ডলারের এতো রুপ

| আপডেট :  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:০৯ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:০৯ অপরাহ্ণ

মার্কিন ডলার নিয়ে এক ধরনের লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েছে দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্কিন মুলুকের এই মুদ্রাকে বাগে আনতে গিয়ে দেশের ব্যাংকগুলোকে নাজেহাল করার পাশাপাশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকেও নাস্তানুবাদ করা হয়েছে। তবুও নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গেছে এই মুদ্রার গতিপ্রকৃতি। শুধু তাই নয়, নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া এই মার্কিন ডলারকে ‘বহুরূপী’ হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বর্তমানে একই মুদ্রার মূল্য একেক জায়গায় একেক রকম। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এলে ডলারের দাম দেওয়া হচ্ছে ১০৮ টাকা। একই ডলার রফতানির মাধ্যমে এলে তার দাম দেওয়া হচ্ছে ৯৯ টাকা। যখন আমদানির জন্য দেওয়া হচ্ছে তখন মূল্য ধরা হচ্ছে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা। আবার ফ্রিল্যান্সারসহ বিদেশ থেকে আসা অন্যান্য আয়ে সর্বোচ্চ ৯৯ টাকা দাম দিচ্ছে। যদিও ফ্রিল্যান্সার ও ডলার আয় করা অন্যান্য খাতের কর্মজীবীরা তাদের আয়ের জন্য আড়াই শতাংশ হারে সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন। এছাড়া যখন কেউ বিদেশে চিকিৎসার জন্য ডলার কিনতে যাচ্ছেন তার কাছ থেকে রাখা হচ্ছে (খোলা বাজারে) ১১৪ টাকা।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) শীর্ষ নেতারা গত রবিবার এক সভায় বিভিন্ন লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করেন।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পৃথিবীর কোনও দেশেই একই মুদ্রার দাম একেক জায়গায় একেক রকম, এত ভিন্নতা, এত পার্থক্য নেই। দেখা যাচ্ছে, রফতানির ডলারের মূল্য সবচেয়ে কম অর্থাৎ ৯৯ টাকা। এতে রফতানিকারকরা নিরুৎসাহিত হবেন। এতে রফতানি কমে যাবে। আন্ডার ইনভয়েসিং (পণ্যের মূল্য কম ধরা হবে) বেড়ে যাবে। সরকার হারাবে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব।

এদিকে ব্যাংকগুলো নিজেরা ডলারের দাম নির্ধারণের পর কিছু আমদানিকারকের খরচ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে যারা সরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি করে থাকে। কারণ, সরকারি ব্যাংকগুলোও বেসরকারি ব্যাংকের মতো ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সোমবার আমদানি দায় পরিশোধে প্রতি ডলারের জন্য ১০৮ টাকা ৭৮ পয়সা পর্যন্ত দাম দিতে হয় আমদানিকারকদের, মঙ্গলবার যা ১১০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, সব ব্যাংকই ক্রেডিট কার্ড ও বিদেশে শিক্ষার্থীদের খরচ পাঠাতে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাফেদা ও এবিবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ক্রেডিট কার্ড ও বিদেশে শিক্ষাখরচে প্রতি ডলারের দাম হবে ব্যাংকের নগদ ডলার বিক্রির দামে। এ কারণে গত রবিবার থেকেই ব্যাংকগুলো এই দুই খাতে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নাগরিকদের পাশাপাশি বিদেশে উচ্চশিক্ষায় পাঠানো অভিভাবকদের খরচ বেড়ে গেছে।

ডলারের দামে ভিন্নতা তৈরি হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন তৈরি পোশাক শিল্পের নিট পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স ক্রয়ে ১০৮ টাকা দেওয়া সম্ভব হলে রফতানি আয়ে ৯৯ টাকা হবে কেন? তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এ দর কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হলো। এখানে চরম বৈষম্য করা হয়েছে। এতে দেশের ১৭ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সিদ্ধান্তের কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ডলার ক্রয় এবং বিক্রিতে এক টাকার পার্থক্য থাকতে পারে। এর বেশি নয়। তিনি মনে করেন ডলারের দাম নির্ধারণের পূর্ণ ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকা উচিত। তা না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।

অবশ্য বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম বলেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে রফতানিকারকরা লোকসানে পড়বেন না। কারণ তারা রফতানি খাতে প্রণোদনা পেয়ে থাকেন। এছাড়া ডলারের এই দাম চিরস্থায়ী নয়। সময়ে সময়ে বদলাবে। ঘোষিত দামে আপাতত পাঁচ কার্যদিবস চলবে। তারপর আবার সংশোধন করা হবে।

এদিকে কিছু দিন আগেও ডলারের দর ৫০ পয়সা বাড়ানোই যেখানে বড় সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছিল কিছুদিন আগে, সেখানে এবার এক দিনে বাড়ল ১০ টাকার বেশি। গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এই মুদ্রাটির বিনিময় হার ঠিক করে দিয়েছে ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা। আগের দিন দাম এক টাকা বেড়ে হয়েছিল ৯৬ টাকা। অর্থাৎ এক দিনে বাড়ল ১০ টাকা ১৫ পয়সা বা ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

এদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো আগে আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম ১০০ টাকার নিচে রাখলেও নতুন সিদ্ধান্তের ফলে তারাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মঙ্গলবার সোনালী ব্যাংক আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারের দাম নিয়েছে ১০৭ টাকা ৫৮ পয়সা, জনতা ব্যাংক ১০৬ টাক ১৫ পয়সা ও অগ্রণী ব্যাংক ১০৪ টাকা ১৫ পয়সা। অথচ গত সপ্তাহেও ডলারের দাম ১০০ টাকার নিচে ছিল। এছাড়া পূবালী ও ন্যাশনাল ব্যাংকে ডলারের গড় ক্রয়মূল্য ছিল ১০৯ টাকা, ইসলামী ও সিটি ব্যাংকে ছিল ১১০ টাকা।