আনারকলির কথিত গৃহকর্মী ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাব্বির এবং বাবুর্চি দু’জনই একই পথে হেঁটেছেন

| আপডেট :  ৫ আগস্ট ২০২২, ০৯:০৮ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৫ আগস্ট ২০২২, ০৯:০৮ পূর্বাহ্ণ

বাসায় নি’ষিদ্ধ মা’দক মারিজু’য়ানা রাখার অ’ভিযোগে জাকার্তা থেকে প্রত্যাহার হওয়া উপ-রাষ্ট্রদূত কাজী আনারকলির অতীত রেকর্ড পর্যালোচনা করছে স’রকারি ত’দন্ত কমিটি। যদিও ইন্দোনেশিয়ার ঘটনার বি’ষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি গতকাল ত’দন্ত কমিটির কাছে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন।

তার বক্তব্য আমলে নেয়া হলেও অতীতের অন্য অ’পরাধের বি’ষয়গুলো রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পররাষ্ট্র ম’ন্ত্রণালয়ের স’চিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামসের নেতৃত্বাধীন কমিটির সামনে বৃহস্পতিবার বিকালে সশরীরে হাজির হয়ে আনারকলি মারিজু’য়ানা কাণ্ড নিয়ে তার প্রাথমিক বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি কি বলেছেন তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, অতীতের অ’পরাধের বি’ষয়গুলোও খতিয়ে দেখছে ত’দন্ত কমিটি।

সূত্র মতে, আনারকলি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যানজে’লেস-এ পোস্টিংয়ে যাওয়ার সময় ৩৯ বছর বয়সী সাব্বির নামের যে যুবককে তার ‘কথিত’ গৃহকর্মী পরিচয়ে সঙ্গে নিয়েছিলেন তার ব্যাপারে ম’ন্ত্রণালয়ের সেই সময়ের কর্মকর্তারা আগাগোড়ায় সন্দিহান ছিলেন। এমনকি ঢাকাস্থ মা’র্কিন দূ’তাবাসও তাকে স’ন্দেহ করেছিল এবং সাব্বিরের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল।

কিন্তু সেই সময়ে ম’ন্ত্রণালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বর্তমান থাকা (ডিরেক্টর পারসোনাল) কাজী আনারকলি সাব্বিরের ভিসার জন্য পা’গলপ্রায় হয়ে ছোটাছুটি করছিলেন। তিনি আমেরিকাস অনুবিভাগের মহাপরিচালকে অনুরোধ করা ছাড়াও ডিরেক্টর এমনকি আমেরিকাস অনুবিভাগের দু’জন ডেস্ক অফিসারের ও’পর অব্যাহত চা’প তৈরি করেছিলেন সেই ভিসা নিশ্চিতে তদবির করতে। তার চা’পেই মূলত তারা দিনের পর দিন তদবির এবং ফলোআপে বা’ধ্য হয়েছিলেন।

অবশ্য পররাষ্ট্র ম’ন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুরোধে মা’র্কিন দূ’তাবাস অবশেষে সাব্বিরের ভিসা ইস্যু করে। এ নিয়ে গতকাল আলাপে এক কর্মকর্তা বলেন, কাজী আনারকলি যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যানজে’লেসে ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি তার স’ন্তান এবং একজন যুবক বয়সী পুরুষকে কাজের লোক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে ভিসা আবেদন করেন।

তখন অনেকেই সেই কথিত গৃহকর্মীকে তার ঘরের কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া এবং এক বাড়িতে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এটা তার ব্যক্তিগত বি’ষয় ধরে নিয়ে ম’ন্ত্রণালয় তাকে আ’টকায়নি বরং ভিসা পেতে সর্বাত্মক সহায়তা করে। ওই কর্মকর্তা এ-ও বলেন যে, কাছাকাছি সময়ে লসঅ্যানজে’লেসস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে উচ্চ পদে নিয়োগ পাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তার কথিত বাবুর্চির ভিসা আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছিল মা’র্কিন দূ’তাবাস।

সেই ‘বাবুর্চি’র কাছে বিরিয়ানি রেসিপি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন ভিসা অফিসার। তিনি সেটি বলতে পারেননি বলে তার ভিসা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে মর্মে নিজেই ম’ন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন ওই বাবুর্চি। অবশ্য আনারকলির কথিত গৃহকর্মীর ভিসা দেয়ার পর সেই বাবুর্চির ভিসার অনুরোধ আমলেও নিয়েছিল দূ’তাবাস।

ম’ন্ত্রণালয়ের কাছে থাকা রিপোর্ট বলছে, আনারকলির কথিত গৃহকর্মী সাব্বির এবং সেই বাবুর্চি দু’জনই একই পথে হেঁটেছেন। তারা আমেরিকায় অ’বৈধভাবে থেকে গেছেন, যা ম’ন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তিকে চ’রমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে।

সাব্বিবের পরিচয়ঃ লসঅ্যানজে’লেসে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল কাজী আনারকলির বি’রুদ্ধে স্টেট ডিপার্টমেন্টে নালিশ করে স্টে পারমিট জোগাড় করা কথিত গৃহকর্মী সাব্বিরের বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজে’লার পিপড়াকাঠি। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল উনচল্লিশ বছর। তিনি গৃহকর্মী পরিচয়ে গেলেও আদতে ছিলেন আনারকলির বন্ধু।

ঢাকায় থাকা অবস্থাতেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়। এমনকি মন দেয়া-নেয়ার সম্পর্কও। তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সুযোগ ছিল ‘গৃহকর্মী’ পরিচয়, সেটাই কাজে লাগিয়েছেন আনারকলি। ঘনিষ্ঠ মহলে বলাবলি আছে অর্থবিত্ত এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী সাব্বির সেই সময় তার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাবদ প্রায় ১৭ লাখ টাকা দিয়েছিলেন আনারকলিকে। যা তিনি পরবর্তীতে ফেরত পেতে চেষ্টা করেন।

উল্লেখ্য, আনারকলির বি’রুদ্ধে মানবপা’চারসহ বহু গু’রুতর অ’ভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তা কখনোই ত’দন্ত হয়নি। এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক তার সম্পর্কে বলেন, চাকরির শুরু থেকেই বিভিন্ন অ’পকর্ম করে বারবার পার পেয়ে গেছেন আনারকলি। এ কারণেই আজকে এমন অবস্থায় পড়তে হয়েছে।

পররাষ্ট্র ম’ন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আনারকলি ২০০০ সালে তখনকার আওয়ামী লীগ স’রকারের শেষ সময়ে মুক্তিযো’দ্ধার স’ন্তান হিসেবে আবেদন করে চাকরি লাভ করেন। ক্ষমতার পালাবদলেও তার প্রতাপ কমেনি। ২০০১-২০০৩ সালে তিনি ম’ন্ত্রণালয়ের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট সহকারী স’চিব (রাষ্ট্রাচার ভ্রমণ) ছিলেন। সেসময় তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। যার এক পর্যায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এডিসি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসার হাসনাতের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।

যদিও ম’ন্ত্রণালয়ের সবাই ওই অ’বৈধ সম্পর্কের কথা জানতেন, তবে ভ’য়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেননি। এরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সুপারিশে সিনিয়র অনেক কর্মকর্তাকে টপকে পররাষ্ট্র ম’ন্ত্রণালয় আনারকলিকে বৃটেনে স্কলারশিপ দেয়। এমন অবস্থায় আনারকলি তার স্বামীকে রেখে এবং ‘প্রেমিক’ এডিসি হাসনাত নিজের স্ত্রী-স’ন্তান ও চাকরি রেখে আনারকলির সঙ্গে লন্ডনে চলে যান, তখনো তাদের বিয়ে হয়নি। লন্ডনে তারা একসঙ্গেই বসবাস করতে থাকেন।

তখন হাসনাত কূটনীতিকের স্বামী হিসেবে বিভিন্ন সুবিধাও পান। আনারকলির এহেন কাণ্ড মুখে মুখে থাকলেও তার বি’রুদ্ধে ম’ন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা তো নেয়-ই নি, বরং পড়াশোনা শেষ করার পর তাকে হংকংয়ে ভাইস কনসাল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে আনারকলি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে বি’বাদে জড়ান। চ্যান্সারি কমপ্লেক্সেই তাদের মধ্যে হাতাহাতি-মা’রামারির ঘটনা ঘটে।

এ অবস্থায় আনারকলির দ্বিতীয় স্বামী হাসনাত তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবং ম’ন্ত্রণালয় সম্পূর্ণভাবে আনারকলিকে দায়মুক্তি দিয়ে ইতালির রোমে পোস্টিং দেয়। আর বিবা’দী তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে শা’স্তি দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনে। এরইমধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, আবারো ক্ষমতায় ফিরে আওয়ামী লীগ। আনারকলি ফিরেন তার স্বরূপে!

তখন বিএনপি স’রকারের সময়ের প্রধানমন্ত্রীর এডিসি হাসনাতের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়। এবার তিনি ক্ষমতাসীন বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন, তার পুরনো পরিচয় ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী হিসেবে। আনারকলি বিভিন্ন ছাত্রনেতা ও ক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন।

ফলে ২০১২ সালে দেশে ফিরে এসে প্রায় দীর্ঘ চার বছর তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাবান পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে কাজ করেন। সে সময় আনারকলির বি’রুদ্ধে সহকর্মীদের সঙ্গে দু’র্ব্যবহার, অযথা হ’য়রানি, ক্ষমতার অ’পব্যবহারে, পোস্টিং প্রমোশনে দু’র্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতাসহ অসংখ্য অ’ভিযোগ ওঠে। কিন্তু এগুলোতে ম’ন্ত্রণালয় কান না দিয়ে কাজী আনারকলিকে যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যানজে’লেসে ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়।