‘টয়লেটে ঢুকিয়ে হা’ত-পা বেঁ’ধে মারের পর জ’খমে ম’রিচ লাগিয়ে দিত’

| আপডেট :  ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ০২:৪০ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ০২:৩৯ অপরাহ্ণ

‘টয়লেটে ঢুকিয়ে হাত-পা বেঁ’ধে মার দিত। মারের পর জ’খমে মরিচ লাগিয়ে দিত। দেয়ালে মাথা বাড়ি মারত। খাবার দিত কম। এইটুকু ভাত, আর এইটুকু তরকারি। আমি আর কথা বলব না। আমি শুধু বিচার চাই। আমার সঙ্গে যা করেছে, তার জন্য শা’স্তি চাই।’এভাবে কথাগুলো বলল ফারজানা আক্তার। গত রোববার বিকেলে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় বসে কথাগুলো বলে সে।

ফারজানার হাড্ডিসার শরীর। শরীরের তুলনায় পেট ফুলে আছে বেশ। মাথার চুল ছোট করে কা’টা। মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষ’তচিহ্ন। কনুইয়ে পোড়া দাগ। কানেও আছে আ’ঘাতের প্রভাব।ফারজানার চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে। সে উত্তেজিত হয়ে যখন কথা বলে, তখন মনে হয়, গর্ত থেকে চোখ দুটো বের হয়ে আসবে।ফারজানার প্রকৃত বয়স এখন কত, তা তাকে দেখে বোঝা যায় না। পাশে বসা মা বললেন, ১৭ বছর। ফারজানা প্র’তিবাদ করে বলে, এত বেশি না। বড়জো’র ১৫ বছর।

ছোট বয়সে ফারজানাকে রাজধানীর এক বাসায় কাজে দিয়েছিলেন তার মা-বাবা। ফারজানার অ’ভিযোগ, এলিফ্যান্ট রোডের ওই বাসায় সে চ’রম নি’র্যাতনের শি’কার হয়েছে। মা’রধরের সময় চি’ৎকার করলে বা কাউকে বললে তার মা-বাবাকে মে’রে ফেলার ভ’য় দেখানো হতো। তাই সে সব নি’র্যাতন সহ্য করছিল।১৭ জানুয়ারি রাতে ফারজানাকে ওই বাসা থেকে উ’দ্ধার করে পুলিশ।

ফারজানা যে বাসায় কাজ করত, সেই বাসার গৃহকর্ত্রী সামিয়া ইউসুফের (সুমি) বি’রুদ্ধে ২০ জানুয়ারি কলাবাগান থানায় মা’মলা হয়। ফারজানার বাবার করা এই মা’মলায় সাধারণ আ’ঘাত, গু’রুতর আ’ঘাত, হ’’ত্যার হু’মকিসহ বিভিন্ন অ’ভিযোগ আনা হয়।আ’সামিকে গ্রে’প্তার করে র‍্যা’ব। পরে আ’সামিকে কা’রাগারে পাঠান আ’দালত।তবে গতকাল সোমবার সামিয়া ইউসুফের জা’মিন হয়েছে বলে জানান তাঁর আইনজীবী মো. কাজল রশীদ বিশ্বাস।

২১ জানুয়ারি র‍্যা’ব-২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু নাঈম মো. তালাতের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভু’ক্তভোগী ও তার বাবা বিল্লাল হোসেনের কথা অনুযায়ী, ফারজানা কাজে সামান্যতম ভু’ল করলেও তাকে মা’রপিট ও জ’খম করতেন সামিয়া ইউসুফ। প্রায়ই তাকে মা’রপিট করা হতো। ১৭ জানুয়ারি মা’রপিটের ঘটনায় ফারজানা গু’রুতর অ’সুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

রোববার ফারজানার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তার শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে এক তরুণ বলতে থাকেন, ‘ফারজানার চুলকানি হয়েছে। তাই শরীরে দাগ হয়েছে। ফারজানার সিস্ট আছে, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তার শরীরের এই দশা হয়েছে।’

পরিচয় জানতে চাইলে তরুণ দাবি করেন, তিনি সামিয়া ইউসুফের পরিবারের পক্ষ থেকে ফারজানাকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে এসেছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।তরুণ যখন চুলকানির কথা বলছিলেন, তখন ফারজানা উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে, ‘আপনি আমার জ্বা’লা কেমন বুঝবেন? মি’থ্যা কথা বলেন কেন? এইগুলা চুলকানির দাগ? এইগুলা হলো মাইরের দাগ।’

ফারজানা বলে, ‘আমার পেটে লা’থি মারছিল। তারপর পেট ফুলে গেছিল। আগে এক হাসপাতালে নিছিল। সেইখানে কোনো চিকিৎসা হয় নাই। আপনারে সারা শরীর দেখাতে পারছি না। সারা শরীরে খালি দাগ আর দাগ। সব মাইরের দাগ।’

কথাগুলো বলে ফারজানা হাঁপাতে থাকে। তার পাশে বসা মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, এখন একটু কথা বললেই মেয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। একই বাসায় ফারজানার ছোট বোন ও এক খালার মেয়ে থাকত। ফারজানার ছোট বোনের পায়ে আ’ঘাতের চিহ্ন আছে। ফারজানা তিন হাজার টাকা বেতন পেত। তবে ওর ছোট বোন কোনো বেতন পেত না। ওই দুজনকেও বাসা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।

জ্যোৎস্না বেগম বলেন, এর আগে ফারজানাকে এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি—এ কথা তাঁকে গো’পন রাখতে বলা হয়েছিল। এতে তাঁর মনে খটকা লাগে। তিনি তাঁর স্বামী বিল্লাল হোসেনকে মেয়ের অবস্থার কথা জানান। পরে তাঁরা থানায় গিয়ে মেয়েকে উ’দ্ধারের আবেদন জানান।

এক ছেলেকে নিয়ে রাজধানীর হাজারীবাগে থাকেন জ্যোৎস্না ও বিল্লাল। জ্যোৎস্না বলেন, ফোন করলেই ফারজানা তাঁকে বলত, সে ভালো আছে। তবে এক মাস আগে একবার ফারজানাকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তখন তাকে কাছে আসতে দেওয়া হয়নি। ফারজানা দূর থেকে কথা বলে। তখন তিনি বুঝতে পারেননি, ফারজানাকে এভাবে নি’র্যাতন করা হচ্ছিল।

বিল্লাল হোসেন একটি প্লাস্টিক কারখানায় আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন। তিনি বলেন, সামিয়া ইউসুফের মায়ের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে নিজের দুই মেয়ে ও শ্যালিকার এক মেয়েকে কাজে দিয়েছিলেন। ফারজানা বলত, ভালো আছ। তাই সেভাবে মেয়েকে দেখতে তাঁরা ওই বাসায় যেতেন না। ফারজানার ভাষ্য, তাকে সামিয়া ইউসুফই মা’রধর করতেন। তাকে মা’রধরের সময় কেউ এগিয়ে আসত না। সামিয়া ইউসুফের আইনজীবী কাজল রশীদ বিশ্বাস অবশ্য দাবি করেন, ফারজানাকে মা’রধর করা হতো না। তার সিস্ট আছে। এই সিস্ট থেকেই তার শা’রীরিক অবস্থা খা’রাপ হয়েছে। সে জন্য আগেও তার চিকিৎসা করা হয়েছে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসক ফারজানার চিকিৎসাসংক্রান্ত নথিপত্র দেখে বলেন, মেয়েটির (ফারজানা) সারা শরীরে পানি এসেছে। ওর কিডনিতেও পানি জমেছে। ও’ষুধ দিয়ে শরীরের পানি বের করা হচ্ছে। ফারজানার টিউমার বা সিস্ট আছে। এ ছাড়া র’ক্তস্বল্পতা, প্রোটিনস্বল্পতাসহ নানান জটিলতা আছে। তার শরীরে ক্ষ’ত বা দাগ আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার চিকিৎসা চলছে।

ফারজানার বাবার করা মা’মলা ত’দন্ত করছেন কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শামীম হাজরা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৭ জানুয়ারি তাঁর নাইট ডিউটি ছিল। তখন তিনি জানতে পারেন, মেয়েকে বাসায় আ’টকে রেখে মা’রধরের অ’ভিযোগ নিয়ে থানায় এসেছেন মা-বাবা। তারপর মেয়ের মা-বাবাসহ ফোর্স নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান। তখন ফারজানা অ’সুস্থতার জন্য কথা বলতে পারছিল না। মেয়েটিকে উ’দ্ধার করে থানায় আনা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেয়েটিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। সে রাতেই ফারজানাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। পরদিন ওসিসি থেকে ফারজানাকে অন্য কোনো হাসপাতালে ভর্তি করতে বলা হয়। পরে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আনা হয়। কিন্তু সিট না থাকায় তাকে ভর্তি করা যায়নি। তাকে কমফোর্ট হাসপাতালে নিলে তারা এ ধরনের রো’গী ভর্তি করে না বলে জানায়। পরে আবার বা’ধ্য হয়ে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আনা হয়। সিট ফাঁকা হলে তাকে ভর্তি করা হয়।

এসআই শামীম হাজরা বলেন, প্রথমে ফারজানার মা-বাবা এ ঘটনায় কোনো মা’মলা করতে চাননি। পরে মা’মলা করতে রাজি হন। মা’মলার আ’সামি গৃহকর্ত্রী সামিয়া ইউসুফকে র‍্যা’ব গ্রে’প্তার করে। ২১ জানুয়ারি আ’সামিকে আ’দালতে নেওয়া হয়। তাঁকে কা’রাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আ’দালত।

ফারজানাকে নি’র্যাতনের ঘটনায় রোববার গৃহশ্র’মিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক বিজ্ঞপ্তিতে গভীর উ’দ্বেগ প্রকাশ করেছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটন করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে নেটওয়ার্ক। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে তারা স’রকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।স’রকার প্রণীত গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ বাস্তবায়িত না হওয়ায় দেশে একের পর এক গৃহশ্র’মিকের মৃ’ত্যু-নি’র্যাতনের ঘটনা ঘটছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সমীক্ষা বলছে, গত বছর ৩৮ জন গৃহকর্মী ধ”ণসহ নানা ধরনের নি’র্যাতনের শি’কার হন। এর মধ্যে ১২ জন নি’হত, ২৪ জন আ’হত ও দুজন আত্মহ’’ত্যা করেন। নি’হত গৃহকর্মীদের মধ্যে ৪ জন হ’’ত্যাকাণ্ডের শি’কার হয়েছেন। ৮ জনের র’হস্যজনক মৃ’ত্যু হয়েছে। আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে হ’’ত্যা ও নি’র্যাতনের শি’কার হয়েছিলেন ৪৪ জন গৃহশ্র’মিক, যার মধ্যে ২০ জন নি’হত, ২৩ জন আ’হত ও ১ জন নি’খোঁজ ছিলেন।

বিলসের জরিপ বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে যাঁরা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের ৯৫ ভাগের বেশি নারী ও মেয়েশি’শু। গণমাধ্যমে যে ঘটনাগুলো প্রকাশিত হয়, প্রকৃত ঘটনা ঘটে তার চেয়ে আরও বেশি। অনেক নি’র্যাতনের ঘটনায় অর্থ ও চা’পের মুখে গৃহকর্মীর পরিবার সমঝোতা করতে বা’ধ্য হয়। অনেক সময় প্রভাবশীল ব্যক্তিরা গৃহকর্মী নি’র্যাতনের ঘটনা ধা’মাচা’পা দেন।ফারজানার সঙ্গে কথা শেষে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় সে জো’রগ’লায় বলে ওঠে, ‘আমি কিন্তু এই ঘটনার বিচার চাই।’ সূত্রঃ প্রথম আলো