চাপে দিশেহারা হেফাজত, দৃষ্টি লালবাগে

| আপডেট :  ২২ এপ্রিল ২০২১, ০১:৩০ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ এপ্রিল ২০২১, ০১:২২ অপরাহ্ণ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারীসহ বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি ব্যাপক সহিং’সতার পর গ্রে’প্তার অ’ভিযান এবং নতুন-পুরোনো মা’মলায় নেতাদের গ্রে’প্তার, মামুনুল হক নিয়ে বিতর্কসহ নানামুখী চা’পে দিশেহারা অবস্থায় পড়েছেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃত্ব।

এরই মধ্যে হেফাজতের কমিটি পুনর্গঠনের দাবি তুলেছে সংগঠনের একটা অংশ, যারা প্রয়াত আমির শাহ আহম’দ শফীর ছেলে আনাছ মাদানির সমর্থক। আবার হেফাজতের ভেতরেই একটি গোষ্ঠীর প্রকাশ ঘটেছে, যারা সংগঠনের অনেক কিছুতেই নিজেদের শক্তি ও প্রভাব-প্রদর্শনে সক্রিয়। যাদের সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। সব মিলিয়ে ভেতরে-বাইরের নানামুখী চা’পে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে হেফাজতে ইসলামের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে।

এ ছাড়া চলমান গ্রে’প্তার অ’ভিযান বন্ধে হেফাজতের ভেতর থেকেই স’রকারের সঙ্গে আপসরফার জন্য একটি অংশের চা’প রয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার রাতে হেফাজতের মহাস’চিব নুরুল ইসলাম জিহাদীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে বৈঠক করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ওই দিন দুপুরে হেফাজতের নেতারা পুলিশের বিশেষ শাখার একজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকের সূত্র ধরে রাতে স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়। এর আগে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর সম্মতি নেওয়া হয়। তবে কাদের আগ্রহে বৈঠক দুটি হয়েছে, সেটা স্পষ্ট করে জানা যায়নি। হেফাজত নেতাদের দাবি, দুই পক্ষের উদ্যোগেই বৈঠক হয়। যদিও স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে হেফাজতের নেতাদের প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা মন্ত্রীর বাসার বাইরে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।

এ বি’ষয়ে প্রথম আলোর কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি হেফাজতে ইসলামের মহাস’চিব নুরুল ইসলাম জিহাদী। অবশ্য স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে থাকা একটি সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে মূলত হেফাজতের নেতারা মন্ত্রীকে এই বার্তা দেন যে স’রকারের সঙ্গে হেফাজতের যে সম্পর্ক ছিল, সেটিই অব্যাহত থাকা দরকার। একই সঙ্গে স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন যে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গেও হেফাজতের কোনো যোগাযোগ নেই।

তা ছাড়া তাদের এই আন্দোলন স’রকারের বি’রুদ্ধে ছিল না। ফলে হেফাজতকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে স’রকারের কী লাভ। তাই বি’ষয়টি আর না বাড়াতে হেফাজত নেতারা স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে আর কাউকে গ্রে’প্তার না করা, গ্রে’প্তারকৃতদের মুক্তিতে বা’ধা না দেওয়া এবং রমজানের পর মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হেফাজত নেতারা মন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া হেফাজতের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের মনে হয়েছে স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রী হেফাজতের নেতাদের বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়েছেন। তবে তিনি কোনো কথা দেননি।

অবশ্য বৈঠক শেষে ওই রাতেই স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেছেন, হেফাজত নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁদের তিনি বলেছেন, পুলিশ নিরীহ কাউকে হ’য়রানি করছে না। যারা ভা’ঙচুর-সহিং’সতায় জ’ড়িত, শুধু তাদের গ্রে’প্তার করা হচ্ছে। যা করা হচ্ছে, সব আইন অনুযায়ীই হচ্ছে।

স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজত নেতাদের ওই বৈঠকের পর গত দুই দিনে ঢাকায় আরও চার নেতাসহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ৫২ জনকে গ্রে’প্তার করা হয়েছে। এর আগে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতা গ্রে’প্তার হয়েছেন। অনেকে গ্রে’প্তার অ’ভিযানের মুখে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

হেফাজত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পবিত্র রমজানের মধ্যে স’রকার যে এতটা ক’ঠোর পদক্ষেপ নেবে, তা হেফাজতের শীর্ষ নেতারা ভাবতে পারেননি। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে এখন কওমি মাদ্রাসাগুলো বন্ধ। রোজার পর সাধারণত কওমি মাদ্রাসাগুলোতে ভর্তি শুরু হয়। এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী বা উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সাংগঠনিকভাবে কী করা উচিত, তা ঠিক করতে পারছেন না হেফাজতের নেতারা। সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব অনেকটাই দিশেহারা।

যদিও প্রথম আলোর লিখিত প্রশ্নের জবাবে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, হেফাজতের নেতৃত্ব দিশেহারা অবস্থায় পড়েছেন, এটা মোটেও ঠিক নয়। বরং পবিত্র রমজান ও লকডাউন পরিস্থিতিতে পুলিশ হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বি’রুদ্ধে অন্যায়ভাবে দ’মনপীড়ন ও গ্রে’প্তার অ’ভিযান চালাচ্ছে। হেফাজতের নেতৃত্ব অবিলম্বে এসব বন্ধের দাবি ও কড়া প্র’তিবাদ জানিয়ে আসছে। অন্যায়ভাবে দ’মন অ’ভিযান চা’লিয়ে কোনো আদর্শিক সংগঠনকে দাবিয়ে রাখা যায় না।
হেফাজতের কমিটি পুনর্গঠনের দাবি

হেফাজতের কমিটি পুনর্গঠনের দাবিঃ সংগঠনের সাবেক যুগ্ম মহাস’চিব মাঈনুদ্দীন রুহী গত শুক্রবার তাঁর ফেসবুক আইডিতে ‘হেফাজতের পুনর্গঠন চাই’ শিরোনামে একটি পোস্ট দেন। তিনি এ বি’ষয়ে গণমাধ্যমে এবং টেলিভিশনের টক শোতেও সক্রিয়।

আহম’দ শফীর মৃ’ত্যুর পর হেফাজতের যে কমিটি হয়েছে, তাতে রুহী এবং আরেক সাবেক যুগ্ম মহাস’চিব মুফতি ফয়জুল্লাহকে রাখা হয়নি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মাঈনুদ্দীন রুহী ও মুফতি ফয়জুল্লাহ এবং প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে আবুল হাসানাত আমিনীসহ একটি অংশ হেফাজতের কমিটি পুনর্গঠনে তৎপরতা চালাচ্ছে। এ অংশ হেফাজতের প্রয়াত শাহ আহম’দ শফীর ছোট ছেলে আনাস মাদানীর সমর্থক। আনাস মাদানীর সমর্থকেরা স’রকার-ঘনিষ্ঠ হিসেবে সংগঠনের ভেতর পরিচিত।

আহম’দ শফীর মৃ’ত্যুর পর গত নভেম্বরে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নতুন কমিটি গঠিত হয়। এরপর থেকেই মাঈনুদ্দীন রুহী, মুফতি ফয়জুল্লাহসহ একটি অংশ আনাস মাদানীকে সামনে রেখে হেফাজত পুনর্গঠনে তৎপর হয়। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় সেই তৎপরতা এগোয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বি’রুদ্ধে বি’ক্ষো’ভকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে সহিং’সতা এবং তারপর গ্রে’প্তার অ’ভিযান শুরু হলে এই অংশ নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। তারা হেফাজত পুনর্গঠনের দাবি তোলা শুরু করেছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আনাস মাদানী বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছেন। তাঁর দেশে ফেরার পর হেফাজত পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া জো’রদার করা হবে। ইতিমধ্যে পুরান ঢাকার একটি প্রসিদ্ধ মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে আমির করে হেফাজতের পাল্টা কমিটি গঠনের চেষ্টা চলছে। যদিও তিনি এতে যুক্ত হতে এখনো রাজি হননি বলে তাঁর পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া বর্তমান কমিটিতে থাকা কয়েকজন নায়েবে আমিরের সঙ্গেও আনাস মাদানীর অনুগত অংশটি যোগাযোগ রাখছে। ইতিমধ্যে একজন নায়েবে আমিরের পদত্যাগপত্র তাঁরা হাতে নিয়েছেন। ওই নায়েবে আমির ঢাকার লালবাগ জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। এর বাইরে হেফাজতের কমিটি পুনর্গঠনে তাঁরা সারা দেশে আহম’দ শফীর যেসব খলিফা বা শিষ্য রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন।

মাঈনুদ্দীন রুহী গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুনর্গঠন বলতে হেফাজতের পুরো কমিটি পরিবর্তনের দরকার নেই। কমিটির কিছু সংস্কার করলেই হবে। আমরা আল্লামা আহম’দ শফীর যে নীতি-আদর্শ এবং তাঁর অহিংস কাজ—আমরা সেটা বাস্তবায়ন করতে চাই। হেফাজতে ইসলামের বর্তমান নেতৃত্ব রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষীদের হাতে জি’ম্মি।’

অবশ্য ‘হেফাজতের পুনর্গঠন চাই’ বলে মাঈনুদ্দীন রুহী তাঁর ফেসবুক আইডিতে যে পোস্ট দেন, তাতে ৩৯ জন ব্যক্তি প্রতিক্রিয়া জানান। এর মধ্যে ৩৮ জনই নেতিবাচক মন্তব্য করেন।

পুনর্গঠনের দাবির বি’ষয়ে জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, গত ১৫ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সংগঠনের সব প্রতিনিধির সম্মতিতে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে। ইসলামবিদ্বেষী চ’ক্রের প্ররোচনায় সংগঠনের বাইরের জনবিচ্ছিন্ন গুটিকয়েক কুচ’ক্রীর কথিত পুনর্গঠনের দাবি হাস্যকর।
দৃষ্টি লালবাগে

দৃষ্টি লালবাগেঃ ইতিমধ্যে হেফাজতের কেন্দ্রীয় দুই সহকারী মহাস’চিব জুবায়ের আহম’দ ও সাখাওয়াত হোসেন রাজিকে পুলিশ গ্রে’প্তার করেছে। দুজনেই লালবাগ জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। তাঁরা প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জামাতা। এই মাদ্রাসার আরেক শিক্ষক জসিম উদ্দিনকেও পুলিশ খুঁজছে। তিনিও মুফতি আমিনীর জামাতা এবং হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটির সহসভাপতি।

মিসরের কায়রোতে অবস্থানরত জসিম উদ্দিনের ছেলে আশরাফ উদ্দিন মাহদি ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আব্বাকে ধরার জন্য গত তিন দিনে পুলিশ দুবার বাসায় গেছে। আমরা মনে করছি, এ তিনজনকে হ’য়রানির পেছনে অন্য উদ্দেশ্যও আছে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সহিং’সতার মা’মলায় জুবায়ের আহম’দ ও সাখাওয়াত হোসেনকে গ্রে’প্তার এবং জসিম উদ্দিনকে গ্রে’প্তারের চেষ্টার পেছনে লালবাগ মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কারণ, মাদ্রাসায় হেফাজতের দুটি পক্ষের মধ্যে জুবায়ের-সাখাওয়াতরা শক্তিশালী। অন্য পক্ষে রয়েছেন হাসানাত আমিনী-মুফতি ফয়জুল্লাহরা।
হেফাজত ঘিরে নানা চিন্তা

হেফাজত ঘিরে নানা চিন্তাঃ হেফাজতের দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা মনে করছেন, হেফাজতকে নিয়ে স’রকারি মহলে নানামুখী চিন্তা-পরিকল্পনা আছে। স’রকারের কেউ কেউ চাইছেন, বর্তমান নেতৃত্বকে চা’পে রেখে হেফাজতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে; আবার কেউ কেউ পছন্দের লোকদের দিয়ে হেফাজত পুনর্গঠন করার পক্ষে। কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হোক কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এবং হাইয়াতুল উলয়া থেকে—এমন পরিকল্পনা নিয়েও ভেতরে-ভেতরে আলোচনা চলছে। আহম’দ শফীর মৃ’ত্যুর পর এই দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হন গুলশান আজাদ মসজিদের খতিব ও যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসান।

এসব বি’ষয়ে মাহমুদুল হাসানসহ বেফাক ও হেফাজতের পাঁচজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে চারজন ফোন ধরেননি। একজন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে এসব বি’ষয়ে কথা বলা মানে প্রশাসনের নজরে পড়া এবং বি’পদ ডেকে আনা। সূত্রঃ প্রথম আলো