পি কে’র সঙ্গী শর্মীকে নিয়ে ধূম্রজাল

| আপডেট :  ২৬ মে ২০২২, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৬ মে ২০২২, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে ভারতে ধরা পড়েছেন প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আরও পাঁচ সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করেছে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তাদের মধ্যে আছেন স্বপন মৈত্র ওরফে স্বপন কুমার মিস্ত্রি, উত্তম মৈত্র ওরফে উত্তম কুমার মিস্ত্রি ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার, আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদার ও প্রাণেশ কুমার হালদার। পি কে হালদারের এই সহযোগী কারা? কি তাদের পরিচয় এ নিয়ে রয়েছে কৌতূহল। কবে থেকে তারা ভারতে অবস্থান করছেন, তারা কি ভারতীয় নাকি বাংলাদেশের নাগরিক। এসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারকেও নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য। কে এই নারী? পি কে’র স্ত্রী না বান্ধবী? যদিও ইডির দাবি, শর্মী হালদার পি কে ওরফে প্রশান্ত কুমারের স্ত্রী। যার ছদ্মনাম আমানা সুলতানা।

শিবশঙ্কর হালদার ছদ্মনামে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড, স্থায়ী অ্যাকাউন্ট নম্বর ও আধার কার্ডের মতো বিভিন্ন সরকারি পরিচয়পত্র তৈরি করে সেখানে অবস্থান করছিলেন পি কে হালদার। তিনি তার পাচার করা অর্থ দিয়ে কলকাতার অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কিনেছেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি
বিজ্ঞাপন
এসব কাজে তার ব্যক্তিগত আইনজীবী সুকুমার মৃধা সহায়তা করেন। পরবর্তীতে তিনিও গ্রেপ্তার হন। তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানতে গিয়ে মানবজমিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া পি কে’র পাঁচ সহযোগী প্রত্যেকেই বাংলাদেশের নাগরিক। তারা ভারতে ছদ্মনামে আত্মগোপনে ছিল। তাদের রয়েছে দ্বৈত পাসপোর্ট, পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। অবৈধভাবে ভারতের নাগরিক হয়েছেন পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী এবং স্থানীয়ভাবে মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত সুকুমার মৃধার দুই ভাগ্নে ও তাদের স্ত্রী।

পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগরের বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস করেন সুকুমার মৃধার দুই ভাগ্নে। সেখানেই আত্মগোপনে ছিলেন পি কে হালদার। আলিশান সেই বাড়িতে এখনো আছেন সুকুমার মৃধার ভাগ্নে স্বপন কুমার মিস্ত্রি ও উত্তম কুমার মিস্ত্রি, উত্তমের স্ত্রী রচনা এবং তাদের সন্তানরা। তারা দুই দেশেই থাকছেন। তাই দুই দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন বলে দাবি করেন তারা। এর মধ্যে স্বপন কুমার মিস্ত্রি এবং তার স্ত্রী পূর্ণিমা রানী হালদার আবার দুদকের চার্জশিটভুক্ত আসামি। সুকুমার মৃধার সহযোগিতায় পি কে হালদারের বাংলাদেশ থেকে ভারতে টাকা পাচার করার মূল কারিগর ছিলেন তারই দুই ভাগ্নে উত্তম এবং স্বপন কুমার।

তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। স্বপন মিস্ত্রি ও উত্তম মিস্ত্রি সম্পর্কে আপন ভাই। তাদের বাড়ি পিরোজপুর। বাবার নাম উপেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি। অর্থ লোপাটের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে মামলা হলে ভারতে পাড়ি জমান। পরবর্তীতে তারা পদবি বদলে স্বপন মিস্ত্রি থেকে স্বপন মৈত্র এবং উত্তম মিস্ত্রি থেকে উত্তম মৈত্র হয়ে যান। তাদের দুজনের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যাংক থেকে ১৬০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে ২০২১ সালের ২২শে মার্চ মামলা করে দুদক। পি কে হালদারের এই দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্বপন-উত্তম এবং তাদের স্ত্রীদের নামে রাজধানীর তেজগাঁওসহ বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অবৈধ সম্পত্তি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পি কে হালদারের সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য পূর্ণিমা রানী হালদার এবং তার স্বামী স্বপন কুমার মিস্ত্রির বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুদক।

চক্রের অন্যতম সদস্য ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদারের প্রকৃত নাম ইমাম হোসেন। পুরানা পল্টনে ছিল তার নিজস্ব অফিস। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরের মহাদেবপুর গ্রাম। ইমাম হোসেনের বাবার নাম মো. নুর হোসেন। এলিকো ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সেখান থেকেই পি কে হালদারের সঙ্গে পরিচয়। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক ব্যাংক থেকে ৬৮ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের ২১শে মার্চ তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে দুদক। এরপর থেকেই তিনি পি কে হালদারের ছত্রছায়ায় ভারতে আত্মগোপনে চলে যান। সেখানে ইমাম হোসেন থেকে হয়ে যান ইমন হালদার। পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী এবং ভাই প্রাণেশ কুমার হালদার। তার নামেও রয়েছে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। পি কে’র ভাই প্রাণেশ হালদার আগে থেকেই ভারতে থাকতেন।

ওদিকে রহস্যময়ী নারী আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারকে নিয়ে ধূম্রজালে দুদক এবং অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা। দুদকের তদন্তে এখন পর্যন্ত পি কে হালদারের একাধিক বান্ধবীর নাম উঠে এসেছে। তবে আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারই কি পি কে হালদারের স্ত্রী সুস্মিতা সাহা? নাকি বান্ধবী? রহস্যময়ী এই নারীর প্রকৃত পরিচয় জানতে কাজ করছে দুদকসহ একাধিক সংস্থা। রহস্যজনকভাবে গ্রেপ্তারের তালিকায় নেই পি কে’র স্ত্রী সুস্মিতা সাহার নাম। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শর্মীকে প্রশান্ত কুমার হালদারই তার মিথ্যা পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ভুয়া পাসপোর্টে আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদার কানাডা ভ্রমণও করেছেন কিনা, এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। সুস্মিতা সাহা ছদ্মনামে আমানা সুলতানা এবং পরে আবার শর্মী হালদার হয়েছেন কিনা সেটাও তদন্তের বিষয়। শর্মী হালদারের নামেই ভারতে পি কে হালদারের ব্যাংকিং লেনদেনের সন্ধান পেয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

সূত্র জানায়, ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠান ইমেক্সোর নামে ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদারের একটি ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান ছিল। যার বাস্তবিক কোনো অস্তিত্ব ছিল না। লিপরো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন উত্তম কুমার মিস্ত্রি। গত বছরের মার্চ মাসে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা পাঁচ মামলার তালিকায় রয়েছে তার নাম। ৪৩৪ কোটি টাকা আত্মসা?তের অভি?যো?গে পি কে হালদারসহ ৩৭ জ?নের বিরু?দ্ধে পাঁচটি মামলা ক?রে দুদক। তারা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কোম্পানি থেকে এই টাকা ভুয়া ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে। এই ভুয়া কোম্পানিগুলো এবং আত্মসাৎ করা টাকার মধ্যে উত্তম কুমার মিস্ত্রির লিপরো ইন্টারন্যাশনালের নামে ১৭৪ কোটি টাকা, ইমাম হোসেনের ইমেক্সো লিমিটেডের নামে ৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

পি কে হালদার পিরোজপুরের বাসিন্দা হওয়ায় তার সঙ্গে শুরু থেকেই ভালো সম্পর্ক ছিল স্বপন কুমার মিস্ত্রি এবং উত্তম কুমার মিস্ত্রির। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে স্বপন মিত্র ওরফে স্বপন কুমার মিস্ত্রির নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট- বিআইএফআইইউ’র অনুসন্ধানে পি কে হালদারের অর্থ পাচারের সঙ্গে পিরোজপুরের বাসিন্দা স্বপন কুমার মিস্ত্রি ও তার স্ত্রী পূর্ণিমা রানী হালদার, স্বপনের ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রি ও উত্তমের স্ত্রী রচনা ওরফে অতসী মৃধার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। পি কে হালদারের অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ঘনিষ্ঠদের তালিকায় থাকা অন্তত ৭০ জনের মধ্যে অনেকেই ভারতে গিয়ে নামের আংশিক পরিবর্তন করে জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে। একইভাবে উত্তম, স্বপন এবং ইমাম হোসেন ভুয়া নাগরিকত্বের কাগজপত্র তৈরি করে ভারতে অবস্থান করেন।

৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের মামলায় গত ১০ই মার্চ পি কে হালদারসহ দশ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। এদের মধ্যে রয়েছেন- উত্তম কুমার মিস্ত্রি, পি কে হালদারের নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদার, তার স্বামী স্বপন কুমার মিস্ত্রি। পূর্ণিমার নামে উত্তরায় একটি ভবন তৈরি করেছেন পি কে হালদার। যার মূল্য ১২ কোটি টাকা। উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রীন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি ক্রয় করেন পি কে হালদার। যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা। গত ১০ই মে পি কে’র দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী পূর্ণিমা রানী হালদার ও তার স্বামী স্বপন কুমার মিস্ত্রির বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়ায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। পি কে হালদার সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য পূর্ণিমা রানী হালদার ও তার স্বামী স্বপন কুমার মিস্ত্রির বিরুদ্ধে ২০০৪-এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারায় মামলাটি করা হয়। এর মধ্যে পূর্ণিমার বিরুদ্ধে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৮১ হাজার টাকা এবং স্বপন কুমার মিস্ত্রির বিরুদ্ধে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, ইমাম হোসেন ওরফে ইমনের কাগুজে প্রতিষ্ঠান ইমেক্সোর নামে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফসিএল) থেকে ৫৮ কেটি টাকা ঋণ মঞ্জুর হয়। কিন্তু তিনি ৬৮ কোটি টাকা উত্তোলন করেন। উত্তোলনকৃত এই অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় গত বছরের ২১শে মার্চ তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলার পর থেকেই তিনি পলাতক। ইমাম হোসেন এবং তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পায়নি তদন্ত কর্মকর্তারা। স্বপন কুমার মিস্ত্রি নিউট্রিক্যাল কোম্পানির নামে একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৬০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর হলে ৮০ কোটি টাকা উত্তোলন করেন লিপরো ইন্টারন্যাশনালের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ঘটনায় গত বছরের ২২শে মার্চ আদালতে মামলা করে দুদক। তার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রি পোলাসিন লিমিটেড নামে কাগুজে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৮০ কোটি টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা উঠিয়ে নেয়। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে একই বছর মামলা করে দুদক।

দুদকের উপ-পরিচালক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান মানবজমিনকে বলেন, ভারতে গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে ছদ্মনামে অবস্থান করা পি কে হালদারসহ তার অন্য সহযোগী উত্তম কুমার মিস্ত্রি, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে বিশেষ শাখা। দুদক কার্যালয়ের পরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সম্প্রতি ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া স্বপন, উত্তম, ইমাম হোসেনসহ একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুদকে মামলা রয়েছে। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করে দিয়েছে দুদকের বিশেষ শাখা।