কোরবানি না দিয়ে ওই টাকা বন্যার্তদের দান করার বিষয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞ আলেমরা

| আপডেট :  ২২ জুন ২০২২, ০৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ জুন ২০২২, ০৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ

কোরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিমের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। কিন্তু ইদানিং একটি বিষয় বেশ জোরোশোরে আলোচনা হচ্ছে, তা হলো- কোরবানি না দিয়ে ওই টাকা কি বন্যার্তদের মাঝে দান করা যাবে? কোরবানির টাকা বন্যার্ত ও যেকোনো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের দান করা যাবে কিনা- সে বিষয়ে আমরা কথা বলেছি দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমের সাথে।

এ বিষয়ে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এবিএম হিজবুল্লাহ বলেন, ‘দেখুন- কোরবানি এক জিনিস এবং ক্ষতিগ্রস্ত বন্যার্তদের জন্য কিছু করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কোরবানিটা হচ্ছে- আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে একটি ওয়াজিব বিধান। এখন ওয়াজিব বিধানকে বাদ দিয়ে কেউ যদি সেটা অন্য খাতে ব্যয় করতে চান-আমি যতটুকু জানি-সেটার অনুমোদন শরীয়ত দেয় না। বরং কোরবানির জায়গায় কোরবানি রেখে অন্যভাবে দান করেন- সেটা হবে সবচেয়ে উত্তম। যদি কোরবানির অর্থ অন্যখাতে ব্যয় করা হয়, তাহলে তো কোরবানির বিধান পালন হলো না।’

বিষয়টি নিয়ে প্রায় অভিন্ন মত দিলেন রাজধানীর প্রসিদ্ধ ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালামের অধ্যক্ষ ও মেঘনাগ্রুপ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি মানসুর আহমাদ। বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদের জীবনে নানা প্রকার দুর্যোগ আসবে- এটা বাস্তবতা। একেক সময়ে একেক রকম দুর্যোগের মুখোমুখি আমরা হই। সাম্প্রতিক সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। মানুষের অসহায়ত্বের সীমা নেই। তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। সামর্থ্যবানদের জন্য বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানী নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু কোরবানি না দিয়ে ওই টাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের দান করার চিন্তা সঠিক নয়। কারণ কুরবানি ইসলামের একটি প্রতিকী ইবাদত। এর রয়েছে সতন্ত্র উদ্দেশ্য।’

তার মতে- দুর্যোগগ্রস্ত ও অভাবগ্রস্ত মানুষের সহযোগিতার জন্য ইসলাম অন্য দু’টি আমল নির্দেশ করেছে। এক. নফল সাদাকা (দান)। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজের বহু মানুষ ১০-২০ টাকা ফকির মিসকিনকে দান করে কিংবা মসজিদ-মাদরাসার দান বাক্সে ফেলে মনে করেন তিনি নফল সাদাকার হক আদায় করে ফেলেছেন। নফল সাদাকার পরিমাণ কী হবে এবং তা কতটা স্বপ্রণোদিত হয়ে আদায় করতে হবে, তা আমরা অনেকেই জানি না বা জানার চেষ্টা করি না। সাহাবায়ে কেরামের মতো আমরা যদি গুরুত্বের সাথে নফল সাদাকার হক আদায় করতাম তাহলে দুর্যোগগ্রস্থদের সংকট এর দ্বারাই বহুলাংশে লাঘব করতে পারতাম।

দুই. অসহায় মানুষের অর্থসংকট দূর করতে ইসলাম বিত্তশালীদের ওপর জাকাত ফরজ করেছে। বছরান্তে একবার যাকাতযোগ্য সম্পদের আড়াই ভাগ আদায় করতে হবে। জাকাত কেবল রমজান মাসে ফরজ হয় না। অর্থ বছর পূর্ণ হলে বছরের যে কোনো সময়ে জাকাত ফরজ হয়। ধরুন, এক কোটি টাকার মালিক একশত মুসলিমের এই মাসে জাকাত বর্ষ পূর্ণ হয়েছে। তাদের জাকাত বাবদ আদায়যোগ্য টাকার পরিমাণ হবে ২৫০০০০০০/= (আড়াই কোটি টাকা)। এই এক শ’ জনের জাকাতের টাকা যদি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত লোকদের মাঝে বিতরণ করা হয়, তাহলে ভাবুন তো কতটা প্রভাব পড়বে। তাছাড়া জাকাত তো অগ্রীমও আদায় করা যায়। প্রয়োজনে এমনটাও করতে পারেন। প্রতি বছর কুরবারি এলে যারা কুরবানির টাকা দান করতে বলেন, তারা কিন্তু জাকাত আদায়ের ব্যাপারে কথা বলেন না।’

তিনি আরো বলেন, ‘নানান পর্ব-অনুষ্ঠানের নামে আমাদের সমাজের মানুষ অনেক অপচয় করে থাকে, তা ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয়ভাবেই হয়ে থাকে, যে কাজগুলো না করলেও চলতো। সেই সব অনর্থক টাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে, এতেও ওই লোকগুলোর বিরাট উপকার হয়ে যাবে।’

কিন্তু যদি এমন হয়- কোনো ব্যক্তি প্রতি বছর ওয়াজিব পরিমাণের চেয়ে বেশি সংখ্যক পশু কোরবানি করে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ বন্যা কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো- এ কারণে তিনি শুধুমাত্র ওয়াজিব পরিমাণ কোরবানি করবেন বলে স্থির করলেন এবং অতিরিক্ত কোরবানির টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের দান করে দেবেন। সেক্ষেত্রে কী হবে- এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম রাজধানীর প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়ার মুহাদ্দিস, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ ঢাকার অধ্যক্ষ ও মিরপুরের চাঁদতারা জামে মসজিদের খতিব মুফতি মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমীর কাছে।

তিনি বললেন, ‘কোরবানির টাকা দিয়েই দান করতে হবে- কথাটি কেন আসছে? কোরবানি একটি ওয়াজিব ইবাদত হওয়ার সাথে সাথে এটির মাধ্যমে অভাবগ্রস্তদের পাশেও দাঁড়ানো হয়। যারা অতিরিক্ত কোরবানি করেন, তারা ওই টাকা অপচয় করছেন না; বরং ওই অতিরিক্ত কোরবানির গোশতও কোনো অসহায় গরিবকে দিয়ে তার মুখে হাসি ফোটানো হচ্ছে। তাহলে কেন একটি ভালো কাজের বদলে আরেকটি ভালো কাজের কথা আসছে? অথচ বলা উচিৎ ছিল- আমি অমুক অমুক (অনর্থক বিষয়) কাজের জন্য যে টাকাগুলো খরচ করব ভেবেছিলাম, তা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের দিয়ে দেব ইত্যাদি- এটাই হওয়ার কথা ছিল।’ তবে মুফতী কাসেমীর মতে- অতিরিক্ত কোরবানির টাকা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া যাবে।