এখানে চিকিৎসা নিতে টাকা লাগে না

| আপডেট :  ৮ মার্চ ২০২২, ০৪:০৫ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৮ মার্চ ২০২২, ০৪:০৫ অপরাহ্ণ

২০১০ সাল থেকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবার উদ্যোগ নেন আল আমিন। শেখেরচরে আল আমিন ফ্যাব্রিকস অ্যান্ড হাবিব ডায়িং। ফ্যাক্টরির সঙ্গেই এই চিকিৎসাকেন্দ্র। প্রতি রবিবার খোলা থাকে।শুরুতে এমবিবিএস ডাক্তার মাহমুদুল হাসান আরিফ বসতেন। প্রথম দিকে ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো রোগী আসত। ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা বাড়ে। শুরুতে কিছু ওষুধও দিতেন। এখনো ওষুধ কিনতে কারো সমস্যা হলে ব্যবস্থা করেন। কারো অপারেশন কিংবা বড় সমস্যা হলে নিজ খরচে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাও করান। এ পর্যন্ত ১২ হাজার মানুষ সেবা নিয়েছে। চিকিৎসাকেন্দ্রে এখন অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশাপাশি নেবুলাইজারও আছে।

সরেজমিনে একদিনঃ এক রবিবারে হাজির হলাম চিকিৎসাকেন্দ্রে। সাইনবোর্ডে লেখা—‘এখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হয়’। ডাক্তার একজন রোগীর প্রেসার মাপছিলেন। সামনে জনা চল্লিশেক মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার দেখাতে এসেছে তারা। ৬৫ বছর বয়সী আক্তার মিয়া তাদের একজন। দুই দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। বললেন, ‘ছয় বছর ধরে এখানে ডাক্তার দেখাই। ডাক্তারের হাতে যশ আছে। আমরা গরিব মানুষ। টাকা না থাকলে আল আমিন বাবায় ওষুধ কিনে দেয়। ’ মাঝবয়সী আরেক নারী বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। কাজের সূত্রে নরসিংদী থাকেন। তাঁর স্বামী রিকশাচালক।

কয়েক দিন ধরে বাচ্চাটার কাশি। তিনি বললেন, ‘বাইরে ডাক্তার দেখাইলে লাগে ৫০০ টাকা। এর ফর অষুধ। এনে (এখানে) ফ্রি। বাইরেত্তে অষুধ লয়ালামু। ’ ফিরোজা বেগমের (৮৫) বাড়ি শেখেরচর। সন্তান-সন্ততি বেঁচে নেই। একটি ছেলে ছিল। তাকে বিয়েও দিয়েছিলেন। অসুখে ছেলেটি বাঁচেনি। মানুষের কাছে হাত পেতে চলতেন। ২০২০ সালের শুরুতে জটিল রোগে আক্রান্ত হন ফিরোজা। চিকিৎসার অভাবে একসময় মানসিকভাবে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিলেন। খবর পেয়ে আল আমিন ফিরোজাকে ডাক্তার দেখালেন। হাসপাতালেও ভর্তি করাতে হয়েছিল। তাঁর পেছনে লাখ টাকা খরচ করেন। ফিরোজা বেগম এখন পুরোপুরি সুস্থ।

যেভাবে শুরুঃ শুরুতে নিজের কারখানার শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসাসেবা চালু করেন আল আমিন। কারখানার ভেতরেই তাঁদের চিকিৎসা করাতেন। একদিন ডাক্তার চাইলেন কারখানার বাইরে বসতে। গেটের সামনে একটা খোলামেলা জায়গায় বসে শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছিলেন ডাক্তার। দেখে আশপাশের লোকজনও এলো। পরের সপ্তাহ থেকে বাইরে মানুষের জন্যও সেবার ব্যবস্থা করলেন আল আমিন। বললেন, ‘অভাব এবং অসচেতনতার কারণে বেশির ভাগ সময়ই শ্রমিকরা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখাতে চান না। হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছ থেকে ওষুধ খেয়ে সমস্যা আরো বাড়ান। শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে চিকিৎসাসেবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিছুদিন পর থেকে সাধারণ মানুষও সেবা পাচ্ছে। কাজটা আমৃত্যু করে যেতে চাই। ’

চিকিৎসকরা বললেনঃ নরসিংদী সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মাহমুদুল হাসান আরিফ শুরু থেকেই এখানে রোগী দেখেছেন। বললেন, ‘এখানে কাজ করে ভালো লাগে। মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়। ’ ডাক্তারের ব্যস্ততা ও নানা অসুবিধার কারণে করোনা মহামারির সময় চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। করোনার প্রকোপ কমার পর ডা. শ্যামল দাসকে দিয়ে আবার শুরু করেছিলেন আল আমিন। ডা. শ্যামল বসতেন বৃহস্পতিবার। জমেও উঠেছিল। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি আসতে পারছেন না।

পরে আল আমিন নিয়ে আসেন নরসিংদী সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রাকিবুল ইসলামকে। এখন থেকে প্রতি রবিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগী দেখছেন ডা. রাকিবুল। ‘মানুষকে সেবা দিতে পেরে যারপরনাই ভালো লাগছে। এমন উদ্যোগের জন্য আল আমিন ভাইকে ধন্যবাদ’, বললেন ডা. রাকিবুল ইসলাম।

হাসপাতাল করতে চানঃ আল আমিন রহমানের জন্ম নরসিংদীর শেখেরচরের বাবুরহাটে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। এইচএসসি পাস করেন মাধবদী মহাবিদ্যালয় থেকে। কাপড়ের বড় কারখানা আছে তাঁর। ফ্যাশন হাউস আড়ংয়ে তাঁতের থ্রিপিস সরবরাহ করেন। একসময় বন্ধুদের নিয়ে ‘যুবনগর’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়েছিলেন।

পরে করলেন যুবনগর স্কুল। সেই স্কুল থেকে ফুলতলা পর্যন্ত আধা কিলোমিটার ইটের রাস্তা করলেন। মোশাররফ স্পিনিং থেকে ছগরিয়া মাদরাসা পর্যন্ত রাস্তার প্রশস্ততা ছিল মাত্র আট ফুট। খুবই নাজেহাল দশা। সেই রাস্তাকে ১৫ ফুট প্রশস্ত করলেন। ২০১৫ সাল থেকে প্রতি শীতে এক হাজার মানুষকে কম্বল দেন। অনেক অসহায়-অভাবী মেয়েকে এর মধ্যে বিয়েও দিয়েছেন। মাধবদীর মোল্লারচরে নানাবাড়িতে মায়ের নামে এতিমখানার ভবন নির্মাণ করেছেন। চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের অসহায় মুখ দেখে বড় কষ্ট লাগে আল আমিনের। হাসপাতালের রোগীদের ভোগান্তির গল্পগুলোও তাঁকে কাঁদায়। স্বপ্ন দেখছেন, একটি হাসপাতাল করবেন। সেখানে বিনা মূল্যে সেবা পাবে মানুষ।