সব
নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম দেওভোগ। সবাই চেনে নাগবাড়ী নামে। এলাকাটি কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। সেখানেই বসবাস ফরিদ উদ্দিনের। বাবা নুরুজ্জামানের রেখে যাওয়া ভবনের চতুর্থ তলার অর্ধেক অংশে টিনশেডের দুটি কক্ষে স্ত্রী, কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আর একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে সংসার। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাইকপাড়ায়। চারতলা বলা হলেও ভবনটি আদতে পূর্ণাঙ্গ চারতলা নয়। ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয় তলায় তাঁর এক ভাই টিনশেড কক্ষ তৈরি করে বসবাস করছেন।
সোমবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভ্যাপসা গরমে জীবন অতিষ্ঠ করে তোলার মতো অবস্থা ফরিদ উদ্দিনের ঘরে। দরিদ্রতা ফরিদকে গ্রাস করলেও কাউকে বুঝতে দেননি। ঘরের সব কিছুই সাজানো-গোছানো। তবে ফরিদের স্ত্রী হীরণ বেগমের কথায় বোঝা গেল বুকে জমানো অনেক কষ্ট তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তাঁদের।
করোনার আগে ফরিদের সংসার মোটামুটি ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু করোনায় দুঃসহ হয়ে পড়েছে ফরিদের পরিবারের জীবন। দেড় বছর ধরে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে খাদ্য সহায়তা চেয়ে ৩৩৩-এ ফোন করেছিলেন ফরিদ উদ্দিন। কিন্তু সেটা যে বুমেরাং হবে তা আন্দাজ করতে পারেননি। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে এ কথা বলছিলেন স্ত্রী হীরণ বেগম।
কালের কণ্ঠকে হীরণ বেগম বলেন, ‘আমরা চারতলা ভবনের মালিক দূর থেকে মনে হলেও আদতে সত্যিটা কী সেটা কেউ তলিয়ে দেখেনি। আমরা গত দেড় বছরে না পেরেছি কারো কাছে হাত পাততে, না পেরেছি মুখ ফুটে চাইতে। তাই অনেক সময় না খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। বলতে বলতেই গড় গড় করে চোখের জল ঝরে পড়ে হীরণের।’
মেয়ে সুমাইয়া আক্তার মহিলা কলেজে বিবিএ পড়ে। ছেলে রিফাত হোসেন (১৬) মানসিক প্রতিবন্ধী। ওদের বাবা চিন্তায় চিন্তায় স্ট্রোক করেছে। বাম চোখ দিয়ে এখন আর কিছুই দেখতে পায় না। তার পরও সংসার চালাতে এই বয়সেও (৬৫) একটি গার্মেন্টে চাকরি করছে। মাঝে গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে গেলে আমরাও দিশাহারা হয়ে পড়ি। ওই দুর্যোগের সময় কিছু আত্মীয়-স্বজন সাহায্যের হাত না বাড়ালে আমরা হয়তো পথের ভিখারি হয়ে পড়তাম। মাসে মাসে ওর (ফরিদের) ওষুধ, আমি প্রেসারের রোগী, ছেলেটি প্রতিবন্ধী—সব মিলিয়ে ওষুধের খরচও কম যায় না। তবু লজ্জায় মানুষের কাছে হাত পাতিনি। ধরনা দিইনি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে।
ফরিদ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একসময়ে আমার সবই ছিল। শহরের উকিলপাড়ায় হোসিয়ারি ব্যবসাও ছিল। কিন্তু নিকটাত্মীয়দের বেঈমানির কারণে সেটাও গেছে। পরে স্থানীয় একটি ছোট গার্মেন্টে চাকরি শুরু করি। ভালোই চলছিল চাকরি করে, কিন্তু করোনা আমাদের গোছানো সংসারটি ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দিয়েছে। এই যে দেখেন আমাদের যে দুটি কক্ষ সেটাও শ্বশুরবাড়ির সহযোগিতায় করা। আর মানুষ বলে আমরা চারতলার মালিক। এই অবস্থায় আমাদের বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না।’
প্রসঙ্গত, পরিবার ও প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য খাদ্য সহায়তা চেয়ে ফরিদ উদ্দিন গত ১৭ মে ৩৩৩ নম্বরে ফোন দেন। ফোনে সাড়া দিয়ে ১৯ মে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। স্থানীয় ইউপি সদস্যের তথ্য মতে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা ‘চারতলা ভবন ও হোসিয়ারি মালিক’ হয়ে খাদ্য সহায়তা চেয়ে দুষ্টুমি করার অভিযোগে ফরিদ উদ্দিনকে জরিমানা হিসেবে ১০০ জন দরিদ্রকে ত্রাণ সহায়তার নির্দেশ দেন।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাইন বিল্লাল জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শামীম ব্যাপারীকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে বুধবারের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তিনি আরো জানান, পাশাপাশি ফরিদের খরচ হওয়া প্রায় ৭৫ হাজার টাকা তাঁকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।