নাগরিকত্ব ছেড়েছেন কিন্তু হিজাব ছাড়েননি এই নারী

| আপডেট :  ২১ জুলাই ২০২২, ০৯:২৬ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২১ জুলাই ২০২২, ০৯:২৫ পূর্বাহ্ণ

নাগরিকত্ব ছেড়েছেন, কিন্তু হিজাব ছাড়েননি। মেডিক্যালে পড়ার পাট চুকিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু হিজাব খুলে মেডিক্যালে আসতে হবে- এই নীতির সাথে আপস করেননি। দেশ ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু হিজাব এক সেকেন্ডের জন্য খোলার চিন্তা করেননি তিনি। মুসলিম মেয়েদের জন্য সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি হতে পারেন এক জলন্ত উদাহরণ। তিনি হচ্ছেন মেরভে সাফা কাভাকচি। তিনি যখন তুরস্কে বেড়ে উঠেন তখন হিজাব তুরস্কের রাজনীতিতে একটি বহুল আলোচিত বিষয়।

সেক্যুলাররা এই হিজাবকেই মনে করত তুরস্কের অগ্রগতি ও আধুনিকায়নে বড় বাধা। তাই একদলীয় সরকারের সময় হিজাবকে নিষিদ্ধ করা হয়। তুরস্কে এমন অবস্থা ছিল যে বাসাবাড়িতে হিজাব পরছেন আর রাস্তায় বের হওয়ার সময় খুলে ফেলতে হচ্ছে। অথবা কোনো অফিস আদালতে, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গিয়ে হিজাব খুলে ফেলতে হচ্ছে। তার পরও কিছু মহিলা খুলতে অভ্যস্ত না থাকায় তারা না খুললে তাদের হিজাব টেনে হিঁচড়ে খোলা হয়েছে কিংবা শারীরিকভাবে নির্যাতন করে পুলিশের হাতে দিয়ে দেয়া হয়েছে।

১৯৯৯ সালের ১৭ এপ্রিলের সংসদ নির্বাচনে ফজিলত পার্টির হয়ে মেরভে সাফা কাভাকচি নামে এক ভদ্র মহিলা ইস্তাম্বুল প্রদেশ থেকে প্রথম হিজাবধারী মুসলিম মহিলা হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই ফজিলত পার্টির মাধ্যমেই এরদোগান রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ফজিলত পার্টি তুরস্কে ডানপন্থী ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল। ২ মে সংসদ অধিবেশন শুরু হয় এবং মেরভে কাভাকচি ইসলাম শপথ নিতে সংসদে প্রবেশ করেন। কিন্তু সংসদে ঢুকতে পারেননি। তাকে বের করে দেয়া হয়। আর তার বড় অপরাধ হচ্ছে তিনি স্কার্ফ তথা হিজাব পরে সংসদে প্রবেশ করেছেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বামপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বুলেন্ট এজেবিত।

তিনি দাঁড়িয়ে স্পিকারকে বলেন, ‘এই স্কার্ফ (হিজাব) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক। তাকে এখনই বের করা দেয়া হোক।’ বুলেন্ট এজেবিতের দাবির ভিত্তিতে তাকে শুধু বের করেই দেয়া হয়নি, জন্ম সূত্রে তুরস্কের নাগরিক হওয়ার পরও তার নাগরিকত্বও বাতিল করে দেয়া হয়।

হিজাবের কারণে যে এমপি নাগরিকত্ব হারিয়েছিলেন তার সম্পর্কে একটু জেনে নিই। মেরভে কাভাকচির জন্ম ১৯৬৮ সালে তুরস্কের আঙ্কারায়। হিজাব পরার কারণে নানা ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তুরস্কের মেরভে কাভাকচি। তার বাবা ইসলামী আইন বিষয়ের অধ্যাপক আর মা আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। সত্তর ও আশির দশকে কর্মজীবী মহিলারা হিজাব পরার অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছিল।

সেই সময় তার মা-ও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে তার মাকেও শুধু হিজাব পরিধানের অপরাধে শিক্ষকতার পেশা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। কাভাকাচি আঙ্কারা ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন। মাত্র দুই বছর মেডিক্যালে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন। ১৯৮৮ সালে হিজাব নিষিদ্ধ হয় তখন পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার জন্য অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরা বাদ দিলেও তিনি হিজাব পরে ক্লাসে যেতেন। আর হিজাব পরার কারণেই তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। হিজাব না খুলে মেডিক্যালে আসার কারণে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়।

নিজের স্রষ্টা ও ধর্মের প্রতি কতটা আস্থা থাকলে মানুষ এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে! তিনি মেডিক্যালের ছাত্রত্ব হারিয়েছেন, তবুও হিজাব খুলে ক্লাসে যাননি। হিজাব যে তার মর্যাদা ও পরিচয়ের অংশ। সেই নিজের মর্যাদা ও পরিচয় রক্ষার ক্ষেত্রে কখনো আপস করেননি মেরভে কাভাকচি। পরবর্তীকালে তিনি হিজাব না ছেড়ে মেডিক্যালের পাট চুকিয়ে আমেরিকার ডালাসে ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএস করেছেন। এরপর আবার হিজাবের কারণেই ১৯৯৯ সালে যখন তার এমপি পদ বাতিল করা হয় এবং নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়। তখন তিনি আবার আমেরিকায় চলে যান। তারপর ২০০৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে লোকপ্রশাসনে মাস্টার্স করেন এবং পরবর্তীতে ২০০৭ সালে কাভাকচি হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। পিএইচডি শেষ করে তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।

নানা ধরনের সমাজসেবার জন্য তিনি বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালে Capital Platform of Ankara এবং National Youth Organization কর্তৃক ‘মাদার অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। International Association for Women and Children (আন্তর্জাতিক নারী ও শিশু সমিতি) কর্তৃক ২০০০ সালে মানবাধিকারের অগ্রগতি ও মুসলিম নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড (Public Service Award) দেয়া হয়। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালারড পিপল (NAACP) ও জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি (এডট) থেকে ২০০৪ সালে তাকে ‘উইমেন অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

২০০৫ সালে বেকেট ফান্ড ফর রিলিজিয়াস লিবার্টির বডি অব বিলিফ প্রদর্শনীতে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে মার্কিন কংগ্রেসে পার্লামেন্টে কাভাকচির পরিধান করা হেডস্কার্ফ প্রদর্শন করা হয়েছিল। তিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ২০০৬ সালে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য প্রশংসাপত্রে ভূষিত হন। পেশাগত জীবনে তার সফলতার জন্য ২০০৯ সালে বিশ্বের ৫০০ প্রভাবশালী মুসলিম ইনফ্লুয়েন্সিয়ালের তালিকায় স্থান করে নেন।

তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ বা শিক্ষকই নন একজন ভালো লেখিকাও। তার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই এবং অ্যাকাডেমিক আর্টিকেলও রয়েছে। বইয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তুর্কি ভাষায় লেখা- স্কার্ফবিহীন গণতন্ত্র : ইতিহাসের ভেতর ইতিহাস এবং ইংরেজি ভাষায় কাভাকচির লেখা জনপ্রিয় বই ‘Headscarf Politics in Turkey: A Postcolonial Reading’ ২০১২ সালে জর্জিয়ান বংশোদ্ভূত লেখক রিচার্ড প্যারেস কাভাকচিকে নিয়ে বই লিখেন। বইটির শিরোনাম “The Day Turkey Stood Still: Merve Kavakçý’s Walk Into the Parliament” কাভাকাচি মুসলিম বিশ্বে মার্কিন কংগ্রেসের একজন পরামর্শক এবং তুর্কি ইসলামী ও রক্ষণশীল দৈনিক ভাকিত বা ইয়েনি আকিত (New Agreement) পত্রিকার একজন নিয়মিত কলাম লেখক। তিনি ভূমধ্যসাগরীয় ত্রৈমাসিকের সম্পাদকীয় বোর্ডে বসেন। তিনি ছয়টি বই এবং অসংখ্য প্রবন্ধের লেখক।

নারীদের জন্য হিজাবের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এরদোগান অনেক কাজ করেছেন। একে পার্টি প্রতিষ্ঠার পরই আদালত ও কুশীলবরা নতুন এই পার্টিকে নিষিদ্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। তিনি ৩২২/২ ধারায় আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় এমপি হওয়ার শর্ত পূরণে অযোগ্য। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছয়জন ছিল হিজাবধারী, তাদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য থেকে বের করে দিতে রায় আসে। এ সময় তিনি হিজাবের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রে জনগণের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘একজন নাগরিক কী পোশাক পরবে তা নিজের অধিকার’।

এর পক্ষে তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার নানা ধারা উপস্থাপন করে বলেন, ‘পোশাকের কারণে কাউকে আলাদা করা হলে সেটি হবে অন্যায় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল’। এরদোগানের নেতৃত্বে একে পার্টি ক্ষমতায় এলে নারীদের দীর্ঘ দিনের বঞ্চিত অধিকার হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে আইন পাস করেন। কিন্তু ইসলামপন্থী ও সাধারণ জনগণের কাছে এটি নারী সমাজের বহু আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা বাস্তবায়নের জন্য তিনি হঠাৎ করে আইন পাস করেননি। পুরোপুরি হিজাবের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে তিনি ক্ষমতায় আসার পর ১২ বছর সময় নিয়েছেন। প্রথমে ক্ষমতায় আসার পর এর পক্ষে সংসদের ভেতরে ও বাইরে কথা বলেছেন এবং এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘আমরা হিজাব পরিহিত কিংবা হিজাবহীন সবাইকেই একই আইনের অধিকারের আওতায় আনতে চাই।’ একে পার্টি সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা এর পক্ষে কলম ধরেছেন, মিডিয়া এর পক্ষে কথা বলেছে।

এর পক্ষে শক্ত জনমত সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন প্রায় এক যুগ ধরে। ২০১০ সালে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। এরপর সর্বশেষ পর্যায়ে ২০১৪ স্কুলগুলোতে হিজাবের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে সব পর্যায়ে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর প্রথমবারের মতো সংসদে একে পার্টির চার মহিলা এমপি সংসদে হিজাব পরে প্রবেশ করেন এবং ২০১৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর প্রথম হিজাব পরিহিত এমপিরা হিজাব পরেই শপথ নেন।

২০১৫ সালে কাভাকচির ছোট বোন ড. রাভচা কাভাকচিকে ইস্তাম্বুলের এমপি হিসেবে এরদোগান মনোনয়ন দেন এবং তিনি নির্বাচিতও হন। তিনি হিজাব পরেই সংসদে শপথ গ্রহণ করেন। ড. রাভচা কাভাকচি বোনের মতোই একজন উচ্চশিক্ষিত মহিলা। তিনি একে পার্টির মানবাধিকারবিষয়ক ডেপুটি চেয়ারম্যানের (দলের ১৬ জনের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ফোরামের একজন) দায়িত্ব পালন করছেন। আর এরদোগান বোন ড. রাভচা কাভাকচিকের বড় বোন মেরভে কাভাকচির নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেন।
কাভাকচি ২০১৭ সালের মে মাসে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তার তুর্কি নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। যিনি বিশ্বের প্রথম হিজাবধারী মুসলিম মহিলা সংসদ সদস্য ছিলেন এবং হিজাবের কারণে এমপির পদ বাতিল ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জুন মাসে তাকে মালয়েশিয়ার কুলায়ালালামপুরে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করা হয়।

তিনি সেখানে বেশ দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মুসলিম নারীদের মর্যাদা ও আত্মসম্মান বজায় রেখে বিশ্বদরবারে নিজেকে একজন মুসলিম নারী হিসেবে তুলে ধরতে অনুপ্রেরণা জোগাবেন বলে আশা করি। অন্যায়ের সাথে আপস না করে হিজাব, বোরখাসহ নিজের মুসলিম পরিচয় বজায় রেখেও যে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় তা তিনি তার জীবনে দেখিয়ে দিয়েছেন।

লেখক : শারমিন আকতার, সম্পাদক, মহীয়সী (অনলাইন পোর্টাল)