ওসি চেনেন টাকা, এএসআই ইয়াবা

| আপডেট :  ২২ আগস্ট ২০২২, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ আগস্ট ২০২২, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ওসি মজিদ: গত দুই দিন কী কী করলি?
এএসআই নাজমুল: দুই দিন কই স্যার, কাইলকাই তো। কাইলকা ওই যে দুইটা ছেলে ধরছিলাম।
মজিদ: টাকা কই?
নাজমুল: ২০ পিস মা’মলা দিছি।

ওসি: টাকা কই?
নাজমুল: মা’মলা দিয়া দিছি।… স্থানীয় লোক তো স্যার, মনে করেন একেবারে কৃপণ, টাকা দেয় না। মা’মলা খাইব তাও…। পরে ত’দন্ত স্যার কয়, মা’মলা দিয়া দেও।

এই কথোপকথন রাজধানীর উত্তরখান থানার ওসি আবদুল মজিদ ও একই থানার (সম্প্রতি বদলির আদেশ পাওয়া) এএসআই নাজমুল হাসানের। থানার ভেতরেই এই কথোপকথনের রেকর্ড সমকালের কাছে এসেছে। রেকর্ডিংটা গত বছরের কোনো এক সময়ের। রেকর্ডিংটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এএসআই নাজমুলের কাছে থাকা মোবাইল ফোনে নিজের অজান্তে এই কথোপকথনের ভিডিও রেকর্ড হয়ে যায়। তবে ক্যামেরার লেন্স কোনো কিছুতে ঢাকা পড়ায় বেশিরভাগ সময় তা অন্ধকার দেখা যায়। তবে অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, ওসি ক্ষি’প্ত হয়ে নাজমুলের ইয়াবা কারবারের তথ্য উপস্থাপন করছেন। কথোপকথনের বি’ষয়টি দু’জনই স্বীকার করলেও ওসি দাবি করেছেন, তিনি কোনো টাকা চাননি।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইয়াবাসহ অন্য মা’দকদ্রব্য জ’ব্দ করার পর নাজমুল বড় অংশ সরিয়ে রাখেন। পরে মা’মলার কাগজপত্রে কম পরিমাণ জ’ব্দ দেখিয়ে আ’সামিদের আ’দালতে পাঠান। সরিয়ে রাখা মা’দক তিনি সোর্সের মাধ্যমে বিক্রি করেন। আবার অনেক সময় কাউকে আ’টকের পর দাবি করা টাকা পেলে গ্রে’প্তার না দেখিয়ে ছেড়ে দেন। অ’নৈতিক উপায়ে করা এসব আয়ের একটি অংশ তিনি ওসিকে দিতেন। এ কারণেই দুই আ’সামি গ্রে’প্তারের তথ্য জানার পর বারবার টাকা চান ওসি।

এ ব্যাপারে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্ম’দ মোর্শেদ আলম সমকালকে বলেন, আ’সামি গ্রে’প্তারের তথ্য শুনে ওসির টাকা চাওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না। আর এএসআই নাজমুল হাসানের মা’দক কারবারের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানা নেই। এসব ব্যাপারে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, উত্তরখান থানায় প্রতি পদে পদেই টাকার লেনদেন হয়। রেকর্ড থেকে জানা যায়, একজনকে গ্রে’প্তারের আগেই টাকার হিসাব-নিকাশ চলছে। থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা (নাজমুল কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি) বলছেন :সোহেল মিয়া আমারে কইল, ধরলে একটু বেশি মাল দিয়া মা’মলা দিবেন, যাতে দুই-তিন মাস থাকে।

ওসি: টাকা দিব নাকি?
অন্যজন: ৫০ হাজার।
ওসি: যাও।
ওই কথোপকথনে পরে ওসি বলেন, এইটা ভালা কাজ তো, জেনুইন কাজ।
অন্যজন: জেনুইন কাজ। বলছে, আপনার পিন খোলা লাগব না। ৫০ হাজার টাকা… কিচ্ছু হবে না। আর কেউরে বলব না, দরকার হলে পার্টিরেও বলব না। এটা আমি আপনি স্যার, আর কাউরে বলা যাবে না।

ওসি: এটা তো বাইরে বলা যাবে না।

ভিডিও রেকর্ডের এক স্থানে দেখা যায়, এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে ওসিকে টাকা দিচ্ছেন।

তিনি বলছেন: স্যার, দুই হাজার টাকা আছে।

ওসি: কীসের?

অন্যজন: কাজের স্যার, স’মস্যা হবে না।

কথোপকথন প্রসঙ্গে উত্তরখান থানার ওসি আবদুল মজিদ বলেন, রেকর্ডিংটা গত বছরের। তখন আমি এখানে নতুন এসেছি। আমি এএসআই নাজমুলকে গালাগাল করছিলাম। বলেছি খা’রাপ মানুষ আমি রাখব না। তুমি দরখাস্ত দিয়ে চলে যাও। পরে সে তুরাগে বদলি হয়ে গেছে। আমি বস, তার সঙ্গে আমার অনেক কথাই হতে পারে। এই কথাগুলো কে বা কারা রেকর্ড করেছে জানি না।

এএসআই নাজমুলকে ‘খা’রাপ মানুষ’ বললেও এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বদলি করা হলেও ওসি দাবি করেন, নাজমুল ইয়াবা কারবারে জ’ড়িত নন। তাহলে কেন তাঁকে গালাগাল করা হলো ও দরখাস্ত দিয়ে চলে যেতে বলা হলো তার সদুত্তর মেলেনি। আর তিনি টাকার প্রসঙ্গে কিছু বলেননি বলে দাবি করেন।

ওসি স্বীকার না করলেও সেদিন দু’জনের কথোপকথনে বি’ষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে এক জায়গায় এএসআই নাজমুল ইয়াবা বিক্রির অ’ভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, আমি যে সমস্ত লোকের সঙ্গে চলি, সোর্স-মোর্স একটাও ধরা খায় নাই। তাহলে কথাটা কে বলল?

ওসি: যারে মাল (ইয়াবা) দিছো, হেই জানে।

নাজমুল: আমার জানা-পরিচিত স্যার, সবাই কিন্তু বাইরে। ধরা খাইল কেডা?

ওসি: তুই কি মালের ব্যবসা করার লাইগা আইছোস নাকি?

নাজমুল: আমি তো কোনো ক্লু পাইতাছি না।

ওসি: ক্লুর দরকার কী? তুমি আকাম করছ, শ্যাষ, আর কী। মাল বেচো তুমি ঘুইরা ঘুইরা।

নাজমুল: না স্যার, এগুলা মি’থ্যা কথা। এইটা নিয়া প্রটেস্ট না করলেও তো কইবো হ হাচাই মনে হয়। এমন কোনো লোক আমার পরিচিত নাই, যারে মাল দিসি, ধরা খাইছে, মা’মলা হইছে, এমন কোনো লোক আমি দেখতেছি না।

ওসি: মান-সম্মান সব গেছে, আল্লাহ মাফ করছে। যেদিন এএসআই ধরা খাইছে, পরের মাসে ওসি ক্লোজ হয়া গেছে। ফাইজলামি করার সীমা নাই। বোঝে না সবাই। শামীম স্যার ক্লোজ হয়া গেছে।

নাজমুল: আমি যারে চিনি না, কোনোদিন দেখি নাই…

ওসি: তুমি কার কাছে বেচো আমি জানি। পাঁচ-ছয় হাজার, নয় হাজার, সব বেইচ্যা-কিইন্যা শেষ কইরা দিছো। প্রমাণ দিলে তো তোমারে অ্যারেস্ট করত। এ ছাড়া পথ নাই।

একটু পর ওসি ক্ষি’প্ত হয়ে বলেন, কাল তুমি এখান থেকে দরখাস্ত দিয়া চলে যাবা। দ্রুত চলে যাবা এই থানা থেকে। ভালো হবে, সবার লাই ভালো। আমার লগে ভালো আছ, তুমি বাইরে যায়া করো। আমারে পাপে…(অশ্রাব্য) নাই তো, তোমারে রাইখ্যা আমি ওসিগিরি হারামু? চ্যালেঞ্জ…(অশ্রাব্য) জন্য আমার কাছে চলে আইছে। চ্যালেঞ্জ দিতেছ আমারে?

নাজমুল: আসলে স্যার, এমন ঘটনা ঘটে নাই।

ওসি: আমি তাহলে মি’থ্যা কথা বলছি নাকি? ফাইজলামি… (অশ্রাব্য)। ফালতু লোক কোথাকার। তুমি আকাম করছ কোন জায়গায়, দীর্ঘদিন ধরে তুমি আকাম করতেছ। একশ পিস, দশ পিস করে তুমি বিক্রি করো। দক্ষিণখানে সবাই জানে। এ টু জেড, প্রত্যেকের কানে কানে তোমার নাম। তুমি আবার চ্যালেঞ্জ (অশ্রাব্য) লাগি, ওই থানায় গেছ- কয় পিস দেহি? তোমারে ইবলিশে কামরায়?

নাজমুল: মাফ কইরা দেওয়া যায় না স্যার?

ওসি: আমি তো বুঝতে পারছি। আর তুমি চ্যালেঞ্জ…(অশ্রাব্য) আইছ আমার কাছে।

কথোপকথনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এএসআই নাজমুল হাসান সমকালকে বলেন, ওইদিন স্যার কী যেন একটা বি’ষয়ে রাগ হয়ে আমাকে যা-তা বলা শুরু করলেন। উনি আমাদের অভিভাবক, বলতেই পারেন। কীভাবে কী চালাতে হবে, কী করতে হবে ইত্যাদি। উনি আমাকে শাসন করে অনেক কথা বলেছেন। সেটা কেউ রেকর্ড করে ষ’ড়যন্ত্রমূলক বিভিন্ন জায়গায় দিয়েছে। ইয়াবা বিক্রির কথা একেবারে ভিত্তিহীন। সূত্রঃ সমকাল