যে স্ত্রী-সন্তানকে সুখে রাখতে নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন, তারাই রেখে গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে!

| আপডেট :  ১৯ জুন ২০২২, ১০:২৬ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৯ জুন ২০২২, ১০:২৬ অপরাহ্ণ

শহরের ডিসেন্ট টেইলার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানে কাটিং মাস্টার হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন মো. আফজাল হোসেন। টানাপোড়েনের সংসার হয়েও ছেলে-মেয়েদের পড়িয়েছেন সুনামধন্য স্কুল-কলেজে। স্ত্রীকে একটি স্কুলে পাইয়ে দিয়েছেন চাকরি। সবকিছু মিলে সুন্দর জীবনযাপনের আশা করেছিলেন তিনি।

তবে এত জীবনসংগ্রামের পরও আফজাল হোসেনের ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। যে স্ত্রী-সন্তানকে সুখে রাখতে নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন, তারাই যেন আজ আপন কেউ নয়। তাই নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার এক নিভৃতপল্লিতে গড়ে ওঠা ‘নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রম’ই আজ তার আপন ঠিকানা। তিনি এখন এখানের স্থায়ী বাসিন্দা। এর আগে ৯ বছর অসুস্থ অবস্থায় আশ্রিত ছিলেন বোনের বাড়িতে।

শুধু আফজাল হোসেন নন, তার মতো অনেক অসহায় মা-বাবা বসবাস করছেন এই নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। চোখেমুখে যাদের বয়সের ভাঁজ, অন্তহীন বেড়াজালে বন্দী তারা। এখন শুধু পরপারের হাতছানির অপেক্ষা। অথচ এই মা-বাবা একসময় তাদের সন্তানদের মানুষ করতে কতই না ছোটাছুটি করেছেন। তারাই আজ সন্তানের কাছে ঝরে পরা শুকনা পাতার মতো।

সন্তানদের ঘরে জায়গা হয়নি এসব মা-বাবার। অভিমান হয় সন্তানদের প্রতি কিন্তু কোন ক্ষোভ নেই। বুকের মধ্যে হা হা কার, বোঝা নামাবার কোন জায়গা নাই। কখনও কষ্টের কথা মনে করে ডুকরে কাঁদেন, কখনওবা ভাবেন বেশ আছেন তারা।

সরেজমিনে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে পঞ্চাশোর্ধ্ব আফজাল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক কষ্টে ছেলে- মেয়েদের লেখাপড়া শিখাইলাম। মেয়ে চাকরি পাওয়ার পর জামাইকে নিয়ে গেল স্পেনে। সেখানে যাওয়ার পর যোগাযোগ করে না। কোনো সম্পর্কও রাখে না, ফোন দিলে কেটে দেয়। আর স্ত্রীকেও সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে দিলাম, সেও আমার থেকে দূরে সরে গেল। বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারলাম যে তার পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটির পর থেকে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করি না।

তিনি আরও বলেন, একদিন রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে আমার হাত-পা অবশ হতে থাকে। অসুস্থ হয়ে কাজকাম করতে পারিনি। তারপর থেকে আমার বোন দেখাশোনা করত। এভাবে সাত-আট বছর ধরে। এই বোনই যা যাবতীয় চালাইত। ফেসবুকের মাধ্যমে এই বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজু ভাইয়ের কথা জানতে পেরে আমার ছোট বোন এখানে রেখে যায়। সেই থেকে সাজু ভাই আমাকে ভাইয়ের মতো যত্ন করেন।

সবার সুখ চাওয়া আফজাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ইচ্ছে ছিল তারা ভালো চাকরি করুক, শিক্ষক হোক। মেয়ে তো উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে, মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে কারমাইকেল কলেজ থেকে। ছেলেকেও কষ্টে লেখাপড়া শিখাইলাম। ছেলে আমার এখানে আসে, কথাবার্তা হয়। আশা করি দোয়া করি সে ভালো একটা চাকরি পাক। আমার বিশ্বাস আমার ছেলে আমাক একা রাখবে না।

তিনি বলেন, আমি যে পর্যায়ে আছি এখন, আমার মতো যেন কোনো বাবা-মাকে তাদের ছেলে-মেয়েদের হাতে এমন অবহেলার শিকার হতে না হয়। লেখাপড়া শিখেও তারা যেমন আমাকে পর করে দিয়েছে, এ রকম যেন জীবনে না হয়।

এদিকে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী থাকার পরও প্রায় এক বছরও বেশি সময় ধরে রংপুর সদরের সদ্যপুষ্করিণী পালিচড়াহাট এলাকার একটি মসজিদের বারান্দায় মানবতের জীবন যাপন করছিলেন মজিবুর রহমান নামে এক বাবা। পরে তার ঠাঁই মেলে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন এই বৃদ্ধ বাবা।

ওই বৃদ্ধাশ্রমে আরেকজন বাসিন্দা উপজেলার বড়ভিটা এলাকার আব্দুল কাফি। তিনি বলেন, বেটা-বেটি আমাক দেখে না, শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখে। এখানে নামাজ-বন্দেগি করে সময় কাটাই। কোনো সময় গল্পগুজব করি। মৃত্যু কখন হবে বলা যায় না। মাঝেমধ্যে বেটা-বেটি দেখতে আসে। সাজু বাবাজি সব সময় আমার খবর রাখে।

বৃদ্ধশ্রমটিতে আশ্রিতদের দেখাশোনা করেন উপজেলার রণচণ্ডী এলাকার মনজিলা পারভীন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বৃদ্ধদের সেবা করতে অনেক ভালো লাগে। তাদের সেবা করতে খাওয়াইতে, ওদের সঙ্গে কথা বলতে, চলতে খুবেই ভালো লাগে। যে কারণে এখানে কাজ করতে আসা। আমি মনে করি এই বৃদ্ধদের সেবাযত্ন করা মানে বাবা-মায়ের সেবাযত্ন করা। তারা ঠিকমতো খাইছে কি না, দুপুরে ঘুমানোর সময় ঠিকমতো ঘুমাইছে কি না, ঠিকমতো ওষুধ খাইছে কি না এসব আমি দেখাশোনা করি।

‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার।’… নন্দিত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার এই গান শুনেই অনুপ্রাণিত হয়ে অসহায় বাবা-মার পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু। স্বপ্ন বুননের সমাপ্তি ঘটিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন ২০১৮ সালে। পেশায় ব্যবসায়ী সাজু কিশোরগঞ্জের বড়ভিটা ইউনিয়নের সামসুল হকের ছেলে।

কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স পাস করে নিজ গ্রামে কীটনাশকের ব্যবসা করে উপার্জিত টাকা দিয়ে নিজের জায়গায় কিশোরগঞ্জ সরকারি কলেজ-সংলগ্ন পাঁচটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করেন। স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রমটির নাম দেন ‘নিরাপদ’ বৃদ্ধাশ্রম।

প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, নচিকেতার গান শুনেই আমার এই প্রতিষ্ঠান তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হই। তখন থেকেই মনে হলো যে বাবা মানে বটগাছ। সন্তানরা যাতে বাবাকে খুব অযত্নে না রাখে, সে জন্যই এই বৃদ্ধাশ্রমটা দেওয়া। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠান তৈরি করার সময় একজনকে নিয়ে শুরু করলেও আস্তে আস্তে ৫৬ জন আসা যাওয়া করেছে।

তিনি আরও বলেন, আমার মূল টার্গেট হলো, সন্তানরা যাতে ভুল বুঝে বাবাকে ফেরত নিয়ে যায়। আমি স্বল্প আয়ের মানুষ ছোট কীটনাশক ব্যবসায়ী। প্রথমে একা শুরু করলেও সমাজের বিত্তবান লোকরা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতেছে। তারা এগিয়ে এলেই এই বয়সে বৃদ্ধ বাবা-মায়ে চিকিৎসা থেকে শুরু করে সবকিছু সুন্দরভাবে করা যাবে।