এক বু’ক ‘ক’ষ্ট’ নিয়ে রাজধানী ছাড়ছেন বহুল আলোচিত স্মার্ট ঝালমুড়ি ওয়ালা

| আপডেট :  ৩১ জানুয়ারি ২০২১, ০৫:০৯ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৩১ জানুয়ারি ২০২১, ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, জুলহাস কেন পিছিয়ে থাকবে? প্রথমে লুঙ্গি পড়ে ঝাল মুড়ি বিক্রি করতাম। এখন পরিষ্কার ও স্মার্ট কাপড় পড়ে ঝাল মুড়ি বিক্রি করি। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের মতো আধুনিক বানাতে চায়। আমার কাছেও যারা ঝালমুড়ি খায়, তারা মনে করে সিঙ্গাপুর বসে খাচ্ছে।’

কেউ পরিচয় জানতে চাইলে এভাবেই নিজের ব্যাখ্যা দেন স্মার্ট ঝালমুড়ি ওয়ালা খ্যাত বহুল আলোচিত ব্যক্তি জুলহাস হাওলাদার। এই স্মার্ট ঝালমুড়ি ওয়ালাকে এবার চিরতরে হারাতে যাচ্ছে রাজধানীবাসী। ছেলের চিকিৎসা ও সংসারের হাল টানতে না পেরে এবার রাজধানীতে আর না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জুলহাস।

রাজধানীর শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ফুটপাতে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন জুলহাস। তার মুড়ি রাখার বস্তায় একপাশে রাখেন ফুলের মালা দিয়ে সাজানো বঙ্গবন্ধুর বাঁ’ধাই করা একখানা ছবি আর অন্য পাশে রাখেন তার বাবার মুক্তিযো’দ্ধার সনদের বাঁ’ধাই করা ফটোকপি। চোখে চশমা, কানে এয়ারফোন, চকচকে শার্ট, গ’লায় টাই, পায়ে কালো সু, পকে’টে মোবাইল ও কলম এবং হাতে সিলভার রংয়ের ঘড়ি পরেন জুলহাস। ৪৫ বছর বয়সের এই ব্যক্তি সর্বদা এমন পরিপাটি সাজে ঝালমুড়ি বিক্রি করে রীতিমত ভাইরাল।

১৯৭৫ সালের ১মে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজে’লার ধানকাটি গ্রামে জন্ম জুলহাসের। বর্তমানে তিন স’ন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের পেছনে ছোট একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি। তার পিতা মো. তছলিম হাওলাদার একজন মুক্তযো’দ্ধা ছিলেন। যু’দ্ধে বাংলাদেশ জয়ের পর এদেশীয় রাজাকারদের হাতে তার পিতার মৃ’ত্যু হয়েছে বলে দাবি জুলহাসের।

জুলহাস জানান, ‘বাবা যখন মুক্তিযু’দ্ধে অংশ নিতে যায় তখন দাদাকে এদেশীয় রাজাকাররা কুকুরের ভ্যাকসিন দিয়ে মে’রে ফে’লে। পরবর্তীতে দেশ জয়ের পর বাবা যখন ফিরে আসে তখন অন্যান্য মুক্তিযো’দ্ধাদের সঙ্গ নিয়ে ওইসব রাজাকারদের মে’রে ফেলা হয়। সেই রাজাকাদের বংশের লোকরাই পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক স’রকার ফখরুদ্দিন আহমেদের সময়ে আমার বাবা ও বড় ভাইকে হ’’ত্যা করে।’

তিনি জানান, ‘আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যু’দ্ধে যাওয়ার সময় ঘরে দু’মুঠো চাল ও ডাল পর্যন্ত রেখে যেতে পারেননি। যু’দ্ধের চার বছর পর আমার জন্ম হয়েছে। মানুষের বাসা থেকে ভাতের মাড়, জুটা খাবার কুড়িয়ে খেয়েছি। অভাবের কারণে লেখাপড়া করতে পারিনি। বাসা বাড়িতে কাজ করেছি, বিভিন্ন পেশার পর এখন স্মার্ট হয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করছি।’

পূর্বে গণমাধ্যমের নিউজ ও বিভিন্ন ইউটিউবারদের ভিডিওতে জুলহাস প্রধানমন্ত্রীকে নিজ হাতে ঝালমুড়ি বানিয়ে খাওয়ানোর সখের কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ঝালমুড়ি বানিয়ে খাওয়ানোর সখ পূরণ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জুলহাস বলেন, ‘না, এখনও আমি প্রধানমন্ত্রীকে নিজ হাতে ঝালমুড়ি বানিয়ে খাওয়াতে পরিনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাছ থেকে দুটো কথা বলতে পারলে আর তাকে আমার হাতে ঝালমুড়ি বানিয়ে খাওয়াতে পারলে আমি সবথেকে বেশি শান্তি পাবো। আমার বিশ্বাস একদিন আমি এ সখ নিশ্চয়ই পূরণ করতে পারবো। জননেত্রী ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, ভ্যানচালকের সঙ্গে কথা বলেছেন, আমার সঙ্গেও তিনি কথা বলবেন।’

বিশ্ব এখন ক’রোনা ভাই’রাসের প্রভাবে কলঙ্কিত। বাংলাদেশও এই পরিস্থিতির বাহিরে নয়। আগে পরিপাটি পোশাকে স্মার্ট এ ঝালমুড়ি বিক্রেতা জুলহাসকে ঘিরেই উৎসুক মানুষের ভিড় লেগে থাকতো। ক’রোনার কারণে এখন সেই ভিড় নেই। এ সময়ে ব্যবসা কেমন যাচ্ছে জানতে চাইলে জুলহাস বলেন, ‘ক’রোনায় ঝালমুড়ি আগের মতো এখন আর মানুষ খায় না। তাই বেচা-বিক্রি কম হওয়ায় রাজধনীতে টিকে থাকা’টা এখন আমার জন্য ক’ষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, আমার তিন স’ন্তানের মধ্যে বড় ছেলেটার একটা কঠিন রো’গ হয়েছে। যার চিকিৎসা এদেশে নেই। ওকে একটু ভালো খাবার খাওয়াবো তাও প্রতিদিন ব্যবস্থা করতে পারি না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামি দু’এক মাসের মধ্যে রাজধানী ছেড়ে চিরতরে গ্রামে চলে যাবো।’

গ্রামে গিয়ে স্মার্টভাবে ঝালমুড়ি বিক্রি করবেন কী, সেখানে কী রাজধানীর থেকে বেশি আয় করতে পারবেন জানতে চাইলে জুলহাস বলেন, ‘এতদিন গ্রামে ঘর ছিলো না। মা কিস্তিতে টাকা এনে আমার জন্য একটি ঘর তুলেছেন। আমি আমার পরিবার নিয়ে সেই ঘরে গিয়ে থাকবো। ঢাকায় বাসা ভাড়া দিতে হয়, শাক-সবজি থেকে শুরু করে সব কিছু কিনতে হয়। কিন্তু গ্রামে থাকলে আমি শাক-সবজী চাষ করতে পারবো। মাছ ধরতে পারবো। আর যে কাজ পাবো সেই কাজ করবো। সুযোগ হলে গ্রামে গিয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করবো।’

স’রকার গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছে, পুঁজিহীনদের ব্যবসা করতে ঋ’ণ দিচ্ছে এসবের কিছু পেতে আগ্রহী কীনা জানতে চাইলে জুলহাস জানান, ‘আমি স’রকারের কাছ থেকে দানের কিছু চাই না। আমি ভালোভাবে ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু ব্যবসা করার পুঁজি আমার নেই। স’রকার যদি আমাকে ব্যবসা করার জন্য সহজ শর্তে ঋ’ণের ব্যবস্থা করে দেয় তবে আমি ৫০টি ছাগল ও ১০০টি মুরগী পালবো। টাকা পেলে আমি এই ধরনের ব্যবসা করতে চাই। আমি স’রকারের থেকে দান চাই না, ঋ’ণ চাই।’

জুলহাসের বড় ছেলের কী ধরনের রো’গ হয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে স্ত্রী সুমা বেগম জানান, ‘আমাদের ৩ স’ন্তানের মধ্যে বড় ছেলেটা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় অ’সুস্থ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে ওর শরীরের সমস্ত শক্তি হা’রিয়ে ফেলছে। এখন ও উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। মাঝে মাঝে বসে থাকার অবস্থাতেও পড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তাররা ওর এই রো’গটিকে ‘ডুশিনি মাসকুলার ডিসট্রফি’ বলে জানিয়েছেন। তারা বলেছেন এই রো’গের চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই।’

সুমা বেগম আরও বলেন, ‘আমার স্বামী বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে শ্রদ্ধা করে বুকে ধারন করেছে। এজন্য আমিও আমার স্বামীকে সব সময় সম্মান করি। বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার কাছে আমার ছেলেটার সু-চিকিৎসার দাবি জানাচ্ছি। আমার স’ন্তানটি সুস্থ্য হলে এটাই হবে আমার সবথেকে বড় পাওয়া।’