গো-মূত্র ঢেলে হাড়ভাঙ্গার চিকিৎসা দেন বাবা, ছেলে করেন বাচ্চা হওয়ার তদবির

| আপডেট :  ৮ জুন ২০২১, ০৮:০০ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৮ জুন ২০২১, ০৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

চাঁদপুর শহর সংলগ্ন মৈশাদী ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার একসময়ের পাট ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম কালের বিবর্তনে বনে গেছেন হাড় ভাঙ্গার মস্তবড় চিকিৎসক। প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া চিকিৎসার নামে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে জিম্মি করে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সিরাজু্লের ছেলে খোরশেদসহ পুরো পরিবারটির বিরুদ্ধে।

শুধু তাই নয়, সন্তান হওয়া, স্বামী-স্ত্রীর মিলকরণ, অবাধ্য সন্তান বশে আনা, বিয়ে হওয়াসহ নানান তদবীরও করেন তারা। মৈশাদীর চৌধুরী দিঘীর উত্তর পাড়ে ‘মৈশাদী হাড় ভাঙ্গা চিকিৎসা কেন্দ্র’ নামে তারা গড়ে তুলেছেন রেজিস্ট্রেশনবিহীন ভূঁয়া একটি প্রতিষ্ঠান।

যেখানে সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘মরহুম ছায়েদ খানের স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ দ্বারা যেকোনো হাড়ভাঙ্গা, হাড়জোড়া এবং মেরুদন্ডের হাড় ক্ষয় হয়ে যাওয়াসহ সকল প্রকার চিকিৎসা’ নাকি করা হয় সেখানে। সাইনবোর্ডের ঠিক নিচেই লেখা রয়েছে ‘এখন থেকে নতুন বাড়ীতে চিকিৎসা প্রদান করা হবে’। বুঝাই যাচ্ছে অল্প সময়ে তাদের ভালোই উন্নতি হয়েছে।

এছাড়াও তার ছেলে খোরশেদ আলম মিজির নামের এক লিফলেটে দেখা যায়- সন্তান হওয়ার তদবীর, স্বামী স্ত্রী মিলকরণ, বিয়ে হওয়ার তদবীরসহ কুকুরের কামড়, টনসেলের চিকিৎসা, আঙ্গুল হাড়া, ফোড়া বা ফিস্টকসহ নানান চিকিৎসাও নাকি করেন তারা। যদিও পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রীর সাথে খোরশেদের প্রায় সময়ই ঝগড়া লেগে থাকে বলে জানায় স্থানীয়রা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- নতুন বাড়িতে রীতিমতো হাসপাতাল খুলে বসেছেন সিরাজ মেম্বার। রোগী ভর্তি করে তাদেরকে ডাক্তারের মতই চিকিৎসা দেন, আবার রাউন্ডেও আসেন তিনি। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার পরিবেশ। দিনের বেলায় লাইট না জ্বালালে চোখে পড়েনা কিছুই। হাত-পা ভাঙা ৮ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন সেখানে। তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যান্ডেজ এবং তা থেকে বের আসছে গো-মূত্রের তীব্র গন্ধ।

এসকল রোগীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, ‘আমরা গরীব মানুষ তাই এখানে চিকিৎসার জন্য এসেছি। পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকায় সিট ভাড়া দিয়ে আমাদের চিকিৎসা নিতে হয়। হাসপাতালে গেলে নাকি অনেক টাকার ব্যাপার তাই কয়েকজনের পরামর্শে আমরা এখানে এসেছি’।

জণৈক রোগীর মা জানান, ‘সিরাজ কবিরাজ আমার ছেলের ভাঙ্গা পায়ে বাঁশের চটি বেঁধেছেন। ব্যথা যাতে না করে সেজন্য তিনি নিজ হাতে ইঞ্জেকশন দিয়েছেন, আর বলছেন কয়েকদিন এখানে থাকার জন্য। এভাবেই তিনি প্রত্যেক রোগীদেরকে প্রয়োজন মাফিক ব্যথার ইঞ্জেকশন ও স্যালাইন দিচ্ছেন’।

এলাকাবাসী জানান- ‘যখন সিরাজ মেম্বার পাটের ব্যবসা করতেন তখন তার ভাঙ্গা ঘর ছিল, বর্তমানে তিনি ভূঁয়া কবিরাজি করে কয়েক বছরে মানুষের কাছ থেকে বিপু্ল পরিমান টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি এখন নিরিবিলি পরিবেশে নতুন জায়গা ক্রয় করে হাসপাতালের আদলে গড়ে তুলছেন অট্টালিকা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সিরাজ মেম্বারের দালাল রয়েছে, আর তাদের মাধ্যমেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তার এখানে রোগী আসে।

এলাকাবাসী আরো জানায়- ‘কয়েকদিন পূর্বে চট্টগ্রাম থেকে পা ভাঙ্গা এক রোগী আসলে ২১ দিন তার কথিত হাসপাতালে রেখে ৪২ হাজার টাকা বিল করা হয়। পরে যখন ওই রোগীর পা পচন ধরে ইনফেকশন হয়ে যায় তখন তিনি তাকে ডাক্তারি চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দিয়ে বের করে দেন। তার কিছুদিন পরেই ওই রোগীর মৃত্যু হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়- ‘সিরাজ মেম্বারের পাশাপাশি তার স্ত্রী ও ছেলেরা তার এই কাজে সহযোগিতা করে থাকে। তাদের এই ভুয়া চিকিৎসার কারণে অনেকেরই হাত, পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আর তাদেরই ভুল চিকিৎসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার যখন প্রতিবাদ করতে আসে তখন সিরাজ মেম্বারের দুই বখাটে ছেলে ও তার স্ত্রী অকথ্য ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেন। এর জেরে সিরাজ মেম্বারের ছোট ছেলে হাবিব বহু রোগীদেরকে মারধর করেছে এমন নজিরও রয়েছে’।

এসকল বিষয়ে পঞ্চম শ্রেণী পাস করা কথিত চিকিৎসক সিরাজ মেম্বার জানান, আমি একসময় পাটের ব্যবসা করতাম, এখন হাড় ভাঙ্গার চিকিৎসা করি। বনের গাছপালা দিয়ে আমি ওষুধ বানিয়ে হাড় ভাঙ্গা চিকিৎসা করি।

তিনি আরো জানান- ‘গেল কয়েকদিন আগে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আমার থেকে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছে, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের বহু লোক চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছে। বহু ডাক্তার আছেন যারা গোপনে আমার চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছে। চাঁদপুরের হাড় ভাঙ্গা জোড়া বিশেষজ্ঞ ডা: মিলন সরকার আমার চিকিৎসায় ভালো হয়েছে।

এ বিষয়ে অর্থোপেডিক্স ডাঃ মিলন সরকার জানান- ‘সিরাজ মেম্বার নামে কোন কবিরাজের নাম আমি এই প্রথম শুনলাম। তার কাছে আমার চিকিৎসা নেওয়া তো প্রশ্নই উঠে না। বরং তাদের মত এসকল ভূঁয়া কবিরাজদের কারণে সমাজের সহজ-সরল নিরীহ মানুষগুলো প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তারা তাদের হাত পায়ের মারাত্মক অবস্থা নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের নিকট আসে। কিছু কিছু সময় কিছু কিছু রোগীকে বাঁচানোর জন্য হাত-পা কাটা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকেনা’

এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সানজিদা শাহনাজ সময়ের কন্ঠস্বরকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলেছি। এ বিষয়ে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার তদন্ত সাপেক্ষে মতামতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিবে জেলা প্রশাসন’।

সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা পলিন সময়ের কন্ঠস্বরকে বলেন- ‘আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান। শিঘ্রই রিপোর্ট জমা দেবো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।