মমতার ভাইপোকে নিয়ে মন্তব্য করে অন্ধকারে রোদ্দুর, মহানবিকে ক’টূক্তি করে রুনুর ঝুনুর পায়ে ঘুরে বেড়ান নূপুর

| আপডেট :  ৮ জুন ২০২২, ০২:৩৯ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৮ জুন ২০২২, ০২:৩৯ অপরাহ্ণ

প্রশান্ত ভট্টাচার্যঃ পয়গম্বর সম্পর্কে কুকথা বলে নূপুর শর্মা রুনুর ঝুনুর পায়ে ঘুরে বেড়ান আর মমতা-অভিষেক সম্পর্কে অকথা বলে রোদ্দুর রায়ের পায়ে শি’কল। কী আজব দেশ! কী আজব আইপিসি! নবি নিয়ে নূপুরের কথায় আরব দুনিয়ায় ভারতের প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে গিয়েছে বলে বিজেপি বা’ধ্য হয়ে তাঁর পদস্খলন করিয়েছে।

রোদ্দুর রায় তাঁর অসংস্কৃত উপায়ে রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী ও তাঁর আদরের ভাইপোকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন বলে গোয়া থেকে আছড়েপিছড়ে ধরে আনতে হল! আচ্ছা, খিস্তি-খেউড়ের পার্টটা বাদ দিয়ে দেখু’ন, রোদ্দুরের কথাগুলোকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন? আপনি যদি একজন নিবেদিত তৃণমূলি হন, তা’হলে আলাদা কথা। কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিকের যে অধিকার আছে, তাতে তো সে তার মত প্রকাশ করতেই পারে।

ভদ্রবিত্ত বাঙালির স’মস্যাটা হচ্ছে, পেটে ছুঁচোর কেত্তন অথচ ছি’নিয়ে খাবে না। যৌবনের জ্বা’লায় ব্লু ফিল্ম দেখবে, তবু বেশ্যাবাড়ি গিয়ে খরচা করে আসবে না। ইচ্ছে করছে ভাষাবৈচিত্রে ঝেড়ে খিস্তি করি, তবু ভদ্রবিত্ত বাঙালি গ’লা ছাড়বে না। এই ভিক্টোরীয় নৈতিকতার একশ’ আট! সমর সেন বাবুবৃত্তান্তে লিখেছেন, “হেঁদুয়া পার্কে আমাদের খিস্তলজির ক্লাস বসত। অধ্যাপক স্নেহাংশু আচার্য।

তাই বলি, আরে খিস্তি, কে করে না ! প্রকাশ্যে অথবা মনে মনে ! স্বয়ং কার্ল মার্কস তাঁর পভার্টি অফ ফিলোজফি যা প্রুধোঁর ফিলোজফি অফ পভার্টির কাউন্টার টেক্সট, সেখানে প্রুধোঁ সম্পর্কে যা বলেছিলেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, আমি ওঁর দর্শনটাকে ওঁর পিছনে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তাই আমি মনে করি খিস্তি কোনও অমার্জনীয় অ’পরাধ হতে পারে না।

বক্তা কী বলতে চাইছেন, সেটাই আসলে বি’ষয়। সেটাই বিবেচনার। ধরুন কেউ যখন কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে লুঙ্গি তুলে বলেন, সেটা কি খিস্তি নয়? সেটা রোদ্দুরমার্কা খিস্তি না’হলেও ছায়ামার্কা খিস্তি তো বটেই। আমি কারোর হয়ে সালিশি না করেও বলতে পারি, একজন মহিলা সম্পর্কে রোদ্দুর যা বলেছেন,

ভারতীয় ফৌজদারি ধারায় যদি সেটা শ্লী’লতাহা’নি হয়, তা’হলে তিনি গ্রে’ফতার হতেই পারেন। কিন্তু “চাঁদ উঠেছিল গগনে…” করেও ঠাকুর যখন ওঁকে পাপ দেননি, মাপ করে দিলেন ঠাকুরানীও, তখন পারতেন উপেক্ষা করতে। কিন্তু জনৈকের এফআইআরের ভিত্তিতে পুলিশ পদক্ষেপ করল এবং রোদ্দুর এখন কারান্ধকারে।

কিন্তু নূপুর শর্মা? তাঁর ক্ষেত্রে ফৌজদারি পদক্ষেপ করা হচ্ছে না কেন? ভারতীয় দ’ণ্ডবিধির ১৫৩এ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনও ধর্ম, ভাষা, ধর্মগুরু বা অবতারের বি’রুদ্ধে ঘৃণাসূচক মন্তব্য করলে মন্তব্যকারীর ৩ বছর পর্যন্ত জে’ল ও জরিমানা হতে পারে। আর ভারতীয় দ’ণ্ডবিধির ৩৯৫এ ধারায় বলা হয়েছে, এ ধরনের অ’পরাধীর ক্ষেত্রে কোনও ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ তাকে গ্রে’ফতার করতে পারে। আমার বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় স’রকার এই দুটো ধারার কথা অবশ্যই জানে। তা’হলে স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রক কেন নীরবতা পালন করছে? বিজেপির জাতীয় মুখপাত্রর পয়গম্বরের বি’রুদ্ধে এই ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্যে শুধু কানপুর-সহ দেশের মধ্যেই নয়, বিদেশেও প্রভাব পড়েছে। ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, জর্ডন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাহরিন, মলদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া-সহ ১৫ টি দেশ এর নি’ন্দা করেছে। আমাদের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে প্র’তিবাদ জানিয়েছে। বিশ্বের কাছে ভারতবাসীর মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। এমনকী, তালিবান যে তালিবান, সেই শিবির থেকেও ধেয়ে এল সমালোচনা! তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লা মুজাহিদ বলেছেন, “আমরা ভারত স’রকারের কাছে আর্জি জানাচ্ছি এই ধরনের ধর্মান্ধদের পবিত্র ইসলাম ধর্মকে অ’পমান এবং মু’সলিম’দের উসকানি দেওয়া থেকে বিরত করুক।” মুজাহিদ আরও বলেন, “ভারতে শাসকদলের এক কার্যকর্তার নবী মহম্ম’দকে নিয়ে অ’পমানজনক মন্তব্যের তীব্র নি’ন্দা করছে ইসলামিক এমিরেটস অফ আফগানিস্তান।”

আমরা লক্ষ্য করছি, নূপুর-বিতর্কে মুখে কুলুপ এঁটেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কয়েকটি স’রকারি অনুষ্ঠানে তিনি বিভিন্ন বি’ষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেখানে ভারতের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তা নিয়ে একেবারেই ‘নীরব’ মোদী। যদিও মুম্বই পুলিশ খুব শীঘ্রই নূপুরকে সমন পাঠাবে।বি’তর্কি’ত মন্তব্যের জন্য নূপুর শর্মার বি’রুদ্ধে মহারাষ্ট্র, হায়দরাবাদে একাধিক এফআইআর হয়েছে ইতিমধ্যেই। আর বিজেপির সাফাই, দল তাঁর বি’রুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছেন, ক’ঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একজনকে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আর একজনকে সাময়িকভাবে ব’রখাস্ত করা হয়েছে। স’রকার বা প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিল না তা নিয়ে স্পিকটি নট। আর মজার বি’ষয় হচ্ছে, যে নূপুর শর্মাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, শোনা যাচ্ছে তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট এখনও ফলো করছেন প্রধানমন্ত্রী, স্ব’রা’ষ্ট্রমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল। একেই বলে ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এই নূপুর শর্মাকেই ভুয়ো ভিডিও ছড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের বদনাম করার অ’ভিযোগে কলকাতা পুলিশ গ্রে’ফতার করেছিল। মনে রাখতে হবে, কলেজবেলাতেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি নূপুরের। আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৮ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সং’সদের সভানেত্রী হন নূপুর শর্মা। সেই বছরই ৬ নভেম্বর একটি আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছিলেন অধ্যাপক এসএআর গিলানি। এবিভিপি-র কর্মীদের নিয়ে সভাস্থলে পৌঁছে নূপুর শর্মা শুরু করেন ভা’ঙচুর। নূপুরকে দেখা যায়, বিভিন্ন ভাবে গিলানিকে অ’পদস্থ করতে এবং নূপুরের এক সঙ্গী গিলানির মুখে থুতু ছিটিয়েছিলেন। এর পরেই পদোন্নতি শুরু হয়। দ্রুত উঠে আসেন বিজেপির বিশ্বস্ত কেটাগরিতে। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র হন নূপুর শর্মা। এবার নূপুর বেজে উঠতেই প্রবল নি’ন্দার মুখে নরেন্দ্র মোদীর স’রকার।

মোদী তথা বিজেপির সমালোচনায় সরব হয়েছে আরব মুলুক। নবী বি’রোধী মন্তব্যের জেরেই কার্যত এবার নাজেহাল গেরুয়াশিবির। বিশেষ করে, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বিরূপ হতেই নড়ে গিয়েছে নয়াদিল্লি। এই দুটি দেশই ভারতের বন্ধু দেশ। তেল, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, রাষ্ট্রসঙ্ঘে বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের পাশে থাকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির সঙ্গে দুই দেশেরই কূটনৈতিক সম্পর্ক মধুর। ভারতের সঙ্গে, চতুর্থ সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক লেনদেনকারী দেশ সৌদি আরব। পাকিস্তান, চিনের চা’প উপেক্ষা করেও সৌদি আরব বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের পাশে থেকেছে। এবার সেই সৌদি আরবই বেজায় চটেছে মোদী স’রকারের ও’পর। এই নিয়েই বিপাকে পদ্মশিবির। বিদেশমন্ত্রক তো সরাসরি বিজেপির স্ট্যান্ডকেই ভারত স’রকারের স্ট্যান্ড বলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে বার্তা দিচ্ছে, এমন কুকথার জন্য নূপুর ও নবীনকে শা’স্তি দেওয়া হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, অন্য ধর্মের প্রতি এই ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য কি গেরুয়া শিবিরের তরফে নতুন? নূপুর শর্মা’রা যাঁদের হাতে নারিশ হয়েছেন, সেইসব হিন্দুত্ববা’দী নেতারা তো প্রতিষ্ঠাই পেয়েছেন মন্দির-মসজিদ রাজনীতি করে। উমা ভারতী, সাক্ষী মহারাজ, যোগী আদিত্যনাথ, অনন্তকুমার হেগড়ে, কপিল মিশ্র, বিনয় কাটিহার, গিরিরাজ সিংদের তুলনায় তো নূপুররা তুচ্ছ! আসলে মোদীদের লেগেছে অন্য জায়গায়। যাকে বলে পেটে টান পড়ে যাওয়ার উপক্রম। শা’স্তির খাঁড়া নামার পরও আরব দুনিয়ার ক্ষো’ভের আঁচ কমেনি। প্রা’ণে মা’রার হু’মকিও দেওয়া হচ্ছে নুপূরকে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে, কুয়েতের এক সুপার মার্কেট ভারতীয় পণ্য সামগ্রী বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মনে রাখতে হবে, পশ্চিম এশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল দেশে আম’দানি করা হয়। এই ঘটনার জেরে তেল আম’দানিতে কোনও প্রভাব পড়বে কি না, সেই আ’শঙ্কায় রয়েছে মোদী স’রকার। তেল বিক্রি অথবা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে, সৌদি আরব নি’ষেধাজ্ঞা জারি করলে, পেট্রল ডিজে’লের দাম যে পর্যায়ে পৌঁছবে তাতে ভারতের অর্থনীতি ক্ষ’তির মুখে গিয়ে পড়বে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে সাতটি উপসাগরীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত ২ হাজার কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য করেছে, যা ভারতের মোট আম’দানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ১৯ শতাংশ। ভারতের সঙ্গে, চতুর্থ সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক লেনদেনকারী দেশ সৌদি আরব। ভারতের প্রতি পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর বিরূপ মনোভাব দেশের বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে। নেমে আসতে পারে অর্থনীতিতেও ধস। আ’শঙ্কার মেঘ পিএমও-তে। এছাড়াও ওইসব দেশে প্রচুর ভারতীয় বসবাস করেন। তাঁদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। চিন্তিত ভারত স’রকার। তবে বিজেপি তার জন্মলগ্ন থেকেই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে তাই নূপুর-নবীনের শা’স্তি নিয়ে দলেও নীচের তলায় ক্ষো’ভ দেখা দিচ্ছে। গত তিন-চার দশক ধরে যাঁরা রাস্তায় নেমে পদ্ম ভোট নিশ্চিত করেন, তাঁরা অনেকেই মনে করছেন, নূপুরদের সঙ্গে বিশ্বাসঘা’তকতা করেছে দল। দেশে-বিদেশে আ’ক্রমণের মুখে পড়া দুই মুখপাত্রের পাশে যখন দাঁড়াবার কথা দলের তখন তাঁদের ব’হিষ্কার করে দল কঠিন পরিস্থিতির সামনে ঠেলে দিয়েছে। শা’স্তি দিয়েও চিন্তায় আছেন দীনদয়াল মার্গের ম্যানেজাররা, চব্বিশের ভোটের আগে জ্ঞানবাপী, মথুরা, কুতুব সামনে রেখে যে ধর্মীয় মেরুকরণ করতে হবে, তা হোঁচট খাবে না তো নূপুর খসে যেতে?

বাস্তবিক, মোদী-শাহরা উভ’য়সং’কটে পড়েছেন। বিজেপির এই মু’সলমান বিদ্বেষী রাজনীতি নিয়ে দেশেও ক্ষোভের পাহাড় জমেছে। দেশের কর্পোরেট ও বাণিজ্য মহল মোদী স’রকারকে ইতিমধ্যেই হু’মকির সুরে জানিয়ে দিয়েছে, যেভাবেই হোক মু’সলমান বিদ্বেষী প্রবণতা কমাতে হবে। এবার এল পশ্চিম এশিয়া থেকে চা’প। ছম ছম পায়েল বাজবে, না অন্যকিছু? রোদ্দুরে-নূপুরে জমে ক্ষীর এখন ভদ্রবিত্ত বাঙালির জগমোহন।

(এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। এই সময় ডিজিটাল কোনও ভাবেই লেখার দায়ভার বহন করে না।) সুত্রঃ এই সময়