ছাত্রীকে যৌ’ন হয়রানির অভিযোগের পর অবসরে যেতে চান ঢাবি শিক্ষক বিশ্বজিৎ ঘোষ

| আপডেট :  ২২ এপ্রিল ২০২২, ১০:৫২ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ এপ্রিল ২০২২, ১০:৫২ অপরাহ্ণ

ছাত্রীকে যৌ’ন হ’য়রানির দায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ চাকরির মেয়াদ আগেই অবসরে যেতে আবেদন করেছেন।বুধবার (২০ এপ্রিল) অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ নিজেই বি’ষয়টি নিশ্চিত করে ভ’য়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের আবেদন করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি’ষয়ে আমি আর মন্তব্য করতে চাই না।”

নিজের বি’রুদ্ধে অ’ভিযোগ বি’ষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “এই বি’ষয়ে বিভাগ (বাংলা বিভাগ) বিস্তারিত বলতে পারবে। আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না।” তার বি’রুদ্ধে উঠে আসা অ’ভিযোগ মেনে নিয়েছেন কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অ’ভিযোগ বি’ষয়ে যা বলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ত’দন্ত কমিটির কাছে বলেছি। নতুন করে আর কিছু বলার নেই।”

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের অবসরের বি’ষয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক মন্তব্য করতে রাজি হননি। একই বিভাগের অধ্যাপক ভীষ্ম’দেব চৌধুরী ভ’য়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এই বি’ষয় নিয়ে আমি আসলে কথা বলতে চাই না।”

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের অবসরের আবেদনটি বিভাগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিষ্ট্রার আব্দুল কুদ্দুছ ভূঞা (প্রশাসন-৫) ভ’য়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এখনও আমাদের কাছে তার ( বিশ্বজিৎ চৌধুরীর) অবসরের আবেদন এসে পৌঁছায়নি। আমাদের হাতে হলে নিয়ম অনুযায়ী প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্ম’দ সামাদ ভ’য়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর বি’রুদ্ধে এবারই যে প্রথম অ’ভিযোগ এসেছে, তা নয়। এর আগেও একাধিকবার তার বি’রুদ্ধে এমন অ’ভিযোগ এসেছে। এটা (যৌ’ন হ’য়রানি) তো শা’স্তিযোগ্য অ’পরাধ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক হচ্ছে অভিভাবকের সাথে স’ন্তানের সম্পর্ক। সেখানে যদি এমন ঘটনা ঘটে তবে তা কোনো ক্রমেই মেনে নেওয়া উচিৎ না।”

তার (অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ) বি’রুদ্ধে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি অন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে কিনা, জানতে চাইলে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর বলেন, “এটা বাংলা বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেজিষ্ট্রার অফিসে পাঠানো হয় সাধারণত। পরে নিয়ম অনুযায়ী সিন্ডিকেট সভা বা অন্যান্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “তার ( বিশ্বজিৎ ঘোষ-এর) (এই) বি’ষয়টি এখনও আমার জানা নেই।”

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ এর বি’রুদ্ধে এক ছাত্রীকে যৌ’ন হ’য়রানির বি’ষয়ে জানতে চাইলে উপা’চার্য ভ’য়েস অফ আমেরিককে বলেন, “এই বি’ষয়ে আমি এখনও বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি সাম্য, সুশিক্ষা ও সম্প্রীতির নিরাপদ প্রতিষ্ঠান। এখানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক হচ্ছে খুবই সম্মানজনক একটি বি’ষয়। এমন ঘটনা কখনো কাম্য হতে পারে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির বয়স ৬৫ বছর। অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ১৯৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সেই হিসেবে আরও এক বছর পরে আগামী ২০২৩ সালে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এর আগে বিশ্বজিৎ ঘোষ ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপা’চার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন।

বিশ্বজিৎ ঘোষের বি’রুদ্ধে অ’ভিযোগঃ বাংলা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চে বিভাগের চেয়ারম্যান সৈয়দ আজিজুল হকের কাছে বিশ্বজিৎ ঘোষের বি’রুদ্ধে যৌ’ন নি’পীড়নের লিখিত অ’ভিযোগ দেন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী। ২৯ মার্চ বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় অ’ভিযোগটি উত্থাপন করা হলে কমিটি সর্বসম্মতভাবে বিশ্বজিৎ ঘোষের বি’রুদ্ধে শা’স্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বজিৎ ঘোষসহ ১৮ শিক্ষক ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন।

বাংলা বিভাগের একাডেমিক কমিটির ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, বিশ্বজিৎ ঘোষের বি’রুদ্ধে একজন শিক্ষার্থীর আনা যৌ’ন নি’পীড়নের লিখিত অ’ভিযোগের বি’ষয়টি বিভাগের চেয়ারম্যান একাডেমিক কমিটির সামনে উপস্থাপন করেন। তিনি ওই ছাত্রীর অ’ভিযোগপত্রটি পড়ে শোনান। কমিটির সদস্যরা এ বি’ষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। বিশ্বজিৎ ঘোষ ওই ঘটনায় তার ভু’ল হয়েছে বলে মনে করেন। তিনি সবার কাছে ‘ক্ষমা প্রার্থনা ও করুণা ভিক্ষা’ করেন। কিন্তু একাডেমিক কমিটির সদস্যরা তার দ্বারা সংঘটিত অতীতের বিভিন্ন যৌ’ন নি’পীড়নের ঘটনার কথা উল্লেখ করে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রার্থনা গ্রহণ করেননি। বিশ্বজিৎ ঘোষ নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও সভায় উপস্থিত শিক্ষকদের কাছে তা সত্য বলে মনে হয়নি। বরং তার ‘ক্ষমা প্রার্থনা ও করুণা ভিক্ষার’ ঘটনায় তার অ’পরাধ স্বীকারের বি’ষয়টিই প্রমাণিত হয়।

ছাত্রীকে যৌ’ন নি’পীড়নের অ’ভিযোগে গত ২৯ মার্চ বিশ্বজিৎ ঘোষকে সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়াসহ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একাডেমিক কমিটি।

কার্যবিবরণীতে বলা হয়, একাডেমিক কমিটি সর্বসম্মতভাবে বিশ্বজিৎ ঘোষের বি’রুদ্ধে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো হলো- সব একাডেমিক কার্যক্রম (সব ধরনের ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষায় প্রত্যক্ষণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, এমফিল-পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধায়ন, পরীক্ষা কমিটির কাজে অংশগ্রহণ প্রভৃতি) থেকে বিশ্বজিৎ ঘোষকে অব্যাহতি দেওয়া, ভবি’ষ্যতে তাকে কোনো একাডেমিক কার্যক্রমে যুক্ত না করা, সিঅ্যান্ডডি ও একাডেমিক কমিটির সভায় তাকে না ডাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে তার নামে বরাদ্দ থাকা বিভাগীয় কক্ষ বাতিল, আরও বৃহত্তর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বি’ষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা হবে কি না, অ’ভিযোগকারীর মতামত সাপেক্ষে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ত’দন্তের সময়ও একাডেমিক কমিটির এসব সিদ্ধান্ত বহাল রাখা।

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক বাতিলের দাবিঃ যৌ’ন নি’পীড়নের অ’ভিযোগ ওঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাসদের ছাত্রসংগঠন। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই দাবি জানায় বাংলাদেশ জাসদের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএল। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি গৌতম চন্দ্র শীল ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান এই বিবৃতি দিয়েছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, “বিশ্বজিৎ ঘোষ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক পেয়েছেন। কিন্তু তারা বিশ্বাস করে, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। বিশ্বজিৎ ঘোষের সঙ্গে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ যেকোনো রকম সম্মাননাই বেমানান। তাই তাদের দাবি, অবিলম্বে বিশ্বজিৎ ঘোষের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক বাতিল করা হোক। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শা’স্তির আওতায় আনা হোক।”

স্থায়ী ব’হিষ্কার চায় ছাত্র ফ্রন্টঃ বিশ্বজিৎ ঘোষকে ‘যৌ’ন নি’পীড়নকারী’ আখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার স্থায়ী ব’হিষ্কার দাবি করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবা’দী)। ছাত্রসংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “যৌ’ন নি’পীড়নের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পর বিশ্বজিৎ ঘোষকে সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বাংলা বিভাগ। এমন নরম পদক্ষেপ প্রমাণ করে, দেশের সমাজে নারীর বি’রুদ্ধে যৌ’ন নি’পীড়নের ঘটনাকে কতটা হালকাভাবে দেখা হয়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বজিৎ ঘোষের স্থায়ী ব’হিষ্কারের দাবি জানাচ্ছে।”

প্রতিক্রিয়াঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক শেষ পর্যায়ের এক শিক্ষার্থী নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কথা জানিয়ে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দ্বারা আমাদের দেশে এর আগেও অনেক নারী শিক্ষার্থী হ’য়রানির শি’কার হয়েছেন। অনেকের শিক্ষাজীবন এলেমেলো হয়ে গেছে। তখন সেগুলো দূর থেকে জেনেছি বা শুনেছি। এখন নিজের বিভাগের এই ঘটনা জানার পর খুবই অনিরাপদ বোধ করছি। এইসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে ভবি’ষ্যতে কেউ আর সাহস পাবে না। ”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবায়দা নাসরিন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌ’ন নীপিড়ন অ’ভিযোগ ত’দন্ত সেলের একজন সদস্য। তিনি বলেন, “আমি অ’ভিযোগটি শুনেছি। ইতিমধ্যে বাংলা বিভাগ ব্যবস্থা নিয়েছে বলেও জানলাম। এখন কথা হচ্ছে, এইভাবে অ’ভিযোগ উঠে আসা কিন্তু নতুন নয়। বিভিন্ন ঘটনায় প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- একজন শিক্ষার্থী কম পর্যায়ে হ’য়রানি হলে এইভাবে লিখিত অ’ভিযোগ জানায় না। এইসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজে নারীদের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা এবং নারীদের যৌ’ন সামগ্রী ভাবার শস্তা পুরুষতান্ত্রিক মা’নসিকতার প্রকাশ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন ঘটনা এটাই নির্দেশ করে যে, দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নারী শিক্ষার্থীরা এইভাবে অনিরাপদ হতে পারেন।”

বাংলা একাডেমির সভাপতি ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, “শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের এমন অ’ভিযোগ যখন আসে তখন আর বড়কিছু বলার সুযোগ থাকে না। পুরো বি’ষয়টা হতাশার।” বিশ্বজিৎ ঘোষের বাংলা একাডেমি ও রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার বাতিলের বি’ষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বি’ষয়ে আমি যেহেতু সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নই, তাই এখনই কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্ম’দ নূরুল হুদা বলেন, এখনো আমাদের কাছে এমন কোনো অ’ভিযোগ জানিয়ে আবেদন আসেনি। সূত্রঃ ডয়েচ ভেলে