নেত্রী বটে! কি পারেন না তিনি?

| আপডেট :  ২১ আগস্ট ২০২২, ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২১ আগস্ট ২০২২, ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

তিনি কি পারেন না? তিনি সিট না দিলে কেউ দিতে পারবে না সিট। হুঙ্কার দিয়ে বলেন, ক্ষমতা আছে ম্যাডাম’দের? ক্ষমতাবান এই নেত্রীর নাম তামান্না জেসমিন রীভা। তিনি রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি। সম্প্রতি তার একটি অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই নিয়ে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।

অডিওটিতে শোনা যায়, কলেজের এক ছাত্রীনিবাসের শিক্ষার্থীকে বের করে দেয়ার হু’মকি দিচ্ছেন তিনি। সমপ্রতি কলেজের রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের ২০২ নম্বর কক্ষে ঘটনাটি ঘটে। হু’মকি দিতে গিয়ে তামান্না ছাত্রীদের বলেন, আমি যদি একটা সিট না দিই, তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডাম’দের? রেকর্ডটিতে আরও বলতে শোনা যায়, বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং করতেছিস। এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ধইরা ছিঁড়া ফেলমু। চার মাস হয়ে গেছে ফাইজলামি শুরু করছিস।

তোরা লিগ্যাল তাতে আমার…। কোন হ্যাডাম দেখাইতেছিস তোরা? আমার পলিটিক্যাল রুমে তোরা লিগ্যাল থাকবি কিনা, সেটা তোদের বি’ষয়। কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস? বুঝিস না, পলিটিক্যাল রুমে থাকিস। তোদের লিগ্যাল করাইছে, তাতে আমার…? আমি যদি একটা সিট না দেই, ২০২ থেকে তোদের কোন বাপ সিট দেবে? মূলত ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ না দেয়াতেই এই হু’মকি দেন তামান্না।

এক পর্যায়ে পাশ থেকে এক ছাত্রী বলেন, ও তো অ’সুস্থ, বাসায় গেছে। জবাবে তামান্না বলেন, ২০২-এ আর লিগ্যাল কে? তোরা লিগ্যাল, তাতে আমার কি? আমি কি…তোদের? ম্যাডাম’দের ক্ষমতা আছে, আমাদের রুম থেকে একটা মেয়েকে বের করার? ইডেন কলেজের প্রিন্সিপালেরও ক্ষমতা নেই এই রুম থেকে একটা মেয়েকে বের করার। রুমটা যেহেতু ইডেন কলেজের প্রে’সিডেন্ট নিয়ে নিছে, ইডেন কলেজের প্রে’সিডেন্টের ও’পরে আর কেউ নাই। একদম গ’লায় পাড়া দিয়ে ধরতে ইচ্ছা করতেছে।

ওই বক্তব্যের বি’ষয়ে জানতে চাইলে তামান্না জেসমিন বলেন, মেয়েরা অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়ায় তাদের শাসন করেছি। রুম থেকে শিফট করার কথা বলেছি। আবার এই ঘটনায় ক্ষমা চেয়ে স্ট্যাটাসও দেন তিনি। শুক্রবার রাতে তার স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মীর সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। এরা আমার পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। একান্ত ব্যক্তিগত পরিবেশে হলেও দায়িত্বশীল জায়গা থেকে অসংযত ভাষার প্রয়োগ আমার অ’পরাধ হয়েছে বলে স্বীকার করছি।

ছাত্রলীগ আমাকে এমন শিক্ষা দেয় না। তাই সংগঠনের প্রতি আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আবার এই ছাত্রলীগের কমিটি নিয়েও ক্ষো’ভ আছে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মাঝে। যা গড়িয়েছিল আন্দোলন পর্যন্ত। চলতি বছরের মে মাসে ছাত্রলীগের নবগঠিত কমিটির সভাপতি তামান্না জেসমিন ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বি’রুদ্ধে বি’ক্ষো’ভ করেন কলেজ শাখার শীর্ষ পদপ্রত্যাশী অন্য নেত্রী ও তাদের অনুসারীরা। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা এ বি’ক্ষো’ভে কলেজ ক্যাম্পাসে উ’ত্তেজনা সৃষ্টি হলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল সেসময়। ইডেন মহিলা কলেজের ছয়টি ছাত্রীনিবাস রয়েছে। এগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

হলের শিক্ষার্থীরা বলেন, তাদের কথামতো চলতে হয় আমাদের। হলে সিট নিয়ে থাকলে দিতে হয় ভাড়া। সেইসঙ্গে সিট পাবার জন্য স্বর্ণের অলঙ্কারও চাওয়া হয়েছে। হলের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, হলে সিট পেতে দুইভাবে আবেদন করতে হয়। এক রাজনৈতিকভাবে এবং স্বাভাবিক নিয়ম মেনে। হলের অনেক রুম নেত্রীরা দ’খল করে ভাড়া দেন। হলের প্রতিটি রুম আট সিটের। কোনো একজন নেত্রী একজনের জন্য কলেজের কাছে বরাদ্দ নিয়ে পুরো রুমটা দ’খলে নেন।

এরপর বাকি সিটগুলো ভাড়া দেন। তিনি আরও বলেন, ম্যাডামরা রাজনৈতিক রুমে যেতে পারেন না। আমাদের রুমে হিটার রাখার কোনো নিয়ম নাই। আমাদের রুমগুলোতে প্রায়শই ম্যাডামরা চেক করেন হিটার, হেয়ার ড্রায়ার, ইলেকট্রিক কেটলি ইত্যাদি আছে কিনা। থাকলে ভে’ঙে ফেলা থেকে শুরু করে শা’স্তি দেয়া হয়। কিন্তু ম্যাডামরা ওই রুমগুলোতে যান না বা যাবার সাহস পান না। ওসব রুমে খুঁজলে প্রতিটা রুমেই হয়তো হিটার পাওয়া যাবে। রাজনৈতিকভাবে হলে সিট পাওয়া আরেক শিক্ষার্থী বলেন, প্রথম বর্ষে সাধারণ রাজনৈতিক বা ভাড়া রুম ছাড়া হল মেলে না।

কিন্তু আমরা রাজনৈতিকভাবে প্রথম বর্ষেই হলের সিট পাই। আমার কাছে ভাড়া নেয় বছরে ১২ হাজার টাকা অর্থাৎ মাসে এক হাজার টাকা। অনেকের কাছে এর থেকে বেশি বা কমও নেয়া হয়। যার থেকে যেরকম পাওয়া যায়। আবার রুম পাবার পর উপহার দিতে হয় নেত্রীদের। যেমন আমাদের বলে দিয়েছিলেন স্বর্ণের চেইন দেয়ার জন্য। আমরা এরপর সকলে টাকা তুলে সাড়ে আট হাজার টাকা দিয়ে চেইন দেই। অনেকে উপহার হিসেবে টাকা, দামি সামগ্রী ইত্যাদির কথা বলে থাকেন। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের ভবি’ষ্যৎ পদপ্রত্যাশী এক কর্মী বলেন, ইডেনের সব হল মূলত সভাপতি, সম্পাদকসহ অন্য নেতারা নিয়ন্ত্রণ করেন। আমার আন্ডারে একটি রুম আছে। আমি কলেজকে একটা রুমের ভাড়া দেই।

আর বাকি সাত সিটের আমি ভাড়া তুলি। আমাকে প্রতি ছয় মাস পরপর ২০ হাজার টাকা নেত্রীদের দিতে হয়। এই অর্থ না দিলে আমার আন্ডারে রুম থাকবে না। সভাপতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হল শাসন করতে গেলে এগুলা একটু করতে হয়।’ প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, রাজনৈতিক রুমে থাকার অসুবিধা তো আছেই। বড়দের বাইরে কথা বলা যায় না। পানি এনে দেয়া, রান্না করা, রুম পরিষ্কার করা, কাপড় ধুয়ে দেয়া এসব করে দিতে হয়। আর সবসময় একটা ভ’য়ে থাকতে হয়। আর অনুষ্ঠানে তো অবশ্যই যেতে হয়। তিনি বলেন, গালাগালি বড় আপুদের নিয়মিত ঘটনা। এ ছাড়াও চড় দেয়া, রুম থেকে আলাদা করে দেয়া ইত্যাদিসহ মা’নসিক ভীতির মধ্যে রাখেন।