পূর্ণ স্বাধীনতা পেলে জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করতে রাজি মাশরাফি

| আপডেট :  ৯ নভেম্বর ২০২১, ০১:১৪ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৯ নভেম্বর ২০২১, ০১:১৪ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের ক্রিকেট আর গুঞ্জন-গুজব, কানাঘুষো-ফিসফাস যেন মিলেমিশে একাকার। ঘটনার চেয়ে রটনা বেশি। কিছু হওয়ার চেয়ে জল্পনা-কল্পনার ফানুস ওড়ে অনেক বেশি।মাঝে দুটি গুঞ্জন প্রবল আকার ধারন করেছিল। এক. মাশরাফি বিসিবিতে আসতে পারেন। তিনি নড়াইল বা অন্য কোনো ক্যাটাগরিতে কাউন্সিলর হয়ে বোর্ড পরিচালক পদে নির্বাচন করতে পারেন। দুই. মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মাশরাফিও টিম বাংলাদেশের মেন্টর হতে পারেন।

বিশ্বকাপের আগে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে ভারতের মেন্টর করার পরপরই একটা দাবি উঠেছিল, মাশরফি বিন মর্তুজাকেও বাংলাদেশের মেন্টর করা উচিত। এর মধ্যে ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল এক টক শোতে মাশরাফিকে আগামী ওয়ানডে বিশ্বকাপে মেন্টর হিসেবে পেতে চাইলে গুঞ্জনটা আরও ছড়িয়ে পড়ে। শাখা-প্রশাখা গজায়।

তবে আসলেই কি মাশরাফি বিসিবিতে আসতে চেয়েছিলেন? তার ইচ্ছে হয়েছিল বোর্ড পরিচালক হওয়ার? অথবা তিনি কি সত্যিই জাতীয় দলের মেন্টর হতে চান? জাতীয় দলের সঙ্গে তার অন্য কোনো পরিচয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে? থাকলে সেটা কিভাবে? জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল ‘নটআউট নোমানে’ দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাতকারে এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব মাশরাফি দিয়েছেন খোলামেলাভাবে। মাশরাফি জানিয়েছেন, তার এখনকার ও ভবিষ্যত চিন্তা-ভাবনার কথা। বলে দিয়েছেন, তার বোর্ডে আসার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। এটা নিছক গুজব ছিল।

মেন্টর কিংবা অন্য কোনো পরিচয়ে জাতীয় দলের সঙ্গে মাশরাফির কাজ করার ইচ্ছে অবশ্যই আছে। তবে সেটা অনেক শর্ত-সাপেক্ষে। একমাত্র পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলেই জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছের কথা জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম এই অধিনায়ক।

কিছুদিন আগে বিসিবির নির্বাচন গেল। তার আগে বাইরে থেকে হাওয়া উঠেছিল মাশরাফি হয়ত বোর্ডে আসতে পারেন। সেরকম কোনো সম্ভাবনার জায়গা কি তৈরি হয়েছিল? সঞ্চালক নোমান মোহাম্মদের এমন প্রশ্নর উত্তরে মাশরাফি বলেন, ‘শোনা কথায় কান দিতে নেই। আমার চিন্তা-চেতনার ভেতরে এটা ছিল না। আমি এখনো অবসরে যাইনি। দ্বিতীয়ত, আমার বিপিএল খেলার ইচ্ছে আছে। এখনো ভাবছি, আমি খেলবো। তাই ওটা (বিসিবিতে সম্পৃক্ত হওয়া বা পরিচালক হওয়া) চিন্তার ধারে কাছেও ছিলনা। সত্যি বলতে ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচন তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত আমি চিন্তাও করিনি যে, ক্রিকেট বোর্ডে ঢুকে বা ক্রিকেটের জন্য আমার করণীয় কিছু আছে।’

জাতীয় দলের মেন্টর হিসেবে যুক্ত হওয়া নিয়ে মাশরাফি বলেন, ‘আমার এখন দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। একদম সত্যি বলতে, কোনোভাবেই নাই। কারণ আমি নাই বা বললাম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যদি কেউ হেল্প চায় সেটা করতে পারি। যেমন তাসকিন চেয়েছিল। আমি পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা হয়, তারা যদি কেউ চায় তবে আমি তাদের পাশে থাকব।’

কয়েকদিন আগে ওয়ানডে ক্যাপ্টেন তামিম ইকবাল তার এক টক শোতে বলেছেন, ‘আমি যদি ক্যাপ্টেন থাকি, তবে ২০২৩ বিশ্বকাপে মাশরাফি ভাইকে মেন্টর হিসেবে অথবা অন্য যে কোনোভাবে পেতে চাইবো। তখন আপনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট যদি চায় তাহলে আমার পক্ষে না বলা কঠিন। আর এখন বলছেন যে, মেন্টর হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আপনার। ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেল না?

সঞ্চালক নোমান মোহাম্মদের এ প্রশ্নর জবাবে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক বোঝানোর চেষ্টা করেন, ২০২৩ আসতে এখনো বাকি দুই বছর। এখনকার পরিবেশ-প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সে সময়ে অনেক ফারাক থাকতে পারে। মাশরাফি বলেন, ‘প্রথমত সেটা ২০২৩। ২০২১, মানে এখন নয়। আমি জানি না তখন আমি কোন সিচ্যুয়েশনে আসবো। আমি আগেও বলেছি মেন্টর হিসেবে গিয়ে খুব বেশি কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। আপনি তো আর মাঠের খেলা খেলে দেবেন না। আমি ঠিক জানি না কি করতে হবে? তবে আমার মনে হয়, আমাকে এমন কিছু করতে হবে যেটা দলকে বদলে দেবে।’

মাশরাফি সরাসরিই বলেছেন, তিনি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার আরও কিছুদিন চালিয়ে যেতে চান। ইচ্ছে আছে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট ও বিপিএল খেলার। তবে খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর হয়তো মেন্টর বা অন্য কোনোভাবে জাতীয় দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চান তিনি।

এ সব নিয়ে মাশরাফির কথা, ‘ক্রিকেট বোর্ড বা তামিম যেভাবে চাইবে, সেভাবেই যে যাব তা না। আমার নিজের ব্যক্তিত্ব আছে। আমার নিজের বুঝতে হবে আমি গিয়ে কী করতে পারবো। আর নকল করার অভ্যাস আমার নেই। অন্য দল ধোনিকে নিয়েছে বলে, আমাকেও যে যেতে হবে তা নয়। আমার ইনপুট যদি টিমের পছন্দ হয়, আমার নিজের যদি মনে হয় আমি এভাবে টিমকে সহায়তা করতে পারি, তখনই কেবল হতে পারে। না হয় ওই যে টিমের সাথে বিজনেস ক্লাসে ভ্রমন করা, পাঁচ তারকা হোটেলে থাকলাম, চলে আসলাম। টিম জিতলো না, কিছু হলো না-এ ভাবে কাজ করার ইচ্ছে নেই।’

অবসরে যাওয়ার আগে আগে অন্য কোনো পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে নেই, আবারো নিজের এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মাশরাফি বলে ওঠেন, ‘এখনো যেহেতু অবসরে যাইনি, এখন তাই ওসব নিয়ে ভাবছিনা। এর ওপর, আমি আমার জেলার ২ নম্বর আসনের সংসদ সদস্য। এলাকা নিয়ে ভাবতে হয়। ওখানেও আমার কিছু দায়িত্ব আছে। সেগুলোও আমি পালন করি। তাই এখন চাইলেই সবার কথা রেখে ইচ্ছেমত সব কিছু করা সম্ভব না।’

তারপরও ক্রিকেট তার ধ্যান-জ্ঞান। তার শরীরের অণু-পরমাণুতে মিশে আছে। সেজন্য ক্রিকেটের সঙ্গে থাকতে ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতে চান নড়াইল এক্সপ্রেস। সেক্ষেত্রে মনের দিক থেকে স্থিতিশীল হওয়াটাকে খুব জরুরি মনে হয় তার, ‘আমি আগেই বলেছি ক্রিকেট আমার রক্ত কণিকার সঙ্গে মিশে আছে। ক্রিকেট সব সময়ই আমার ফার্ষ্ট প্রাইয়োরিটি ছিল। এখনো ক্রিকেট আমার কাছে অনেক বড়। তবে ক্রিকেটকে সহযোগিতা করার জন্য আমার একটা জায়গায় স্থির হতে হবে। আমি এখনো চিন্তা করছি আমি বিপিএল খেলবো, ঢাকা লিগ খেলবো। তাহলে এখন আমি কিভাবে অন্য কিছু করার কথা চিন্তা করি? আমি যখন সেটেল্ড হবো তখন হয়ত কিছু একটা আসবে।’

ক্রিকেটের জন্য কাজ করার ইচ্ছে পোষন করে মাশরাফি সব শেষে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে কাজ করার পরিবেশ পেলে দেশের ক্রিকেটের জন্য কাজ করতে তিনি মুখিয়ে আছেন। মাশরাফি বলেন, ‘আমি কার সঙ্গে কাজ করবো, কীভাবে করবো, আমার কাজের ধরন কি হবে অথবা আমার কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ হবে কিংবা কেউ এসে বাঁ হাত দেবে-তা চলবেনা। আমার জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতার একটি নির্দিষ্ট জায়গা থাকবে। আমি কাজ করলে সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে করবো। প্রতিনিয়ত আমার কাজে ডিষ্টার্ব হবে, ওই ধরনের কাজে আমি যাবো না।’

কিন্তু এখন বিসিবি যেভাবে পরিচালিত হয়, তাতে কি আপনার সেই ইচ্ছে পূরণ হবে? আপনার কি মনে হয় আপনি যেভাবে বলেছেন তাতে এই বোর্ডের সঙ্গে আপনি কাজ করতে পারবেন? এ প্রশ্নর জবাবে মাশরাফি বলেন, ‘এটা তো আমার সমস্যা না। আমাকে যদি কেউ চায়, আমি চাইবো সেইভাবে তারা আগে চিন্তা করুক। আমার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই। তাদের কোনো সমস্যা আছে কিনা, সেটা তাদের ভাবনা। আমার না। আমার অনেক কাজ আছে ভাই। ব্যক্তিগত কাজ। পারিবারিক কাজ। ছেলে-মেয়ে মানুষ করাও একটা কাজ। আর বিষয়টা এমন না যে, তারা যা চাইবে সেইভাবে এক জায়গায় লেগে থাকবো।’

‘আমি যদি পরিবর্তন আনতে না পারি, তবে সেখান থেকে সরে আসবো। মোদ্দা কথা, আমি ফুল অথোরিটি নিয়ে কাজ করতে চাই। এমন কাজ আমি করবো না, যেখানে আমাকে প্রতিনিয়ত ডিষ্টার্ব করা হবে। যেমন আপনারা বলেন, এখন নির্বাচক প্যানেল স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। তাহলে সেই কাজ করার চেয়ে তো, না করার ভালো।’