গল্পঃ বাবা মা’রা যাওয়ার ১মিনিট পর

| আপডেট :  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৪:৫৬ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০১:২২ অপরাহ্ণ

ল’জ্জার মাথা খেয়ে যখন ছাত্রীর মায়ের কাছ থেকে মাসের অগ্রিম বেতনের টাকাটা চাইলাম। ছাত্রীর মা আমার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন। তারপর রুমের ভেতরে গিয়ে কিছুসময় পরে চকচকা ১৫০০ টাকা নিয়ে এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

—-এতে কি হবে?? বেতন ২০০০ টাকা। তার মধ্যে ৫০০ টাকা কম দিয়ে এই কথা বলা মানে, পানির মধ্যে অর্ধেক খানি চুবিয়ে রেখে শাস্তি দেওয়া একি কথা। কিন্তু তবুও আন্টির সামনে হাসি মুখ করে বললাম,

—জি আন্টি চলে যাবে। আন্টি কিছু না বলে কিচেনের দিকে চলে গেলেন। আমি তন্নীকে পড়ানো শুরু করলাম। আমি আনিকা। এবার বিবিএ ২য় বর্ষতে একাউন্টিং নিয়ে পড়ছি। ছোট থেকে স্যার সকল বলতো তোমার মাথা অনেক ভালো মা, তুমি চেষ্টা করো, ভবিষ্যতে কোন ভালো জায়গায় চান্স পেতে পারবা।

আমি তখন স্যারদের কথাতে হাসিমাখা মুখ নিয়ে বাড়িতে ফিরে আম্মুকে স্যারদের করা প্রশংসামুলক কথাগুলো শোনাতাম। আম্মা আমায় অনেক আশা দিলেও বাবা বলতো,

—মাইয়া মানুষ। ওতো পড়োন লেহোনের দরকার নাই। আমি তখন মন খারাপ করে ঘর থেকে বের হয়ে আসতাম। পুকুর তলায় বসে বসে কিছু সময় কান্না করতাম। তারপর স্যারদের কথা মনে করে মনে জোর পেতাম। তখন ভাবতাম বাবা যা বলার বলুক। আমি পড়বোই আর যেভাবেই হোক ভালো জায়গাতেই পড়বো।

ছোট থেকেই জেদে টইটুম্বুর হয়ে জন্ম নিয়েছিলাম। আম্মু মাঝে মাঝে বলতো, –মা, মাইয়া মাইনষের অতো রাগ, মেজাজ, জেদ ভালো না। তারপর আমরা গরিব মানুষ। আমি তখন আম্মুর দিকে চেয়ে বলতাম, বই এর কোন জায়গায় লেহা আছে, রাগ, জেদ, মেজাজ খালি বড় লোকদের থাকন লাগবো??

আমার প্রশ্ন শুনে আম্মা চুপ করে থাকতো। এক এক করে সবগুলো লেভেল ভালো ভাবেই পাড় করলাম। এসএসসিতে A+ আসলেও ইন্টারে গিয়ে মাত্র ৫ পয়েন্টের জন্য A+ আসলো না। মনটা খা’রাপ ছিল কিন্তু তারপরও আলহামদুলিল্লাহ বলেছিলাম।

এরপর নামলাম আসল যুদ্ধে, মানে ভর্তিযুদ্ধ।

আমার ফ্রেন্ডস সকলে ভালো জায়গায় কোচিং শুরু করলেও আমি করতে পারলাম না টাকার অভাবে। রাত্রে ঘুম আসতো না আমার। নিঃশব্দে কান্না করতাম। এত অভাবের মধ্যে কেনো পাঠাইলা আল্লাহ।শুধু ভাগ্যকে দোষ দিতাম।

পুরাতন লাইব্রেরি থেকে একটা পুরাতন বই কিনে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু পড়েও কোন লাভ হলো না। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফরম উঠানোর লাষ্ট ডেটটা শেষ হয়ে গেলেও আমি টাকা জোগার করতে পারিনি। জহাঙ্গিরনগরেরটা তুলতে পারলেও গাড়িভাড়া না থাকায় এক্সাম দিতে যেতে পারলাম না। ঐদিনে এতটা রাগ হয়েছিল যে বাবাকে সরাসরি বলেছিলাম,

–এক মাইয়ার জন্য কয়টা টাকা যোগাতে পারো না তে জন্মায়ছিলা ক্যা??

বাবা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, কিছু বলতে পারেনি। আম্মা আমায় টেনে বাহিরে নিয়ে এসেছিল।

রাত্রে বাবার কাছে গিয়ে বলেছিলাম,

–বাবা, আমায় ক্ষ’মা করো। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আরো কিছু বলার আগেই,

বাবা আমাকে লুঙ্গির গিট থেকে ১০ টাকা ৫ টাকার অনেকগুলো নোট বের করে গুনতে বলল। আমি গুনে দেখি ৩৪০ টাকা আছে সেখানে।

বাবাকে বললাম, বাবা ৩৪০ টাকা আছে।

বাবা আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলল, আমার কাছে এর চাইতে আর বেশি নাই রে মা।

আমি তখন অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি বাবার চোখে পানি। হাতের মধ্যে টাকাগুলো ফেরত দেওয়ার সময় বাবার হাতটা কেঁপে উঠল।
আমি বাবার হাতটা উল্টায়ে দেখি হাতে কড়া পড়ে গিয়েছে। অজান্তেই চোখে পানি চলে এল।

আমার বাবা একজন দিনমজুর। আর মা বাসাতেই চট বুনে সংসারের জন্য অতিরিক্ত আয় করার চেষ্টা করেন।

ঐ রাতটা ছিল আমার স্বপ্ন গুলোকে জীবন্ত কবর দেওয়ার রাত।

বাহিরে অমাবস্যার কালো অন্ধকারে নিজের চোখের জল দেখার মতো কেউ ছিল না। এত বছরের আশাকে ভেতরে মেরে ফেলা যে কতটা ক’ষ্টের সেটা শুধু সেই মানুষটাই বুঝতে পারে যেই মানুষটা এই অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে।

এরপরে, পয়েন্টের মাধ্যমে জাতীয় ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হই। বাবা জোর করে ভর্তি করায়ে দেয়। আমার তো পড়াশোনার ইচ্ছা /শখ সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাবাই আমাকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে এসে ভর্তি করায়ে দেয়। বাসা থেকে প্রায় ৪৫ কি.মি. দূরে কলেজ জন্য ইউনিভার্সিটির পাশেই একটা মেসে এসে উঠলাম। মাসে বাবা টেনেটুনে ১০০০ টাকা দিতে পারতো। আমি অনেক কষ্টে প্রাইভেট, টিউশনি যোগার করে পড়ানোর চেষ্টা করলেও, টিকে থাকতে পারতাম না। কারন বাচ্চাদের মা গুলো সবসময় বির’ক্ত করতো। মনে হতো সে আমার টিচার। আমাকে বলে দিতো,এই টা পড়াও ওইটা পড়াও। এইটা পড়াবা না। ওইটা পড়াবা না। একদিন বিরক্ত আর রাগে ছাত্রের মাকে বললাম,

–আন্টি, আপনি এত জানেন এত পারেন তো আমাকে রাখছেন কেন??

তারপর আর ও বাড়িতে যায়নি।

বর্তমানে যেই বাসায় টিউশনি করায় এখানে সব ফ্যাসিলিটি পেলেও মাস শেষে বেতন দিতে তালবাহানা করে। আর ২০০০ টাকার কিছুটা কম দিয়ে বলবে,

—চলবে এটা?? আসলে এবার তোমার আংকেলের একটু হাতের অবস্থা খারাপ আরকি!

হাতের অবস্হা শুধু বেতন দেওয়ার সময়েই কি খা’রাপ হয় নাকি?? গত কালকেও ৩০০০ টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে এনে আমায় দেখিয়ে বলে যে দেখতো কেমন হয়েছে??

তবে এই কথাগুলো আমি মনে মনে বলতাম।

বুঝি না। নিজে ক’ষ্ট করে টিউশনি করায়। নিজের মানসিক শ্রমের টাকাটা দিতেও ওনাদের এত তাল বাহানা। ভি’ক্ষা তো আর নিচ্ছি না।

একটা কথা ঠিকি বলতো আম্মু,

বড়লোক রা সার্থপর হয়। নিজের বেলায় ১৬ আনা বুঝে আর অন্যের বেলায় সিঁকি আনাও বুঝে না।

আজকে যেই অগ্রিম টাকাটা নিলাম এটার কারন আছে। গত দিন বিকেলে আম্মা ফোন করে বলল,

–তোর বাবার শরীর খারাপ। ঔ’ষধ কেনার টাকা নাই কি করবো আমি??

এই জন্য আজ ল’জ্জা শরমের মাথা খেয়ে তন্নীর মায়ের থেকে টাকাটা অগ্রিম নিয়ে নিলাম।

তন্নীকে পড়ানো শেষ করে, মেসের পাশের দোকানে গিয়ে বিকাশে ৫০০ টাকা সেন্ড করলাম। আম্মুকে আগেই বলে রেখেছিলাম জলিল কাকার থেকে বিকাশ নাম্বারটা নিয়ে আমায় দিতে। আম্মু নাম্বারটা নিয়ে জলিল কাকার কাছেই ফোন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমার কাছে বিকাশ নাম্বারটা জলিল কাকায় দিয়েছিলেন।

ফোন করে আম্মাকে বলেছিলাম,

— আম্মা, বাবার অবস্থা কেমন হয় আমায় কিন্তু জানাবা!

১৫০০ থেকে ৫০০ টাকা তো শেষ হয়ে গেল। এখন বাঁচে ১০০০ টাকা। মেস ভাড়াই ৮৫০ টাকা। যদি ভাড়াটা দেয় তো মাসটা চলবো কি করে??

৩ বেড শিটের বিছানায় আমি থাকতাম মাঝ বেডে। আমার রুমমেট ২ জন আধারাত অবধি ফোনে কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লে, আমি আমার পড়াশোনা শুরু করতাম। তবে নিঃশব্দে। চোখ বুলিয়ে। মোমবাতির আলোতে অনেকটা কষ্ট করেই আমাকে পড়তে হতো। কারণ টেবিল ল্যাম্প কেনার টাকা আমার কাছে ছিল না। আর এদিকে বড় লাইট জ্বালালে রুমমেট ২ জন মিলে অনেক কথা শোনাতো। আমি কিছু বলতে পারতাম না জুনিয়র জন্য। সেজন্য প্রতিরাতে আমার একটা করে মোমবাতি মানে প্রতিরাতে আমার ৫ টাকা করে যেত।

আজ রাত্রে কেমন যেন লাগছে। মনটাতে কেমন যেন অস্থির লাগছে। বাবার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। কেমন আছে জানিও না। ফোন দিবো?? কিন্তু আমার তো ফোন নাই। আর জলিল চাচা যদি ঘুমে থাকে??

সব চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ার দিকে মনোযোগ দিলাম। উফফ, না। ভাল্লাগছে না। কেমন যেন চোখে না চাইতেও জল চলে আসছে। বাবার কথা এত মনে পড়ছে কেন?? আর না পেরে রুমমেট কে জাগিয়ে তার ফোনটা থেকে কল দিতে বললে সে বলল, আমার ফোনে ব্যালেন্স নাই।

অন্যজনকে জাগিয়ে তুললে সে বলল, আমার ফোনতো বন্ধ। চার্জ নাই।

আমার তখন রাগ হয়ে যায়। কি কারনে রাগ হয় নিজেও জানি না। শুধু এটুকু জানি রাগ করে ওদের ২ জন কে বলেছিলাম,

–সারারাত অমানুষদের সাথে লুতুপুতু করে যাও। তখন টাকাও থাকবে সাথে ফোনে চার্জ ও।

২ জন চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।

আমি রুম থেকে বের হয়ে পাশের রুমে থাকা আমার ফ্রেন্ড তিসারে ডেকে তুলি। ওর ফোন থেকে কল দেই জলিল চাচার ফোনে। কিন্তু কেউ রিসিভ করে না। প্রায় সারারাতই আমি কল দিতে থাকি আর কান্না করতে থাকি। তিসা আমায় চুপ করতে বললেও আমি থামতে পারিনি।

শেষ রাত্রের দিকে জলিল চাচা ফোন রিসিভ করলে,

—হ্যালো, হ্যালো চাচা, বাবা কেমন আছে??

ওপাশ থেকে চাচার কোন কথা না পেয়ে আমি ভয় পেয়ে যায়। এবার জোরে চাচাকে ডাকলে চাচা বলে,

–মনু, তোর বাবা আর নাইরে।

আমার কানে শুধু কথা টা বাজঁছিলো। তিসা আমাকে বার বার ধাক্কা দিচ্ছে,

— কিরে, কি বলে চাচা?? তোর বাবা ঠিক আছে তো??

আমি কোন কথা বলতে পারি নি। তিসাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই। তিসা আমার কান্না দেখে বুঝেছিল খারাপ কিছু হয়েছে।

বাবাকে যখন খাটের উপর শেষ দেখা দেখি, আমার শুধু বাবার বলা ঐ কথাটা মনে পড়ছিল,

—মা’রে, এই কয়টা টাকা ছাড়া আর তো আমার কাছে নাই!

খাটের উপরে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম,

–বাবা, তোমার থেকে আমি আর কিছু চাইবো না। শুধু তুমি ফিরে এসো বাবা। আমি নিজে কাজ করবো তবুও তোমায় আর কাজ করতে দিবো না বাবা। ফিরে এসো বাবা, ফিরে এসো।

[অভাবের পরিসমাপ্তি ঘটলেও অভাবের কারনে হারিয়ে ফেলা মানুষ গুলোকে ভুলে যাওয়া কি এতটাই সহজ??]
#সংশোধনীয়
লেখাঃ তাসকিনা