হাওয়া রিভিউ: প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তি কি মুগ্ধতা, নাকি হতাশা?

| আপডেট :  ৩০ জুলাই ২০২২, ১০:২১ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৩০ জুলাই ২০২২, ১০:২১ অপরাহ্ণ

হাওয়া সবার ভালো লাগবে না। যারা স্লো বার্নিং কন্টেন্ট পছন্দ করেন না, তারা প্রথমার্ধে একটু বিরক্ত হতে পারেন। তাহলে হাওয়া কাদের সিনেমা? ভালো লাগার কী কী উপকরণ আছে এতে? এভারেস্টসম এক্সপেক্টেশনের বিপরীতে হাওয়া আসলে কতটুকু প্রতিদান দিতে পারলো?

হাওয়া নিয়ে একটা ভয় খুব বেশি ছিল। মেজবাউর রহমান সুমন কখনও ‘গণমানুষের’ জন্য কন্টেন্ট বানাননি। তার কন্টেন্টের একটা নির্দিষ্ট দর্শক আছে। যারা নাটক-সিনেমা বোঝেন, অভিনয়ের খুঁটিনাটি ধর‍তে পারেন, তাদের কাছে ভালো লাগবে সুমনের কাজ। ‘হাওয়া’ মুক্তির আগে সুমন বলেছেনও, তার এই সিনেমা অনেকের ভালো না-ও লাগতে পারে।

ভয়ের কারণও আসলে এটাই। মুক্তির আগে হাওয়া নিয়ে যা হয়েছে, সেটা এক কথায় অবিশ্বাস্য। হাশিম মাহমুদের গান দিয়ে হাওয়া পৌঁছে গেছে সব ঘরানার দর্শকের কাছে। উত্তুঙ্গ একটা হাইপ তৈরি হয়েছে, যেটা বাংলাদেশী সিনেমা এর আগে কখনও দেখেনি৷ সিনেপ্লেক্সের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক শো নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে হাওয়া,

দুই-তিন দিনের অগ্রিম টিকেট গায়েব হয়ে গেছে, লোকজন ব্ল্যাকে টিকেট কেনাবেচা করছে- গত এক যুগ ধরে বাংলা সিনেমা ফলো করে থাকলেও এই ব্যাপারগুলো অদ্ভুত মনে হবে যে কারো কাছেই। এতে করে যারা হাওয়ার অডিয়েন্স নয়, তারাও হাওয়া নিয়ে আগ্রহী হয়েছে, টিকেট কিনেছে। সিনেমাটা তাদের ভালো না লাগলে গালি একটাও যে মাটিতে পড়বে না, এটা তো জানা কথা।

এভারেস্টসম এক্সপেক্টেশনের বিপরীতে হাওয়া আসলে কতটুকু প্রতিদান দিতে পারলো? সিনেমাটা শেষ করার পর মনে হয়েছে, পুরোপুরি পেরেছে। ভিজ্যুয়ালি এমন মনোমুগ্ধকর সিনেমা সবশেষ কবে দেখেছি, মনে পড়ছে না। টেকনিক্যালি অনেক সমৃদ্ধ এই সিনেমা।

মেজবাউর রহমান সুমনের পরিচালনা, কামরুল হাসান খসরুর সিনেমাটোগ্রাফি, রাশিদ শরীফ শোয়েবের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, চঞ্চল-নাসির কিংবা শরিফুল রাজ-তুষির অভিনয়ও অনেকদিন মনে রাখার মতো৷ হাওয়া নিশ্চিতভাবেই ২০২২ সালের সেরা সিনেমা হবার দৌড়ে সবার আগে থাকবে, পারফরম্যান্সের দিক থেকেও হাওয়ার আর্টিস্টরাই এগিয়ে থাকবেন বাকিদের তুলনায়।

সিনেমার গল্প খুব আহামরি কিছু নয়। মাঝ সাগরে মাঝ ধরতে যাওয়া একদল জেলের গল্প। যাদের সর্দার চাঁন মাঝি। হাওয়ার এই গল্পে উত্থান আছে, পতন আছে। আছে রহস্য, প্রেম, এবং প্রতিশোধের উপস্থিতি। মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া যেন মনসামঙ্গল কাব্যের এক আধুনিক রূপ, যেখানে চান সওদাগর হয়ে উঠছেন চান মাঝি। এই গল্পে বেহুলা নেই, লখিন্দর নেই, নেই সনকা’ও। এই গল্প চান সওদাগর এবং গুলতির, যাকে মনসার আরেক রূপ ভাবলে ভুল হবে না বোধহয়। মনসামঙ্গলের চান সওদাগরের মতো চান মাঝিও একরোখা, জেদি, খানিকটা গোঁয়ারও। আর গুলতি, তিনি মনসারই প্রতিবিম্ব, বুকের ভেতর ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকা প্রতিশোধের নেশায় মত্ত। সেই গল্পে একাত্ম হয়ে যায় ইব্রাহিম, এজা, উরকেস, পারকেস বা নাগুর মতো মানুষেরা।

হাওয়ার দুই অর্ধকে দুটো আলাদা ভাগে ভাগ করা উচিত। স্লো বার্নিং ফার্স্ট হাফে ক্যারেক্টার বিল্ডাপ হয়েছে, রহস্য জমেছে, হাসির উপকরণ ছিল বেশি। দ্বিতীয়ার্ধ অনেক বেশি দ্রুতগতির, এবং গল্পটাও সিরিয়াস একটা অ্যাটিট্যুড ধরে রেখে এগিয়েছে পরিণতির পথে। মনসামঙ্গল যারা পড়েছেন, তারা শেষের আগেই হয়তো ক্ল্যাইম্যাক্স খানিকটা আন্দাজ করে নিতে পারবেন৷ কিন্তু সুমন এত সুন্দরভাবে প্রেজেন্ট করেছেন গোটা বিষয়টাকে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে ইচ্ছে করে না পুরোটা মুহূর্ত৷ এমনকি স্মৃতি ধরে রাখার জন্য দু’চারটে ছবি তোলার কথাও ভুলে যেতে হয়। এটাই নির্মাতার সার্থকতা।

হাওয়া অনেকগুলো জায়গাতেই সফল। সবার আগে বলতে হবে অ্যাক্টিং স্কিলের কথা। এই জায়গাটায় হাওয়া নিখুঁত, কোন আপোষই করেনি। পাসিং শট বা এক-দুই ডায়লগের সিকোয়েন্সে যারা ছিলেন, তারাও দারুণ করেছেন। অভিনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবশ্যই চঞ্চল চৌধুরী৷ ক্যারেক্টারের ভেতর ঢুকতে খানিকটা সময় লেগেছে বলে মনে হয়েছে দর্শক হিসেবে, কিন্তু মিনিট বিশেক যাওয়ার পর পর্দার ‘চান মাঝি’র ওপর থেকে দৃষ্টি সরানো যায়নি। প্রবল বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়েও পান খাওয়া ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে এভাবে ‘ভয় পাচ্ছিস’ ডায়লগ দেয়া একমাত্র তার মতো অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব! আর কেউ পারবে না এটা। হ্যাটস অফ টু দিজ ম্যান অ্যান্ড হিজ অ্যাক্টিং ক্রাফট! তবে চঞ্চলের ভাঙা গলার ভয়েজওভারটা একটু কানে লেগেছে, ডাবিংয়ের সময় এই জায়গাটা নিয়ে আরেকটু কাজ করা যেতো বোধহয়।

নাজিফা তুষি ওয়াজ নট অ্যা ‘শো পিস আইটেম’। দুয়েকটা জায়গায় সংলাপ কিংবা উচ্চারণে একটু ছন্দপতন ঘটলেও, গুলতিকে তিনি ম্লান হতে দেননি চঞ্চল বা নাসিরের মতো মেথড অ্যাক্টরের সামনে। একই কাজটা শরিফুল রাজও করেছেন- নিজের চরিত্রের প্রতি শতভাগ জাস্টিস। সুমন আনোয়ার চমৎকার; সোহেল মন্ডল বা রিজভি রাজুর করার কিছু ছিল না তেমন, তবুও বেশ ভালো লেগেছে তাদের উপস্থিতি। নাসিরউদ্দিন খানকে মহানগরে দেখে চমকে উঠেছিল সবাই। পরাণে দেখে মনে হয়েছে, এটাই তার ক্যারিয়ার সেরা অভিনয়। সিন্ডিকেট দেখে মনে হয়েছে, আরে, এবার তো সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলেন! হাওয়া দেখলেও একই অনুভূতি কাজ করবে। কোনটা যে নাসিরের ‘বেস্ট পারফরম্যান্স’, সেটা খুঁজে বের করাটা ক্রমশ কঠিন বানিয়ে ফেলছেন এই ভদ্রলোক।

হাওয়া এক সিনেমায় অনেকগুলো ছক্কা হাঁকিয়েছে। সবচেয়ে বড় ছক্কাটা মেরেছেন কামরুল হাসান খসরু। হাওয়ার সিনেমাটোগ্রাফার তিনি। সাগরকে এত সুন্দর করে তুলে এনেছেন সিনেমায়, একেকটা ফ্রেম যেন ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার মতো একেকটা কবিতা। বাংলাদেশী সিনেমায় এই লেভেলের স্মার্ট সিনেমাটোগ্রাফি আগে কখনও দেখিনি, ভবিষতে কবে দেখব সেটাও জানিনা। এই লাইনটা কোনো রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই লিখে দিলাম। হাওয়ার সিনেমাটোগ্রাফি নিঃসন্দেহে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডকে ছুঁয়েছে। রাশিদ শরীফ শোয়েবের করা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কানে আরাম দিয়েছে। সাগরের ঢেউয়ের আওয়াজ আর বাতাসের ছন্দ যেন সুর হয়ে বেজেছে কানে। আরেকটা জায়গায় প্রশংসা পাওয়ার মতো কাজ হয়েছে হাওয়ায়- সেটা কস্টিউম। প্রত্যেকের পোশাকে যার যার অভিনীত চরিত্রের ছাপ ফুটে উঠেছে, কাউকেই বেমানান লাগেনি একটুও।

মেজবাউর রহমান সুমনের কন্টেন্ট মানেই মেটাফোরের ছড়াছড়ি। হাওয়াতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সমাজে নারীর উপস্থাপন নিয়ে যে বক্রোক্তি, সেটাকেও স্পষ্ট করেছেন নির্মাতা। ‘মাইয়া মানুষ নৌকায় রাখা যাইবো না’- সংলাপের মাধ্যমে ট্রলারে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকা বা মাছ না পাওয়ার দোষ গুলাতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার রূপকগুলো যেন নারীর প্রতি সমাজের অসহিষ্ণু আচরণকেই ইঙ্গিত করে। ডাইনি হিসেবে নারীদের পুড়িয়ে মারা মধ্যযুগের ইউরোপ যেন ফিরে আসে বঙ্গোপসাগরের বুকে ভেসে বেড়ানো নৌকায়। খুব স্বাভাবিক রূপেই এই বিষয়গুলোকে গল্পে জায়গা দিয়েছেন সুমন, সমাজ নারীকে নিয়ে যা ভাবে, যেভাবে ভাবে, যে দৃষ্টিতে একজন নারীকে দেখে- সেটাকেই স্পষ্ট ভঙ্গিমায় তিনি তুলে এনেছেন হাওয়ায়।

হাওয়া সবার ভালো লাগবে না। যারা স্লো বার্নিং কন্টেন্ট পছন্দ করেন না, তারা প্রথমার্ধে একটু বিরক্ত হতে পারেন। তাছাড়া হাওয়া সাগরের সিনেমা, সাগরে ভেসে থাকা মাছ ধরা এক ট্রলার আর সেই ট্রলারের কিছু নাবিকের গল্প বলেছে এই সিনেমা। সেখানে চটকদার কিছু প্রত্যাশা করে লাভ নেই। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাগরেরই বিচরণ, মাঝ দরিয়াতেই এই গল্পের সমাপ্তি। মাঝখানে চমকে যাওয়ার উপকরণ নেই, হতভম্ব করে দেয়ার মতো টুইস্ট নেই হাওয়ায়। কিন্তু সাদামাটা সুন্দর গল্পের দারুণ উপস্থাপন যদি দেখতে চান, তাহলে হাওয়া আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে ভালোভাবেই। অন্যথায় হতাশ হলেও হতে পারেন। সেটার দায়ভার নির্মাতার নয়, একান্তই দর্শকের।

ব্যক্তিগতভাবে আমি হাওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট। ভীষণভাবে সন্তুষ্ট। গত কয়েক বছরে শুক্রবারগুলো আতঙ্কে রূপ নিয়েছিল। জীবনে একেকটা শুক্রবার এসেছে, পছন্দের নির্মাতারা সিনেমা বানাতে গিয়ে হতাশ করেছেন পাল্লা দিয়ে। মনে হয়েছে, ছোট পর্দায় তাদের মেধার যে স্ফূরণ দেখেছি, সেটা বড় পর্দায় রূপান্তরিত হয়নি।

মেজবাউর রহমান সুমন বাকি ছিলেন এই লিস্টে। হতাশ করেননি তিনি, বরং ভালোলাগা উপহার দিয়েছেন৷ শুক্রবারের আতঙ্কটাও কেটেছে। জীবনের পরবর্তী শুক্রবারগুলো এমনই হোক, এভাবেই মুগ্ধতায় কাটুক। হাওয়ার উন্মাদনা, অথবা বাংলা সিনেমার উন্মাদনাও টিকে থাকুক সপ্তাহান্তরে…