সব
আমি যে অভিনয় করবো, এরকম কোনো ভাবনা আমার ছিলো না। আমি চারুকলায় পড়াশোনা করেছি। যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখন আরণ্যক নাট্যদলে কাজ শুরু করি। বাংলাদেশের নাটকের প্রাণপুরুষ মামুনুর রশীদ আরণ্যকের প্রধান ছিলেন। তখন ইচ্ছাটা ছিলো এমন যে, মঞ্চে কাজ করবো, কিন্তু মঞ্চের পিছনে। যেহেতু চারুকলায় পড়তাম, সেট ডিজাইন, কস্টিউম ডিজাইন, প্রপস ডিজাইন এগুলো নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিলো। এবং দীর্ঘদিন ধরে এগুলোই করছিলাম। মঞ্চের সামনে এসে অভিনয় করবো, এরকম কোনো কল্পনাও আসলে ছিলো না। স্বপ্নও ছিলো না।
বাংলাদেশের এই মুহুর্তের খ্যাতিমান অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী এমনটাই বলছিলেন। সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। অভিনয় করার কোনো স্বপ্ন না থাকলেও অভিনয়ের মাধ্যমেই এলহ্ন জায়গা করে নিয়েছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের যেকোনো দর্শককে একজন পছন্দের অভিনেতার নাম বলতে বললে হয়তো প্রথমেই আসবে চঞ্চলের নাম।
দীর্ঘ সাধনায় তিনি সুযোগ করে নিয়েছেন অভিনয়ের মাঝে। এরপর নিজেকে প্রমাণ করার পালা। তিনি নামকে ছাপিয়ে দর্শকের কাছে হয়ে ওঠেন পর্দার ‘সোনাই’, ‘কালু’, ‘সোলেমান’ কখনো বা শরাফত করিম আয়না। নাটক, সিনেমা কিংবা ওয়েব ফিল্ম-সিরিজ সব জায়গায়ই তিনি শতভাগ সফল। দীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রতিমুহূর্তে নিজেকে যেমন ভেঙেছেন, তেমনি বিভিন্ন শাখায় তাঁর উপস্থিতির বাঁকবদল ছিল আয়নাবাজির মতোই।
আরণ্যক নাট্যদলে যোগ দিয়ে টানা প্রায় এক দশক মঞ্চে অভিনয়ের তালিম নেন চঞ্চল। এই অভিনেতা মনে করেন, এটা ছিল পরিবারের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ। কারণ, তিনি শুধু এই একটি কাজের পেছনেই ছুটেছেন। পরিবারের চোখে ছিল, চঞ্চল ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন। এখানে সবাই সফল হয় না। গুরু মামুনুর রশীদের লেখা ‘সুন্দরী’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন চঞ্চল। পরে দীর্ঘদিন তাঁকে নাটকের ছোট চরিত্রগুলো করতে হতো। এর মধ্য দিয়ে নিজের সেরাটা দেখানোর চেষ্টা করতেন।
এরপর বিজ্ঞাপনে আসেন চঞ্চল। চঞ্চল বলেন, ‘বিজ্ঞাপনগুলো যখন হিট হয়, তখন আশা জাগতে থাকে।’ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই রাতারাতি দেশের দর্শকের কাছে পৌঁছে যান চঞ্চল। এরপর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, সালাহউদ্দিন লাভলুসহ একাধিক পরিচালকের নাটক ও বিজ্ঞাপনের নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন চঞ্চল।
নাটকে তুমুল আলোচিত অভিনেতা চঞ্চল। বলা যায়, চঞ্চলের অভিনয়ের মধ্য দিয়েই গ্রামের নাটকগুলো দেশের দর্শকের কাছে ভিন্নমাত্রা পায়। তার কারণ ছিল, গ্রামের সব চরিত্রে শতভাগ গ্রামের মানুষের কাছাকাছি চলে যেতেন তিনি। তাঁকে আর অভিনেতা চঞ্চল মনে হতো না। এ কারণেই গ্রামের লাখ লাখ মানুষ তাঁর নাটকের সিডি কিনে দেখা শুরু করেন। ঘরে ঘরে তখন জায়গা পেত শুধুই চঞ্চলের নাটক। এমনকি পাবনার আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছেন। নাটকে তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেতা যেমন হাসিয়েছেন তেমন দর্শকদের কাঁদিয়েছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আবার বাঁকবদল আসে।
এর মধ্যেই চঞ্চল নাম লেখান সিনেমায়। প্রথম অভিনয় করেন তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় ‘রূপকথার গল্প’ সিনেমায়। সিনেমায় তাঁর অভিনয় প্রশংসা পেলেও সিনেমাটি সেভাবে সাড়া জাগাতে পারেনি। তবে প্রশংসিত। এরপর কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে যুক্ত হন ‘মনপুরা’ সিনেমায়। কারণ, নাটকে তাঁকে দর্শক যে চরিত্রে দেখে থাকেন, সেটা থেকে চরিত্রটি একদমই ব্যতিক্রম। মুক্তি পায় সিনেমাটি। এ যেন অন্য এক চঞ্চল। যাঁকে সেই সহজ–সরল ‘সোনাই’ বলে মনে হয়। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সোনাই হয়ে দেখা দেন। পুরো ব্যতিক্রম এই চরিত্রে তিনি শতভাগ উতরে যান। ‘মনপুরা’ দিয়ে চলচ্চিত্র অভিনেতা হয়ে দেশের সব দর্শকের সমাদর পান চঞ্চল। ছোট পর্দার পাশাপাশি সিনেমায়ও সমানতালে অভিনয় চালিয়ে যান।
এরপর দর্শকের সামনে আসে ওটিটি। দর্শক ওয়েব ফিল্ম সিরিজের যুগে প্রবেশ করেন। এখানেও ঘূর্ণিঝড়ের মতোই বাঁকবদল করেন চঞ্চল। বুঝেশুনে যুক্ত হন। এ জন্য তাঁকে অনেক গল্পকে ‘না’ বলতে হয়েছে। এরপর হঠাৎ চমকে দেন দর্শককে। তাঁর অভিনীত ‘তকদির’ মুক্তির পরই দর্শকের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে যায়। একে একে প্রশংসা পেতে শুরু করেন তিনি চরকির ‘উনলৌকিক’ সিরিজ, ‘মুন্সিগিরি’, হইচইয়ের ‘বলি’সহ একাধিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কাজ দিয়ে।
সর্বশেষ তার ‘হাওয়া’ সিনেমাটি দেশের সিনেমাপ্রেমিদের মধ্যে যেমন খুশির হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। তেমনই তার ‘কারাগার’ সিরিজের প্রথম পর্ব অধির আগ্রহে অপেক্ষা করাচ্ছে দর্শকদের। এ যেন বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন এক যুগের শুরু। এই সিনেমাগুলো যেমন দর্শকদের হলমুখী করছে, তেমনই নিজেদের সিনেমার উপর নির্ভরতাও বাড়ছে।
চঞ্চল বলেন, ‘আমি খুব কম সিনেমায় অভিনয় করেছি। প্রথম সিনেমা ছিলো ‘রূপকথার গল্প’, দ্বিতীয় সিনেমা হলো ’মনপুরা’। ‘মনপুরা’ খুবই হিট একটা মুভি। এক যুগ পার হয় গেলেও মানুষের মুখে মুখে এখনো আছে সিনেমাটি। সেই সময় দীর্ঘদিন পর হলে দর্শকের জোয়ার নেমেছিলো। তার আগে অনেক খরা গেছে বাংলা সিনেমায়। তারপর থেকে আমি ক্যামেরা বা মঞ্চের পিছনে নেই, আমি সামনের মানুষটি হয়ে গেলাম।’