বনভূমি উজাড় করলে আসতে পারে করোনার মতো আরও মহামারি

| আপডেট :  ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

সমগ্র পৃথিবীকে নানান প্রাকৃতিক দু’র্যোগ ও স্বা’স্থ্যঝুঁ’কি থেকে রক্ষা করে থাকে বনভূমি। তবে বর্তমান সময়ে বনভূমি উজাড়ের ফলে এ পরিবেশ ও জনজীবন বিভিন্ন স’মস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, প্রতি হেক্টর জমিতে কমপক্ষে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ হেক্টরে বিভিন্ন ধরনের গাছপালার সমাবেশকে বনভূমি বলে। বনভূমি উজাড় বা বন

নিধন বলতে সাধারণত আমরা বন পরিষ্কার করার জন্য বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালা কে’টে ফেলা বা পু’ড়িয়ে ফেলাকে বুঝি। অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচার যে বনভূমি ধ্বং’স করে চলছে, বনভূমি ধ্বং’স করার এ প্রক্রিয়াকে বনভূমি উজাড় বলে

আমরা জানি যে পৃথিবীপৃষ্ঠের ৩০ শতাংশ বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। বনভূমি পৃথিবীর ফুসফুস। গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং ছায়া সরবরাহের মাধ্যমে মাটিকে আর্দ্র রাখে। চারপাশের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখে।

কিন্তু যখন কোনো বন কে’টে ফেলা হয় বা পু’ড়িয়ে ফেলা হয়, তখন আর্দ্রতা কমে যায়। যার ফলে গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দু’র্যোগ, রো’গব্যাধি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট শুকিয়ে আ’গুনের সূত্রপাত ঘটে এবং তার থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বং’স হয়ে যায়। মানুষের পাশাপাশি বনভূমিতে বসবাসকারী প্রা’ণীরা ব্যাপকভাবে ক্ষ’তিগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা দুই দশক ধরে এ বি’ষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন। তাঁরা বলেছেন, মানুষ যত সীমাল’ঙ্ঘন করে বনে প্রবেশ করবে, বুনো প্রা’ণীদের হওয়া নানা রো’গব্যাধি মানবজাতিকে তত বেশি সংক্রমিত করবে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে ক’রোনাভা’ইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর একটুও অবাক হননি ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব মাতো গ্রাসোর ইকোলজিস্ট আনা লুসিয়ে তোউরিনহো। তিনি পরিবেশ ভারসাম্য বিন’ষ্ট হলে কীভাবে বন এবং সমাজ অ’সুস্থ হয়ে পড়ে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন।

তিনি বলেছেন, যখন কোনো নতুন ভাই’রাস সেটির প্রাকৃতিক আবাস ত্যাগ করে মানুষের দেহে প্রবেশ করে, তখন ভীষণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ক’রোনাভা’ইরাস সেইটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে। ক’রোনার প্রাদুর্ভাবের আগেই বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বন উজাড়ের কারণে বাদুড়ের আবাস বিন’ষ্ট হওয়া এবং সেগুলোর চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে নতুন ম’হামা’রির বিস্তার সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল।

পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারশর গবেষক আনিতা আফেল্ট তার গবেষণায় পরবর্তী মা’রাত্মক সংক্রামক রো’গের প্রাদুর্ভাব এশিয়া মহাদেশ থেকে হবে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গত ৪০ বছরে এশিয়া মহাদেশে মা’রাত্মকভাবে বন উজাড় করা হয়েছে।

প্রতিবছর যে পরিমাণ বনভূমি উজাড় হচ্ছে তার তুলনায় বাংলাদেশে বনভূমি উজাড় হচ্ছে সব থেকে বেশি। এফএওর হিসাবে, বিশ্বব্যাপী ২০০০-২০১৫ সময়কালে প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। বাংলাদেশে তা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে বছরে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বন উজাড় হয়। এ উজাড় হওয়া থেকে সংরক্ষিত বনও রক্ষা পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে পরিচিত দেশের সংরক্ষিত বন ‘সুন্দরবন’–এর বিস্তার ও ঘনত্ব কমেছে। বেস’রকারি সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণায় বলেছে, গত দুই দশকে (২০০০-২০২০) সুন্দরবনের গাছপালার পরিমাণ মা’রাত্মক হারে কমেছে। কমেছে বনের ঘনত্বও। বন উজাড় হয়ে ফাঁকা ও পতিত জমির পরিমাণ বাড়ছে। সুন্দরবন আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১ হাজার ৭৭৬ সালে বাংলাদেশ অংশে বনের বিস্তার ছিল ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার কিন্তু ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেটি এখন ৬ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ম’ন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সং’সদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বন বিভাগের উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি দ’খল হয়ে গেছে। ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এসব বনভূমি জবরদ’খল করে রেখেছেন। জমি দ’খল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে তৈরি করা হয়েছে শিল্পকারখানা।

দিন দিন জনসংখ্যা বৃ’দ্ধির চা’প, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও কৃষি সম্প্রসারণ ও বিভিন্ন দু’র্যোগ ফলে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বনভূমি কমছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃ’দ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় নিম্ন এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আ’শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় নিম্ন এলাকা সাগরের লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁ’কিতে রয়েছে সব থেকে বেশি। উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি-পানি ক্রমেই লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গ’লার কারণে নতুন নতুন অণুজীব অবমুক্ত হচ্ছে। যার ফলে সংক্রামক রো’গব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে।

বনভূমি রক্ষার্থে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিগত বছরগুলোতে প্রাকৃতিক বনের বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ, বাণিজ্যিক বাগান ও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে গাছের সংখ্যা বেড়েছে। বনভূমি সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যত্রতত্র নির্বিচার গাছ কা’টা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার অ’পব্যবহারে করে বন উজাড়কারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

কাজী ফারহা’না ইসলাম
শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়