পরিসংখ্যান পড়তে পড়তে ক্যাম্পাসে ১৫ বসন্ত কাটিয়ে দিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি ‘আদু ভাই’

| আপডেট :  ২৬ জুলাই ২০২২, ১১:২১ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৬ জুলাই ২০২২, ১১:২১ পূর্বাহ্ণ

পরিসংখ্যান ভালোই পড়া হচ্ছে তাঁর। ৫ বছর-১০ বছর নয়, ১৫ বছরেও শেষ হচ্ছে না পড়াশোনা। অনার্স শেষ, মাস্টার্সও শেষ। পাট চুকানোর পরও পরিসংখ্যানে ডুবে আছেন। পরিসংখ্যানে পটু হয়ে এখন মেলাচ্ছেন রাজনীতির গাণিতিক সূত্র। সঙ্গে উপা’চার্যের বিশেষ সুবিধায় সেই অনার্সের একটি বি’ষয়ে ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার ছুতায় ধরে আছেন ক্যাম্পাসের খুঁটি। রাজত্ব করছেন, ঘোরাচ্ছেন ছড়ি। তিনি রেজাউল হক রুবেল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের সভাপতি। শুধু পরিসংখ্যান নয়, তিনি ভাষাটাও ভালো রপ্ত করতে চান। তাই ছাত্রত্ব আর রাজত্ব দুটিই ধরে রাখার কৌশল হিসেবে ভর্তি হয়ে আছেন চবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে।

ক্যাম্পাসে ১৫ বসন্ত কা’টানো এই রুবেলের মুখ সবার চেনা। কেউ কেউ গো’পনে তাঁকে ডাকেন ‘আদু ভাই’। ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে চবির পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হওয়া রুবেলের শিক্ষাজীবনের যবনিকা হওয়ার কথা পাঁচ বছরেই। সেটাও ২০১২ সালে। অবিশ্বাস্য ঠেকলেও রুবেল এখনও ক্যাম্পাস নেতা।

তখন ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই। রেজাউল হক রুবেলকে সভাপতি ও ইকবাল হোসেন টিপুকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সদস্যের কমিটি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ওই দু’জনকে দ্রুত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ‘দ্রুত সময়’ শেষ হয়নি এখনও। এ জন্য সভাপতি ও সম্পাদককে দুষছেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের নেতাকর্মীরা। সভাপতি রুবেলের বি’রুদ্ধে ক্যাম্পাসে ঝাড়ূ মিছিলও হয়েছে। ‘আদু ভাইয়ের পদত্যাগ চাই’ স্লোগান তোলেন খোদ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই।

রাজনীতির ছায়ায় যৌ’নপীড়ন: আজিম হোসাইন- পড়েন ইতিহাস। চবিতে যৌ’নপীড়নের সর্বশেষ ঘটনায় এই নামটি বেশ চাউর। রুবেলের সঙ্গেই তাঁর মধুর রসায়ন। এর আগে চবিতে আরও চার শিক্ষার্থীর বি’রুদ্ধে উঠেছিল যৌ’ন হ’য়রানির অ’ভিযোগ। তাঁরাও ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি রুবেলেরই অনুসারী।

অ’ভিযোগ রয়েছে, চবিতে সর্বশেষ যে ছাত্রী যৌ’ন হ’য়রানির শি’কার হয়েছেন, তাঁকে আগে উ’ত্ত্যক্ত করেছেন খোদ রুবেলই। ওই ছাত্রীকে আবাসিক হলে সিট পাইয়ে দিয়ে তাঁকে দেখা করতে রুবেল নানাভাবে চা’প দিতেন বলে সমকালকে জানিয়েছেন মেয়েটির সহপাঠীরা। রেজাউল হক রুবেলের বি’রুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রী হে’নস্তা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রী উ’ত্ত্যক্ত করার কথা বলেছেন কিছু ছাত্রী। জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের এক ছাত্রী বলেন, ‘রুবেল আমাকে মেসেঞ্জারে বির’ক্ত করতেন।

ভিডিও কল দিতেন। কে’টে দিলে আবার কল করতেন। আমাকে অশালীন মন্তব্যও করেছেন তিনি। আমি তাঁকে ব্লক করেছি। তবু বিভিন্ন অচেনা নম্বর থেকে তিনি কল করে আমাকে দেখা করতে বলতেন।’ সর্বশেষ যৌ’ন হ’য়রানির শি’কার হওয়া ছাত্রীর এক বান্ধবী পড়েন ইংরেজি বিভাগে। তিনি বলেন, ‘ঘটনার শি’কার ওই ছাত্রীকে হলে সিট পেতে সহায়তা করেন রুবেল। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে তিনি প্রায়ই তাঁকে দেখা করতে চা’প দিতেন বলে জানিয়েছেন তাঁর বান্ধবী। এড়িয়ে চলায় তাঁর ও’পর ক্ষু’ব্ধ ছিলেন রুবেল।’

২০১৮ সালে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌ’নপীড়ন করেন ছাত্রলীগের কিছু কর্মী। প্র’তিবাদ জানালে ওই ছাত্রীর বান্ধবীকে মা’রধর করেন তাঁরা। পরে অ’ভিযোগ দিতে চাইলে রুবেল তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বলেন। গত সেপ্টেম্বরে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আরও দুই ছাত্রীকে হে’নস্তা করেন রুবেলের অনুসারী রাজু, রুবেল হাসান, ইমন ও জুনায়েদ। সর্বশেষ খবর হলো- অ’ভিযুক্ত ওই চার শিক্ষার্থীকে গতকাল সোমবার এক বছরের জন্য শিক্ষাজীবন থেকে বহিস্কার করেছে চবি কর্তৃপক্ষ।

রুবেলকে শো’কজ: ১৯ জুলাই রাতে সভাপতি রুবেলকে কারণ দর্শানোর (শো’কজ) নোটিশ দেয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সং’সদ। সুস্পষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ না করে ‘শৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকলাপে’ জ’ড়িত থাকার অ’ভিযোগে তাঁকে এই নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি তখন বলেছিলেন, ‘কেন কারণ দর্শানো হয়েছে, রুবেল তা জানেন। তিনি ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রবি’রোধী কাজ করেছেন। এর বেশি কিছু তো বলা যাচ্ছে না।’

পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি তিন বছরেও: তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই চবি শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিলুপ্ত করা হয়েছিল ওই কমিটি। এর মধ্যে দুই দফা চবি শাখা ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। সাধারণ নেতাকর্মীরা জানান, রুবেল-টিপু দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে উপগ্রুপের নেতাকর্মীরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার দাবি তুলে আসছিলেন। কমিটির জন্য বেশ কয়েকবার মা’নববন্ধন, বি’ক্ষো’ভ সমাবেশও করেছেন তাঁরা। এরপরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

কেন এত বিশৃঙ্খলা: চবি ছাত্রলীগ মূলত দুই টুকরা। এক গ্রুপ নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী এবং অন্যটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফে’লের সমর্থক। এ দুই গ্রুপের ভেতরেই আবার বিভিন্ন নামে ক্যাম্পাসে ১১টি ধারা। এসব ১১ উপগ্রুপের মধ্যে নাছিরের অনুসারী সিক্সটি নাইন, ভিএক্স, বাংলার মুখ, রেড সিগন্যাল, কনকর্ড, এপিটাফ, একাকার, উল্ক্কা ও সংগ্রাম গ্রুপ। অন্যদিকে নওফে’লের সমর্থকদের বড় দুটি গ্রুপ হচ্ছে সিএফসি ও বিজয়। বর্তমান সভাপতি রুবেল সিএফসি গ্রুপের নেতা এবং নওফে’লের অনুসারী। সাধারণ সম্পাদক টিপু সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা এবং নাছিরের সমর্থক।

তুচ্ছ ঘটনায় বারবার সং’ঘাত: গত ১৩ জানুয়ারি সংগঠনের কার্যক্রম দেখতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই নেতা যান ক্যাম্পাসে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী বিভিন্ন উপপক্ষের নেতাকর্মীরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার দাবি জানিয়ে মূল ফটকে তাঁদের আ’টকে দেন। পরে দুই নেতার আশ্বাসে তাঁরা সরে যান। এর পাঁচ দিন পরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা নিয়ে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক বিজয় গ্রুপ ও সিএফসির নেতাকর্মীরা সং’ঘর্ষে জড়ান। এতে অন্তত ১৩ জন আ’হত হন। কথাকা’টাকাটির জের ধরে চবি ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে একাধিকবার এমন সং’ঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতেও অন্তত ১০ জন আ’হত হন। এর আগে একাকার গ্রুপের কর্মীর সঙ্গে বাংলার মুখের এক কর্মীর হাতাহাতি হয়। এ ঘটনার জেরে রাতে দুই গ্রুপ সং’ঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সে সময় উভ’য় পক্ষের মধ্যে ধা’ওয়া-পাল্টা ধা’ওয়া ও ইটপা’টকেল নি’ক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

চবির সাবেক এক ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, ‘কমিটি পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় কর্মীরা হতাশ। যে কোনো তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সং’ঘর্ষে জড়াচ্ছেন তাঁরা। কেউ কারও নির্দেশ মানছেন না। যদি পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকত, তাহলে অনেক সুশৃঙ্খল থাকত ছাত্রলীগ।’

রুবেলের বি’রুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল: রুবেলের বহিস্কার দাবিতে হয়েছে ঝাড়ু মিছিলও। তাঁকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেন বগিভিত্তিক গ্রুপ বিজয়ের কর্মীরা। গত ২৩ জানুয়ারি এএফ রহমান হল ও আলাওল হল থেকে বিজয় গ্রুপের কর্মীরা এই ঝাড়ু মিছিল বের করেছিলেন। ওই সময় বিজয় গ্রুপের কর্মী সাহিল কবির বলেছিলেন, রুবেলের নির্দেশে শিবির স্টাইলে তিন ছাত্রলীগ কর্মীর রগ কে’টে দেওয়া হয়েছে। রুবেলের শা’স্তি চাই আমরা।’ জয়দ্বীপ নামের আরেক ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, ‘আমি ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র হয়ে যদি তৃতীয় বর্ষে পড়ি, তাহলে ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র হয়ে রুবেলের এখন কোথায় থাকার কথা? এই অযোগ্য ও অছাত্রকে বহিস্কার করতে হবে। আমরা তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছি।’

রুবেল যা বললেন: যৌ’ন হ’য়রানির অ’ভিযুক্তরা নিজের অনুসারী নয় বলে দাবি করেছেন চবি ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেল। তিনি বলেন, ‘এটা আমার বি’রুদ্ধে অ’পপ্রচার। সভাপতি হওয়ায় আমার সঙ্গে অনেকেই ছবি তোলে। আমি কোনো অ’পরাধীকে প্রশ্রয় দিই না।’ ভু’ক্তভোগী ছাত্রী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেয়েটি আমার ছোট বোন। তার সঙ্গে কখনও অশালীন কোনো কিছুই করিনি। আমিও চাই, দো’ষীদের দৃষ্টান্তমূলক শা’স্তি হোক।’

যৌ’ন হ’য়রানির আগের অ’ভিযোগে নাম আসা চারজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা কেউই আমার অনুসারী নয়। তারা ছাত্রলীগেরও কেউ নয়। সবাই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। সে সময় তাদের নেতা হওয়ারও কথা নয়। তারপরও তাদের আমার অনুসারী বলা হচ্ছে।’ নিজের ছাত্রত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছি। ২০১০ সালে আমাদের অনার্স শেষ হওয়ার কথা। সেশনজটের কারণে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে শেষ হয়েছে। মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে। আমার সঙ্গে যারা ছিল, তাদের মাস্টার্স তখন শেষ হয়েছে। আমারও শেষ হয়েছে। তবে অনার্সে আমার একটি ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা রয়ে গেছে। সেটির পরীক্ষা দেব আমি।

তা ছাড়া চবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছি আমি। এটির পরীক্ষা এ বছর হবে।’ পরিসংখ্যানের মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরও কীভাবে অনার্সের ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা বাকি থাকে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উপা’চার্যের বিশেষ সুবিধায় আমি এই পরীক্ষা দেব।’ দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা কেন্দ্রের বি’ষয়। আশা করছি, শিগগির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হবে।’ সূত্রঃ সমকাল