এবার ভ’য়াবহ অক্সিজেনের সং’কটে বাংলাদেশ

| আপডেট :  ২৬ এপ্রিল ২০২১, ০৫:০৬ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৬ এপ্রিল ২০২১, ০৫:০৬ অপরাহ্ণ

করো’নাভাই’রাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশের পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটেছে। একইসঙ্গে হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে অক্সিজেনের চাহিদা। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে দেশ ভ’য়াবহ অক্সিজেন সংকটের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখনই প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সুবিধা দিতে না পারায় অনেক মুমূর্ষু রোগী মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।

জানা গেছে, গতকাল রোববার (২৫ এপ্রিল) একটি হাসপাতা’লে একদিনে অক্সিজেনের অভাবে ৫ জন মা’রা গেছেন। ওই হাসপাতা’লে ১০ জন রোগীর অক্সিজেনের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অক্সিজেন সরবরাহ করতে পেরেছে পাঁচজনকে। এই অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতা’লে।

এদিকে আজ সোমবার থেকে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশ-ভা’রত সীমান্ত। দেশের মোট অক্সিজেন চাহিদার বড় একটি অংশ আসে ভা’রত থেকে। এই সরবরাহও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতা’লে এরই মধ্যে সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট আরো বেড়ে ভ’য়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর করো’না সংক্রমণ অনেক বেশি মাত্রায় বেড়েছে। এছাড়া করো’নার নতুন ধরন (স্ট্রেইন) অ’তি মাত্রায় সংক্রামক। ফলে রোগীদের ফুসফুস মা’রাত্মকভাবে আ’ক্রান্ত হচ্ছে। অনেকেরই অল্প সময়ের মধ্যে তীব্র শ্বা’সক’ষ্টের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে বেশি সংখ্যক রোগীকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। আর গুরুতর অ’সুস্থদের জীবন বাঁ’চাতে অক্সিজেন সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা জরুরি। বেশিরভাগ রোগীই তীব্র শ্বা’সক’ষ্ট নিয়ে হাসপাতা’লে যাচ্ছেন। তাদের হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় করো’না রোগীদের চিকিৎসায় দেশের হাসপাতালগুলোতে এখন দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১৮০ টন। এর মধ্যে বহুজাতিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘লিন্ডে বাংলাদেশ’ উৎপাদন ও সরবরাহ করছে ৯০ টন। স্পেক্ট্রা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দৈনিক গড়ে সরবরাহ করছে ২৪ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। তারপরও ঘাটতি থাকছে দৈনিক প্রায় ৬৫ টন।

এদিকে, করো’না পরিস্থিতিতে ভা’রতে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশটি বাংলাদেশে লিন্ডের কাছে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় সংক্রমণ আরও বাড়তে থাকলে বাংলাদেশেই ভা’রতের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশ’ঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপক (মানব সম্পদ) ও মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, চাহিদা তো আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। গত ছয় সপ্তাহে চাহিদা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। আর গত এক বছরে যদি বলি সেটা তিনগুণের বেশি বেড়েছে। এই চাহিদা মেটাতে আম’রা এখন শিল্পজাত অক্সিজেনের চেয়ে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।

তিনি জানান, আম’রা মূলত তরল অক্সিজেনকেই বেশি অগ্রাধিকার দিই। আইসিইউতে এ ধরনের অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন সরকারি হাসপাতাল ও বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলো আমাদের কাছে যে চাহিদা দিচ্ছে, এখন পর্যন্ত সেটা দিতে পারছি। এই মুহূর্তে যেহেতু তাদের চাহিদা একটু বেশি, আম’রা শিল্প কারখানার অক্সিজেন বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত চলছে, কিন্তু ভা’রতের মতো যদি অবস্থা হয়, তাহলে আমাদের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

সাইকা মাজেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে আমাদের দুটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট আছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন ৯০ টন অক্সিজেন উৎপাদিত হয়। আগে মেডিকেল ও শিল্পজাত অক্সিজেনের অনুপাত ছিল প্রায় ৬০:৪০। শিল্পজাত অক্সিজেনের চাহিদা আগের মতো থাকলেও মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ফলে অনুপাত হয়ে গেছে ৮০:২০।

কেমন মজুদ আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মজুদ আছে অল্পকিছু অক্সিজেন। মজুদ তো আসলে বেশি রাখা যায় না, এটা তরল জিনিস। এটা তৈরি করে ট্যাংকারে রাখতে হয়, সেখান থেকে তরলীভূত হয়ে চলে যায়। ফলে তেমন বেশি মজুদ করে রাখার সুযোগ নেই। এটা চলমান প্রক্রিয়া, উৎপাদন হবে আর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সেটা হাসপাতা’লে চলে যাবে। তারপরও জরুরি অবস্থা বিবেচনায় কিছু মজুদ করে রাখা হয়।

তিনি বলেন. ‘আসলে এখন যে সময় যাচ্ছে, মজুদ করে রাখার কোনো সুযোগ নেই। চাহিদা যেখানে বেড়ে গেছে ৪০%, সেখানে মজুদ করার সুযোগ কোথায়? আমাদের যে পরিমাণ উৎপাদন, তার থেকে বেশি এই মুহূর্তে প্রয়োজন। যা উৎপাদন হচ্ছে, সাথে সাথেই চলে যাচ্ছে হাসপাতা’লে।’

সাইকা মাজেদ আরও বলেন, সরকারিভাবে চেষ্টা করতে হবে অন্য দেশ থেকে অক্সিজেন আনা যায় কি না। টিকার মতো অন্য দেশ থেকে অক্সিজেনও আনতে হবে। আমাদের কোম্পানি তো প্রাইভেট ফার্ম, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। আম’রা এখন আমাদের সর্বোচ্চটাই উৎপাদন করছি, দেশে সংকট বাড়লেও এমনকি ভা’রতের অবস্থা হলেও এরচেয়ে বেশি উৎপাদনের সুযোগ নেই।

এদিকে ইস’লাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মক’র্তা মু’স্তাইন বিল্লাহ জানান, আগের তুলনায় অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে অনেকগুণ। সব সময় সিরিয়াল লেগে আছে। কারণ ৯ দশমিক ৮ কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটা সিলিন্ডার স্কেলিং করতে ৫০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যেহেতু এটা আনলিমিটেড নয়। আম’রা দিনে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৮৮০ কিউবিক মিটার অক্সিজেন রিফিল করতে পারি।

তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি চাহিদা ছিল। এখন ৩০ শতাংশের মতো কমেছে। তবে সবমিলিয়ে এখন যে চাহিদা আছে, তা মেটানো সম্ভব। কিন্তু যদি সংক্রমণ বাড়ে, তাহলে পরিস্থিতি ভা’রতের মতো ভ’য়াবহ আকার ধারণ করবে। যা নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।

তিনি আরও বলেন, মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় ২০ দিন আগে থেকেই ইস’লাম অক্সিজেন শিল্পজাত অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এর পুরোটাই এখন মেডিকেল অক্সিজেন। দৈনিক ২৮ হাজার ৮০০ কিউবিক মিটার অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের আছে। এরমধ্যে আম’রা নিয়মিত ২১/২২ বা ২৩ হাজার কিউবিক মিটারের মতো উৎপাদন করছি।

মু’স্তাইন বিল্লাহ বলেন, হুটহাট করে তো উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে উৎপাদন বাড়াতে হলে নতুন করে প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে। সেটা করতে গেলেও কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। নতুন করে গ্যাসের সংযোগ দিতে হবে, ব্যাংকের অর্থায়ন লাগবে, সবমিলয়ে অনেক কাজ আছে। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের প্ল্যান্ট বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে, কিন্তু সরকারের তো কোন সহযোগিতা পাওয়া যায় না।

জানা গেছে, ইস’লাম অক্সিজেন লিমিটেড নিজেদের উৎপাদনের বাইরেও প্রতি সপ্তাহে ভা’রত থেকে ৩০ টন অক্সিজেন আম’দানি করত। ভা’রতে সংক্রমণ কিছুটা বাড়তে শুরু করলে তারা ১৫ টন আম’দানি করতে পারত। কিন্তু দেশটিতে সংক্রমণের মাত্রা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছালে ভা’রত অক্সিজেন দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

অন্যদিকে স্পেক্ট্রা অক্সিজেন লিমিটেডের ঢাকা ডিপোর ডিসট্রিবিউশন অফিসার গৌতমও অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিলের চাপ বাড়ার কথা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্পেকট্রা অক্সিজেন-এর একজন কর্মক’র্তা জানান, স্পেকট্রা দৈনিক ২৫ টন মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করে। তিনি বলেন, ‘এখন চাহিদা বেড়ে গেছে। আগে আমাদের ৬০ শতাংশ যন্ত্র মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের কাজ করত। এখন সবগুলো যন্ত্র ২৪ ঘণ্টা শুধু মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের কাজেই ব্যবহার করা হয়।’

অক্সিজেনের চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৩টি নতুন উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এসব উৎস থেকে পাওয়া যাবে মোট ৭৫ টন অক্সিজেন। তবে বর্তমানে এই তিনটি প্রতিষ্ঠান মাত্র ৩৫ টন অক্সিজেন দিতে পারবে বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লি. দৈনিক ৭ টন, ইস’লাম অক্সিজেন ২০ টন এবং এ কে অক্সিজেন লি. ৮ টন সরবরাহ করতে পারবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘আগে যে অক্সিজেনের চাহিদা ছিল, তা কোভিডের সময় বাড়িয়ে দিয়েছি। গত কয়েক মাসে হুট করেই কোভিড আবার দ্বিগুণ গতিতে বেড়ে যায়। তারপরও আম’রা দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিজেন চাহিদা মেটাতে পারছি।’

তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ে, তারপরেও আমাদের সমস্ত হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা ঠিকমতো চলছে। ভা’রতের মতো অবস্থা এখনো হয়নি। যদি আমাদের রোগীর সংখ্যা কমে যায় তাহলে আম’রা অক্সিজেন ঘাটতিতে পড়ব না।

ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘বাড়তি চাহিদা পূরণে মূলত ভা’রত, চীন ও পা’কিস্তান থেকে অক্সিজেন আম’দানি করা হয়। ভা’রতে হঠাৎ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তারা অক্সিজেন দেওয়া বন্ধ করেছে। ফলে করো’না সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এই সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশ’ঙ্কা রয়েছে।’

হঠাৎ চাহিদা বাড়লে কী’ করবে সরকার? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তখন হয়তো কিছুদিনের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন উৎপাদন পুরোপিুরি বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদন করতে বলা হবে।’

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতাল বাড়ালে এবং অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও কোনো লাভ হবে না। করো’না থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বর্তমানে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে, তাতে রাজধানীতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে কী’ভাবে ম্যানেজ করা হবে তা কারো বোধগম্য নয়। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অনেক রোগী মা’রা যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘হাসপাতাল ও আইসিইউ যতই বাড়ানো হোক না কেন, কোনো লাভ হবে না। করো’না রোগের জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা। এক্ষেত্রে কেউ উদাসীনতার পরিচয় দিলে নিজে ম’রবে, পরিবার ও প্রতিবেশীদেরও মা’রবে।’

সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট