কেমন আছেন ইমাম-মুয়াজ্জিনরা

| আপডেট :  ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০৯:৫৭ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০৯:৫৭ পূর্বাহ্ণ

ইজহারুল ইসলাম। এক যুগ ধরে ইমামতি করছেন রাজধানীর একটি মসজিদে। বেতন সাড়ে ১১ হাজার টাকা। এর প্রায় পুরোটাই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। ইমামতির পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় পড়ান তিনি। সেখান থেকে সামান্য কিছু আয় হয়। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারে পাঁচ সদস্য। ছেলে একই মসজিদের মোয়াজ্জিন। বেতন পান ৮ হাজার টাকা। বাবা-ছেলের আয় মিলে অতিকষ্টে চলে সংসার। ঋণ করতে হয় মাঝেমধ্যেই।

বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে রীতিমতো লড়তে হচ্ছে তাকে। ইজহারুল ইসলাম বলেন, এদেশে ইমামদের কদর খুবই কম। আয়ও সামান্য। এই আয়ে ঢাকায় সংসার চালানো খুবই কঠিন। আমি মসজিদ থেকে যে সম্মানি পাই তা থেকে বাড়িভাড়া দেয়ার পর অল্প কিছু টাকা থাকে। এই টাকায় এক বস্তা চাল কেনাও সম্ভব না। শেষ কবে গরুর মাংস কিনেছি তা মনে নেই। আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকি। তার ছেলে মো. আবির বিন ইজহার বলেন, কঠিন বিপদের মধ্যে আছি আমরা।

রাজধানীর সবুজবাগের হীরাঝিল জামে মসজিদের ইমাম মো. ওলিউল্লাহ। মা-বাবা আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ৭ জনের পরিবার তার। ইমামতির সুবাদে তিনি ঢাকার মসজিদে থাকলেও তার পরিবারের সবাই কুমিল্লার হোমনা উপজেলায় থাকেন। ওলিউল্লাহ মসজিদ থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা পান। এ টাকায় তার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তিনি বলেন, আমি ঢাকায় একা থাকি। মসজিদে থাকা গেলেও খাওয়ার কোনো সুবিধা নেই। তাই মাসে আমার খাবারের জন্য ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া গাড়ি ভাড়া, মোবাইল খরচ বাবদ আরও তিন হাজার টাকা লাগে। গ্রামে শুধু সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য পাঁচ-ছয় হাজার টাকা দিতে হয়। পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের টিউশনি কিংবা অন্য পেশার খোঁজ করতে হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা করার সুযোগও থাকে না।

হীরাঝিল জামে মসজিদের এই ইমাম জানান, মসজিদের ইমাম এবং মোয়াজ্জিনদের বেতন সামান্য। গ্রাম পর্যায়ে একজন ইমামের বেতন তিন-চার হাজার টাকা। বড় কোনো মসজিদ হলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা হয়। অথচ বর্তমানে এক বস্তা চাল কিনতে তিন হাজার টাকা প্রয়োজন। পাঁচ লিটারের এক বোতল তেল কিনতে গেলে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার প্রয়োজন।

২০১৫ সাল থেকে একটি মসজিদের খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুস সালাম। তার মাসিক বেতন ৭ হাজার টাকা। তিনি বলেন, আমরা যারা মসজিদে চাকরি করি আমাদের বেতন অনেক কম। একজন দিনমজুরের ইনকামও আমাদের থেকে অনেক বেশি। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধাও আমরা পাই না। যাদের চলার সামর্থ্য নাই তারা মসজিদেই থাকে। অনেকে টিউশনি করে কিছু আয় করে। একজন খাদেমের বেতন দেয়া হয় ৬-৭ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে কোনোভাবেই সংসার চলে না। আমরা মেসে খাওয়া-দাওয়া করলেই মাসে ৪ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়।

বাকি টাকা দিয়ে কোনোভাবেই পরিবার নিয়ে চলা যায় না। আর এখন নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি। এতে আমাদের আরও বেশি কষ্ট করতে হয়। সবাই মাছ-মাংস খায় আমারা তা খাই না। আলু-ডাল দিয়েই ভাত খেতে হয়। শাহদাত হোসেন নামের এক ইমাম বলেন, বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম বেশি। সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। এজন্য আমাদের উপরেও প্রভাব পড়েছে। তারা ভালো চলতে না পারলে মসজিদেরও আয় কমে যায়। আমাদেরও বেতন দেয়া কষ্ট হয়। মুসল্লিরা ভালো না থাকলে তো আমরাও ভালো থাকতে পারি না।

খিলগাঁও কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসা এক মসজিদের ইমাম মো. আবদুর রশিদ বলেন, বর্তমানে জিনিসপত্রের অনেক দাম। আমাদের মতো যারা ছোট ছোট মসজিদের ইমাম তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমরা কাউকে কিছু বলতে পারি না। আল্লাহর উপরে ভরসা করে থাকি। এখন রোজার মাস। সামনে ঈদে সবাই বোনাস পাবে। কিন্তু আমাদের মতো অনেক ইমামরাই ঈদের কোনো বোনাস পান না। অথচ আমাদেরও তো পরিবার আছে। সন্তান আছে। তাদের জন্যও ঈদে বাড়তি খরচ করার প্রয়োজন হয়। ভালোমন্দ খাবার রান্না করতে হয়। এগুলো কীভাবে করবো।

পঞ্চগড় বাস টার্মিনাল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মো. আব্দুল মান্নান। ২৯ বছর ধরে ইমামতি করেন তিনি। সীমিত বেতনে ভাড়া বাড়িতে থেকে স্ত্রী ও এক প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে কোনোরকমে টিকে আছেন। মাওলানা আব্দুল মান্নান ১৯৯৪ সালে এই মসজিদে দেড় হাজার টাকা বেতনে ইমামতি শুরু করেন। প্রতিবছর কিছু করে বাড়তে বাড়তে গত মার্চ মাস পর্যন্ত তার মাসিক বেতন দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এরমধ্যে বাড়ি ভাড়া দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। তবে সামনে মাস থেকে মসজিদ কমিটি দেড় হাজার টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাওলানা আব্দুল মান্নান বলেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এক সময় অনেক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। বর্তমানে ঋণমুক্ত হলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি। বেঁচে থাকলে বয়স বাড়বে। এক সময় তো ইমামতি ছেড়ে দিতে হবে। তখন কী করবো।

এই মসজিদের মোয়াজ্জিন মো. খলিলুর রহমানেরও অনেকটা একই অবস্থা। ঋণ তাকে ছাড়ছে না। তিন মেয়ের বিয়ে দিতে তার খরচ হয়েছে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। এ টাকা পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করেছেন। কিন্তু এখনো তাকে মেয়েদের আর্থিক সহযোগিতা করতে হয়। এক মেয়ের সমস্যার কারণে কিছুদিন আগে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। তিনি এক ছেলে ও তার স্ত্রীকে টাকা দিয়ে কাজের সন্ধানে ঢাকা পাঠিয়েছেন। সদর উপজেলার যতনপুকুরী গ্রামের মোয়াজ্জিন খলিলুর রহমান বলেন, এ মসজিদে আমি ২৩ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছি। গত মাস পর্যন্ত আমার বেতন ছিল সাড়ে ৬ হাজার টাকা। সামনের মাস থেকে দেড় হাজার টাকা বাড়ার কথা রয়েছে। তিনি বলেন, বসতবাড়ি ছাড়া আমার আর কোনো জমি নেই। মানুষের সহযোগিতায় কোনোমতে স্ত্রীকে নিয়ে জীবনযাপন চলছে। ছেলেরা যে আয় করে তা দিয়ে তারাই চলতে পারেনা। আমাকে দিবে কি।

ইসলামী ফাউন্ডেশনের তালিকা অনুযায়ী পঞ্চগড় জেলায় মসজিদের সংখ্যা ২৪৩৭টি। তবে বেসরকারি তথ্যমতে, মসজিদের সংখ্যা ২৯০০। স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে আয়কৃত টাকা থেকে ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের বেতন ভাতা দেয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালিত হয়। শহরভিত্তিক মসজিদগুলোর বিভিন্ন খাত থেকে আয় মোটামুটি হলেও গ্রামের মসজিদগুলোর আয় তেমন একটা নেই। এ জন্য গ্রামের মসজিদগুলোর ইমাম মোয়াজ্জিনদের বেতন ভাতাও কম দেয়া হয়।

পঞ্চগড় ইসলামী ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মো. শামীম সিদ্দিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইমামদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট করে দিয়েছেন। এ ট্রাস্টে ইমামরা সদস্য হয়ে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে তাদের আর্থিক সুবিধা ও সুদমুক্ত ঋণ পাবার সুযোগ রয়েছে। ২০২০ সালে ২৪৩৭ জন ইমামকে করোনাকালীন আর্থিক সুবিধা হিসেবে ৫ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে।