বস্তিতে বেড়ে ওঠা রহিমার ৭ তলা বাড়ি, ব্যাংকে ১২ কোটি টাকা

| আপডেট :  ২৮ জুন ২০২২, ০৪:০৭ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৮ জুন ২০২২, ০৪:০৭ অপরাহ্ণ

এক যুগ ধরে রহিমা বেগমকে চেনেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মাহমুদনগরের স্থায়ী বাসিন্দা অলিউল্লাহ (৬৫)। তাঁরই চোখের সামনে ১০ বছর আগে মাহমুদনগরে সাততলা বাড়ি বানান রহিমা। অলিউল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মাহমুদনগরে রহিমার বাড়িটিই প্রথম সাততলা ভবন। তবে রহিমার আয়ের উৎস কী, সেটি তখন জানতাম না। পরে শুনেছি ঢাকায় রহিমা বেগম নাকি মা’দকের ব্যবসা করে অল্প সময়ে অনেক পয়সার মালিক বনে গেছেন।’

মাহমুদনগরে রহিমার বাড়ির দেখভাল করেন নিহার বেগম নামের এক নারী। ২০ জুন নিহার মুঠোফোনে বললেন, ‘রহিমা আপা এক বছর আগে এই বাড়িতে এসেছিলেন। আর তিনি আসেন না। তবে লোক পাঠিয়ে ভাড়ার টাকা নিয়ে যান। শুনছি রহিমা আপার নামে মা’মলা-মোকদ্দমা আছে। রহিমা আপা কোথায় থাকেন, জানি না।’

রহিমা বেগম খু’নের মা’মলার অ’ভিযুক্ত আ’সামি। এ মা’মলায় জা’মিন নিয়ে পাঁচ বছর ধরে লা’পা’ত্তা তিনি। তাঁর নামে ঢাকায় মা’দকের এক ডজনের বেশি মা’মলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। চার মাস আগে রহিমা বেগমের ব্যাংক হিসাবে ১২ কোটি টাকা জমা থাকার তথ্য পেয়েছে মা’দকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

এর বাইরে রহিমার স্বামী ও তাঁর স্বজনদের ব্যাংক হিসাবে মিলেছে আরও ৯ কোটি টাকা। সাততলা বাড়ি ছাড়া রহিমার নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আরও কয়েক কাঠা জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় রহিমার বি’রুদ্ধে গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওয়ারী থানায় অর্থ পা’চার আইনে মা’মলা হয়েছে।

মা’মলার বা’দী ও মা’দকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আলী আসলাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা’দক ব্যবসা করে রহিমা বেগম ও তাঁর স্বামীর অ’পরাধলব্ধ আয় নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করি। সেই অনুসন্ধানে জানা গেছে, মা’দক ব্যবসা করেই তাঁরা বাড়ি, জমিসহ স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন।’

তবে মা’মলা দা’য়েরের চার মাস পার হলেও রহিমার খোঁজ মিলছে না বলে জানালেন ত’দন্ত কর্মকর্তা ও মা’দকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. বাহাউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রহিমা ও তাঁর স্বজনদের ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা ২১ কোটি টাকা, সাততলা বাড়ি, জমিসহ সম্পদ যাতে স্থানান্তর বা রূপান্তর না হয়, সে জন্য আ’দালতের হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন করা হবে। তিনি বলেন, ‘রহিমা কোথায় আছেন, সেই খোঁজ কেউ দিতে পারছেন না।’ অবশ্য খু’নসহ অন্য মা’মলায় রহিমার পক্ষ থেকে আ’দালতের কাছে লিখিতভাবে দাবি করা হয়েছে, রহিমা নিরপরাধ। হ’য়রানির জন্য তাঁর বি’রুদ্ধে মা’মলা দেওয়া হয়েছে।

কোটিপতি রহিমা–হযরত দম্পতিঃ রহিমার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। তবে তিনি বেড়ে ওঠেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ১১৫/৮ ডিস্টিলারি রোডে। ৪০ বছর ধরে রহিমাকে চেনেন গেন্ডারিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। ২০ জুন আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহু বছর ধরে রহিমাকে চিনি। এই রহিমা নামাপাড়া বস্তিতে মা’দক ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে তিনি থাকতেন, তাঁর স্বজনেরাও থাকতেন। পরে বিয়ে করেন হযরত আলীকে। এরপর গত ১০ বছরের ব্যবধানে কোটিপতি বনে যান তাঁরা। তবে হযরত আলী ২০১৯ সালে “ক্র’সফা’য়ার”–এ নি’হত হয়েছেন।’

মা’দকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দা’য়ের করা মা’মলার তথ্য বলছে, রহিমা বেগমের তিনটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। ১৪ বছর আগে (২০০৮ সাল) দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। আরেকটি হিসাব খোলা হয় ২০১৭ সালে। এই তিন ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হয় ১২ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

এ ছাড়া রহিমার স্বামী হযরতের নামে দুটি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। ১০ বছর আগে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। অন্যটি খোলা হয় চার বছর আগে। এই তিন ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া রহিমা–হযরত দম্পতির দুই ছেলের ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ৭ লাখ টাকা জমার তথ্য মিলেছে।

অর্থ পা’চার মা’মলার তথ্য বলছে, মা’দক ব্যবসা করে তাঁরা এই সম্পদের মালিক হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের বাড়ি রহিমার নামে। সবুজবাগের মেরাদিয়া মৌজায় রহিমার সাড়ে তিন কাঠা জমি রয়েছে। এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে রহিমার নামে আরও জমি রয়েছে।

মা’মলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, রহিমার বি’রুদ্ধে গেন্ডারিয়া থানায় আটটি মা’দকের মা’মলা রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থানায় তিনটি এবং রামপুরা থানায় একটি মা’দকের মা’মলা রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তাঁর বি’রুদ্ধে এই মা’মলা করে পুলিশ। প্রতিটি মা’মলায় রহিমাকে অ’ভিযুক্ত করে আ’দালতে অ’ভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। মা’মলাগুলো ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন আ’দালতে বিচারাধীন।

এ ছাড়া রহিমার স্বামী হযরত আলীর বি’রুদ্ধে গেন্ডারিয়া থানায় ছয়টি ও যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর ও ডেমরা থানায় একটি করে মা’দকের মা’মলা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রহিমা ও তাঁর স্বামী হযরত তালিকাভুক্ত আ’সামি। রহিমা মূলত গেন্ডারিয়া এলাকায় মা’দক ব্যবসা করতেন। হযরত ব’ন্দুকযু’দ্ধে নি’হত হন।

খু’নের প্রধান ‘অ’ভিযুক্ত’ রহিমাঃ আট বছর আগে (২০১৪ সালের ৮ নভেম্বর) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আসলাম শিকদার নামের এক ব্যক্তি খু’ন হন। এই খু’নের দায়ে রহিমাকে প্রধান আ’সামি করে ঢাকার আ’দালতে অ’ভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। খু’নের অন্য অ’ভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন রহিমার স্বামী হযরত আলীও।

মা’রা যাওয়ায় মা’মলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি। অ’ভিযোগপত্রে বলা হয়, রহিমা ও তাঁর স্বামী হযরত দুজনই মা’দক ব্যবসায়ী। আর খু’নের শি’কার আসলাম ছিলেন একজন সোর্স। খু’ন হওয়ার আগে রহিমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আসলাম। এর জের ধরে আসলামকে খু’ন করা হয়। আসলামকে খু’ন করার জন্য ভাড়াটে খু’নিদের রহিমা ছয় লাখ টাকা দেন।

আসলাম শিকদার খু’নের মা’মলায় ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রহিমাসহ নয়জনের বি’রুদ্ধে অ’ভিযোগ গঠন করেন আ’দালত। রহিমা গ্রে’প্তার হওয়ার কয়েক মাস পর উচ্চ আ’দালত থেকে জা’মিন পান। তবে ২০২১ সাল থেকে তিনি প’লাতক। রহিমার বি’রুদ্ধে আ’দালতের গ্রে’প্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। গেন্ডারিয়া থানার ওসি আবু সাঈদ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও মা’দক ব্যবসায়ী রহিমাকে খুঁজছি। যেখানেই তাঁকে পাওয়া যাবে, গ্রে’প্তার করে আ’দালতে সোপর্দ করা হবে।’ সূত্রঃ প্রথম আলো