কি কারণে একজন ইসলামিক বক্তা কে নি’খোঁজ বা গু’ম করা হয়েছে

| আপডেট :  ১৪ জুন ২০২১, ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৪ জুন ২০২১, ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ

গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে একজন তরুণ—মো. আফছানুল আদনান, যিনি আবু ত্ব-হা মোহাম্ম’দ আদনান নামে পরিচিত—নি’খোঁজ। তাঁর সঙ্গে গাড়িচালকসহ অ’পর দুই সঙ্গীর হদিসও মিলছে না বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই তিন দিনের বেশি পার হয়েছে। তাঁর ‘নি’খোঁজ’ হওয়ার কারণ জানা যায়নি এবং তাঁকে উ’দ্ধারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের ‘নি’খোঁজ’ হওয়ার সংবাদ কেন উদ্বেগ ও শ’ঙ্কার জন্ম দেয়, তা সবিস্তারে বলা দরকার নেই। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এ ধরনের ‘নি’খোঁজ’ ব্যক্তিরা আসলে যার শিকার হন, তাকে গু’ম ভিন্ন আর কিছু বলার সুযোগ নেই।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় এ দাবি করা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশে কোনো ধরনের গু’মের ঘটনাই ঘটে না, কিন্তু দেশের এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো জো’র দিয়ে বলে আসছে, বাংলাদেশে গু’মের ঘটনা অব্যাহত। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১১ জন গু’ম হয়েছেন। গত বছরের আগস্ট মাসে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য ছিল, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে ৬০৪ জন গু’মের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৭৮ জনের লা’শ উ’দ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রে’প্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত গু’ম হওয়া ৫৩২ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে। কে কী’’ভাবে গু’ম হয়েছিলেন, তারও বিস্তারিত সেখানে আছে। এ সংখ্যা যে বেড়েছে, তা আম’রা তো দেখতে পাচ্ছি।

আশা করি, আদনান গু’মের শিকার হননি এবং তিনি শিগগিরই ফিরে আসবেন। কিন্তু সময় যতই যাচ্ছে, ততই এ আশ’ঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে যে আদনান গু’মের শিকার হয়েছেন। তিনি স্বেচ্ছায় পালিয়ে আছেন বলে মনে করার কোনো কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের অবস্থা আর কত দিন অব্যাহত থাকবে? একজন নাগরিক সহ’জেই নি’খোঁজ হচ্ছেন এবং তাঁদের বিষয়ে সরকারের কোনো ধরনের উদ্বেগ নেই। সরকার যেহেতু দাবি করে যে বাংলাদেশে সংঘটিত ‘নি’খোঁজ’ হওয়ার ঘটনাগুলোর সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, তাহলে কেন বাংলাদেশে সরকার নিরপেক্ষ ত’দন্তের ব্যাপারে অনাগ্রহী? এ বিষয়ে সরকারের কাছে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা অনুরোধ জানালে সরকার তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।

সাংবাদিক কামাল আহমেদ ২০১৯ সালে আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ কমিটির [জাতিসংঘের নি’র্যাতনবিরোধী কমিটিতে-ক্যাট] সর্বসাম্প্রতিক নথিতে (জুলাই মাসে তৈরি) দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬১ জনের গু’ম-র’হস্যের এখনো কোনো কিনারা হয়নি। এর মধ্যে কমিটি সরকারের কাছে পাঁচজনের গু’মের বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে তথ্য জানতে চেয়েছে। গু’মের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ার কারণে এ কমিটি ২০১১ সালের ৪ মে, ২০১৬ সালের ৯ মা’র্চ, ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং গত ২৯ জুন উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে। কমিটি ২০১৩ সালের ১২ মা’র্চ আলাদা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানোর অনুরোধও জানিয়েছে। ওই অনুরোধের বিষয়ে তারা আরও পাঁচবার সরকারকে চিঠি লিখলেও সরকার তাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।’ (‘স্বাধীন ত’দন্তই গু’ম-র’হস্যের সমাধান’, প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট ২০১৯)। ১৯৯৬ সালে ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশের কাছে প্রথমবারের মতো একটি অ’ভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। এত বছরে মাত্র একটি ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ।

অথচ ২০১৯ সালের এপ্রিলে ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইডিএইচ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অ’ভিযোগ করা হয়, গু’মের এ ঘটনাগুলো বিক্ষিপ্ত বা স্বেচ্ছায় ঘটানো ঘটনা নয়। ‘এগুলো যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাঁদের সমন্বিত কৌশল কার্যকরেরই অংশ।’ এ ঘটনাগুলোকে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ও ‘রাষ্ট্রীয় নীতিমালার পরিণাম’ হিসেবে বর্ণনা করে এফআইডিএইচ বলেছে, ‘যেহেতু বেশির ভাগ ভুক্তভোগীকেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে টার্গেট করা হয়, এই কাজগুলো মানবতাবিরোধী অ’প’রাধ।’ সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এসব অ’ভিযোগ মিথ্যা হলে তা প্রমাণ করার জন্যই ত’দন্তের অনুমোদন দেওয়া।

আদনানের ‘নি’খোঁজ’ হওয়ার সংবাদে আমাদের এ তথ্যগুলো স্ম’রণে আসে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আদনানের ‘নি’খোঁজ’ হওয়া বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, তাঁর মা আজেদা বেগম একটি মা’মলা দায়ের করেছেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘আজেদা বেগম বলেন, আদনান কোনো রাজনীতি বা কোনো ধ’র্মীয় সংগঠনও করেন না।’ এ কথাগুলো লক্ষণীয়। জননী হিসেবে তিনি সত্য বলেছেন, আমিও ধরে নিচ্ছি যে অনলাইনে ধ’র্মীয় বক্তা হিসেবে পরিচিত আদনান কোনো ধরনের সংগঠনের সঙ্গে যু’ক্ত নন।

আমি তাঁর কোনো বক্তৃতা শুনিনি, ফলে তাঁর সঙ্গে একমত হওয়া বা ভিন্নমতের সুযোগ আমা’র নেই। কিন্তু যেটা আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যেসব অধিকার সংবিধানে দেওয়া আছে, তাতে রাজনীতি করা, ধ’র্মীয় সংগঠন করার ব্যাপারে বাধানিষেধ নেই।

কিন্তু কোনো একজন জননীকে, নি’খোঁজ একজন নাগরিককে এ পরিচয় দিতে হচ্ছে যে তিনি রাজনীতি বা সংগঠন করেন না? বাংলাদেশের নাগরিকের রাজনীতি বা সংগঠন করা কি অ’প’রাধ বলে বিবেচিত হচ্ছে? এ ধরনের কথা মা-বাবাকে বলতে হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই। অনেকের স্ম’রণে থাকবে, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আ’ন্দোলনের নেতারা যখন আ’ট’ক হন, তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনেও বলা হয়েছে, তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে যু’ক্ত নন।

এ আ’ন্দোলনের নেতা রাশেদ খানের মা ও স্ত্রী’’ সংবাদ সম্মেলনে জো’র দিয়ে বলেছিলেন, ‘রাশেদ কোনো রাজনীতির সঙ্গে যু’ক্ত না।’ একজন অসহায় মা তাঁর সন্তানের মুক্তির জন্য আবেদন জানাতে দুই হাত জোড় করে বলেন, ‘আমা’র মণি, এমনকি আম’রা কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জ’ড়িত না।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ১১ জুলাই ২০১৮)। তারই প্রেক্ষাপটে আমা’র প্রশ্ন ছিল ‘তরুণদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা কি অ’প’রাধ?’ (প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮)।

তিন বছরে অবস্থার উন্নতি হয়নি। গু’মের সংখ্যা বেড়েছে, বিচারবহির্ভূত হ’ত্যার সংখ্যা বেড়েছে, কথা বলার ওপরে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া হয়েছে যে রাজনীতি করা একধরনের অ’প’রাধ; ব্যতিক্রম ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করা, রাজনীতির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা নিজের ঘরে ‘টর্চার সেল’ চালানোও আ’পত্তি নেই। একেই বলে বিরাজনীতিকরণ। কিন্তু বিরাজনীতিকরণের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ হচ্ছে সমাজের কোনো কোনো অংশের মৌন সম্মতি। কার কথা বলার অধিকার বা বেঁচে থাকার অধিকার আমি সম’র্থন করব আর কারটা করব না, সেটা এখন সহ’জেই দর্শনীয়। বাংলাদেশে ভিন্নমতের মানুষ আ’ট’ক হওয়ার খবরে ওই ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার দাবি তোলার মতো ব্যক্তি আছেন। তাঁরাই আবার কথায় কথায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অনেক নজির দেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ যে কেবল একটি বা দুটি মা’মলার রায় নয়, কিংবা বললেই যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না, সেটা তাঁদের বোঝানো অসম্ভব।

আ’দালতে ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গু’মের বিষয়ে তিনটি রিট করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আ’দালত তিনটি রুল জারি করেছেন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। ফলে এই রিটগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি। শেষ রিট আবেদনেরও সাত বছর পার হয়ে গেছে। আ’দালত ভেবে দেখতে পারেন, এগুলোর ব্যাপারে তাঁর কিছু করণীয় আছে কি না। আর ইতিমধ্যে আম’রা আশা করি যে আদনানসহ যাঁরা এখন ‘নি’খোঁজ’ হয়েছেন, তাঁরা ফিরে আসবেন। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে নি’খোঁজ, তাঁরাও তাঁদের স্বজনদের কাছে ফিরুন—সেটাই প্রত্যাশা। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, আশাবাদ কোনো কৌশল হতে পারে না। নাগরিকদের ‘নি’খোঁজ’ হওয়ার যে ধারা গড়ে উঠেছে, তার পেছনে যে রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থা আছে, তাকে মোকাবিলা না করে কেবল আশাবাদ দিয়ে এ প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না।

আলী রীয়াজ যু’ক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভা’র্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আ’মেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট