কেরানি থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, প্রায় কোটি টাকা লোপাট

| আপডেট :  ২৫ জুন ২০২২, ০৭:৪৮ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৫ জুন ২০২২, ০৭:৪০ অপরাহ্ণ

চাঁদপুর সদর উপজে’লার ঐতিহ্যবাহী ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৯৫ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাকরি বিধি না মেনে জালিয়াতির মাধ্যমে করণিক (কেরানি) হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হান্নান মিজি। নিয়োগ প্রক্রিয়াটি নিয়ম বহির্ভুত থাকলেও পর্যায়ক্রমে দু’র্নীতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক হিসেবে একই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।

এরপর সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং সর্বশেষ তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে। তার করণিক থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া জালিয়াতি এবং বড় ধরনের এক দু’র্নীতি। তিনি প্র’তারণা করে এ পর্যন্ত স’রকারের ৮২ লাখ টাকার অধিক আ’ত্মসাৎ করেছেন।

এসব ঘটনায় বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য তার বি’রুদ্ধে চাঁদপুর আ’দালতে দুটি পৃথক মা’মলা করেছেন। একই সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ স’রকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অ’ভিযোগ দিয়েছেন। সম্প্রতি দু’র্নীতিতে অ’ভিযুক্ত শিক্ষক হান্নান মিজির দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছরের জালিয়াতির সব ধরনের কাগজপত্র ও মা’মলার কপি বাংলানিউজের হাতে এসেছে।

প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, হান্নান মিজি ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জালিয়াতি ও প্র’তারণা করে বিদ্যালয়ে করণিক, সহকারী শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বিগত দিনের পরিচালনা পর্ষদ একজন প্রভাবশালী নেতার কারণে কোনো ধরনোর ব্যবস্থা নেননি, এ নেতা আবার মো. হান্নান মিজির বাল্যবন্ধু ও একসঙ্গে ওই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় দায়িত্ব অবহেলার মধ্যে পড়েন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক/সদস্য স’চিবরাও।

তার এ জালিয়াতির খোঁজ ও তথ্য জানতে পেরে বিদ্যালয়ের সর্বশেষ পরিচালনা পর্ষদের অভিভাবক সদস্য মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন বা’দী হয়ে চাঁদপুর আ’দালতে নির্দিষ্ট জালিয়াতি ও দু’র্নীতির অ’ভিযোগ এনে হান্নান মিজির বি’রুদ্ধে দুটি মা’মলা দা’য়ের করেন (মা’মলা চলমান)। একই সঙ্গে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে অ’ভিযোগ করেন।

মা’মলা ও অ’ভিযোগের বিবরণ থেকে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে হান্নান মিজি বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করণিক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্ত ওই নিয়োগ ওই সময়কার চাকরি বিধির নিয়ম গো’পন রেখেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের ৩১ মে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের ৩১তম সভায় সিদ্ধান্ত ছিল ৩জন শিক্ষককে মাস্টার রুলে নিয়োগ প্রদান। তারা হলেন- ক. মো. মাসুদুর রহমান তপদার, খ. মোজ্জাম্মেল হক ঢালী ও গ. মো. জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে মোঃ হান্নান মিজির মাস্টার রোলে নিয়োগের কথা রেজুলেশনে উল্লেখ ছিল না।

সভার পরে প্রভাব খাটিয়ে ‘ঘ’ বর্ণ ব্যবহার করে ৪র্থ ব্যক্তি হিসেবে নিয়োগ দেখান হান্নান। রেজুলেশনে লেখা মুছে আবার নতুন করে অন্য হাতের লেখা খুবই স্পষ্ট। এই জালিয়াতি থেকে শুরু করে বাকি পদে চাকরির চূড়ান্ত পর্যায়ের দু’র্নীতিতে অবতীর্ণ হন তিনি।

এই রেজুলেশনের ও’পর ভিত্তি করে হান্নান পরবর্তীতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হন। কিন্তু সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য ওই সময়কার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিধি ২০৩ অনুযায়ী স্নাতকসহ বিএ, বিএড সব পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণী/বিভাগ থাকতে হবে। কিন্তু হান্নান মিজির সনদপত্রে স্নাতক সম্পূরক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, এইচএসসি তৃতীয় ও এসএসসিতে দ্বিতীয়। এসব তথ্য গো’পন রেখে এবং প্রভাব খাটিয়ে ২০১৫ সালে তিনি আবার সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।

জালিয়াতি এখানেই শেষ নয়, হান্নান মিজি করণিক পদ থেকে পদত্যাগ না করেই সহকারী শিক্ষক হিসেবে মাস্টার রোলে নিয়োগ পান ১৯৯৯ সালে। এরপর তিনি ২০০১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত জালিয়াতি করে করণিক ও সহকারী শিক্ষক হিসেবে স’রকারিসহ সব ধরনের দুটি বেতন-ভাতা একইসঙ্গে সুবিধা নেন।

এদিকে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটি শূন্য। কিন্তু মো. হান্নান মিজি অ’বৈধভাবে প্রভাব খাটিয়ে প্রধান শিক্ষকের পদটিও ভারপ্রাপ্ত প্রদান শিক্ষক হিসেবে দ’খল করে আছেন। বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ বার বার প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদটি পূরণ করার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে হান্নান মিজি প্রধান শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে রেখেছেন।

অ’ভিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হান্নান মিজি এই বি’ষয়ে বলেন, আমার সনদপত্র যা দেওয়া আছে তা সঠিক। আমি বিএ, বিএড পাস করেছি। কোনো ধরনের প্র’তারণা কিংবা জালিয়াতি করিনি। তবে করণিক পদ থেকে অব্যাহতি না দিয়েই সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছি। যদি অব্যাহতির পর সহকারী শিক্ষক নিয়োগ না হত, তাহলে আমি চাকরি হারাতাম। যে কারণে অব্যাহতি দেইনি। তবে আমি কোন কাজেই প্রভাব খাটাইনি। বরং সাবেক প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন হাওলাদার আমার নিয়োগের রেজুলেশন বুক বুঝিয়ে দেননি। এর কারণে আমি থানায় জি’ডি করেছি।

মা’মলার বা’দী মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, হান্নান মিজির প্রথম করণিক পদে নিয়োগই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাকরি বিধির মধ্যে হয়নি। এর ফলে গত ২৭ বছর তিনি স’রকারের যে বেতন ভাতা ভোগ করেছেন তার পরিমাণ প্রায় ৮২ লাখ টাকার অধিক। ইতোমধ্যে তার জালিয়াতির কয়েকটির প্রমাণ আ’দালতে শিক্ষা কর্মকর্তা ত’দন্ত শেষে মতামত দিয়েছেন।

সাবেক প্রধান শিক্ষক রুহুল হাওলাদার বলেন, আমি দায়িত্ব শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হান্নান মিজিকে তালিকা করে বুঝিয়ে দিয়েছি। তিনি সঠিক কথা বলছেন না।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি ড. মো. হাসান খান বলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হান্নান মিজির চাকরিতে যোগদানের কাগজপত্রের বি’ষয়টি আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে গো’পন ছিল। তাকে সহকারী প্রধান শিক্ষক কিংবা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হওয়ার বি’ষয়ে আমাদের কোন হাত ছিল না। তার বাল্যবন্ধু কেন্দ্রীয় নেতা সুজিত রায় নন্দী। তার বিভিন্ন পদে পদায়নের বি’ষয়টি তিনিই প্রভাব বিস্তার করে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। কেউ এসব বি’ষয়ে এখনো প্র’তিবাদ করলে তাকে চ’রম হ’য়রানির শি’কার হতে হয়। যারা বিগত দিনে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনও করেন সবার কাছে একই তথ্য পাওয়া যাবে।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান সভাপতি সিরাজুল ইসলাম তালুকদার বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ গত ৪ বছর শূন্য। বর্তমান পর্ষদ চেষ্টা করেছে একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া করার জন্য। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পক্ষে চাঁদপুরের জে’লা ও উপজে’লা আওয়ামী লীগের নেতা ও একজন কেন্দ্রীয় নেতার তদ্বির ও আকুতি মিনতির কারণে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারি নাই। তবে তার বি’ষয়ে যেসব অ’ভিযোগ এবং মা’মলা হয়েছে এসব বি’ষয়গুলোর জন্য আগের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকরাও ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কারণ তারাই তাকে নিয়োগের সহযোগিতা করেছেন। আমিও বিভিন্ন ধরনের চা’পে করতে পারিনি।

চাঁদপুর জে’লা শিক্ষা অফিসের গবেষণা কর্মকর্তা ও মা’মলার ত’দন্ত অফিসার মোহাম্ম’দ মাসুদুল আলম ভুঁইয়া বলেন, হান্নান মিজির বি’রুদ্ধে দুটি মা’মলা হয়েছে। একটি মা’মলার ত’দন্ত রিপোর্ট আমি দিয়েছি। বোর্ডের একটি অ’ভিযোগের ত’দন্ত আমার কাছে আছে। সেটির রিপোর্ট এখনো দেইনি। প্রথম ত’দন্তে আমি মতামত দিয়েছি, আ’সামি মো. হান্নান মিজি ১৯৯৫ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০১ সালের মার্চ পর্যন্ত করণিক হিসেবে বেতন ভাতা গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৯৯ সালের ৫ মে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সময় করণিক পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কোন কাগজপত্র এবং সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল বিবরণী, নিয়োগপত্র ও যোগদানপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। তিনি যে একইসঙ্গে দুই পদের টাকা উত্তোলন করেছন সেই কাগজপত্রও বা’দী ও বিবা’দী কেউ দেখাতে পারেননি। সূত্রঃ বাংলা নিউজ