি একা তার পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন স্বজনরা। তার খালা মোছা. ইয়াসমিন সমকালকে বলেন, আমিনুল হ’’ত্যা মা’মলা নিষ্পত্তির জন্য শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ২০ লাখ টাকা চেয়ে আসছিলেন শফিকুল। সেইসঙ্গে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্যও চা’প দিচ্ছিলেন। টাকা না দেওয়ায় তিনি বিভিন্নভাবে স্ত্রী ও শাশুড়িকে নি’র্যাতন করতেন।

জানা গেছে, চার বছর আগে একবার তিনি শাশুড়িকে পু’ড়িয়ে হ’’ত্যার চেষ্টা চালান। সেবার প্রা’ণে বেঁচে গেলেও গু’রুতর দ’গ্ধ হন মৌসুমী। এ ঘটনা বাইরে প্রকাশ না করতেও চা’প দেওয়া হয়েছিল। আর শ্যালিকা মোহিনীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের একটি ভিডিও শফিকুলের কাছে ছিল। সেটি প্রকাশের ভ’য় দেখিয়ে কয়েক বছর ধরে মেয়েটির ও’পর যৌ’ন নি’র্যাতন চালান তিনি। যখনই মোহিনীর বিয়ের প্রস্তাব আসত, তিনি মেয়েটিকে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে বিয়ের উদ্যোগ ভণ্ডুল করে দিতেন। দাবিমতো টাকা না পেয়ে শফিকুল এই হ’’ত্যার পরিকল্পনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি স’ন্তানকে হ’’ত্যার হু’মকি দিয়ে স্ত্রী মুনকেও এতে যুক্ত হতে বা’ধ্য করেন। মুন যে হ’’ত্যার দায় স্বীকার করছেন- এটি তার স্বামীরই পরিকল্পনার অংশ। তাকে রি’মান্ডে নিয়ে জি’জ্ঞাসাবাদ করা হলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে স্বজনরা আশা করেন।

কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর সমকালকে বলেন, শ্যালিকার সঙ্গে সম্পর্কের বি’ষয়টি পুলিশও কিছুটা ধারণা করেছে। আর সেই ভিডিওটির কথাও শোনা গেছে। তবে এখনও সেটি হাতে পাওয়া যায়নি।

‘ক্রা’ইম প্যাট্রোল’ ও মোবাইল গেমে আসক্ত ছিলেন মুন: পুলিশ জানায়, মা, বাবা ও বোনকে হ’’ত্যায় গ্রে’প্তার মুন ভারতীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ক্রা’ইম প্যাট্রোল’-এর মনোযোগী দর্শক ছিলেন। অ’পরাধবি’ষয়ক অনুষ্ঠানটির প্রতিটি পর্ব তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। সেইসঙ্গে তিনি একটি মোবাইলে অনলাইন ফোন গেমেও আসক্ত ছিলেন। অর্থের বিনিময়ে সেটি খেলতে হতো। তাতে নায়ক নানা কৌশলে শ’ত্রুদের মে’রে ফে’লে। এ ছাড়া অ’চেতন করে হ’’ত্যার কৌশল সম্পর্কে জানতে অনলাইনে প্রচুর অনুসন্ধান চা’লিয়েছেন মুন। ত’দন্ত-সংশ্নিষ্টদের ধারণা, ক্রা’ইম প্যাট্রোল দেখা, মোবাইল গেম খেলা ও অনলাইন অনুসন্ধানের মাধ্যমে পরিবারের তিন সদস্যকে হ’’ত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। এসব ব্যাপারে তাকে জি’জ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মা’মলায় যা বলা হয়েছে: তিন খু’নের ঘটনায় মুন ও তার স্বামী শফিকুলকে আ’সামি করে কদমতলী থানায় একটি হ’’ত্যা মা’মলা হয়েছে। এতে বা’দী উল্লেখ করেন, বিয়ের পর থেকেই আ’সামিরা মৌসুমীর কাছ থেকে অর্থ দাবি করত। টাকা না পেলে নানাভাবে জ্বা’লাতন করত। সেইসঙ্গে তারা সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্যও চা’প দিয়ে আসছিল। এতে রাজি না হওয়ায় তিনজনকে হ’’ত্যা করা হয়।

এদিকে, হ’’ত্যা মা’মলায় গ্রে’প্তার দেখিয়ে গতকাল মুনকে আ’দালতে হাজির করা হয়। এ সময় জি’জ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে সাত দিনের রি’মান্ডে চায় পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যা’জিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস তার চার দিনের রি’মান্ড মঞ্জুর করেন।