মনের দুঃখে চোখে জল এলেও কাউকে বুঝতে দেননি কনস্টেবল থেকে এএসপি হওয়া হাকিম

| আপডেট :  ৫ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০৯ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৫ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০২ অপরাহ্ণ

এত দিন তো ওসি-এসআইদের ডাকে ‘ইয়েস স্যার’ বলে ছুটতে হতো আপনাকে। সামনের দিনে তো তাঁরাই আপনার ডাকে ‘স্যার, স্যার’ বলে হাজির হবেন? মজার ছলে জানতে চাইলাম হাকিমের কাছে। একগাল হেসে হাকিম বললেন, ‘না ভাই, আমি যেমন আছি তেমনই থাকার চেষ্টা করব। সবার কষ্ট আমি বুঝি।স্যার হওয়ার চেয়ে ভালো মানুষ হতে চেষ্টা করব।’

কয়েক দিন আগেই কনস্টেবল থেকে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন হাকিম। বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার শ্রীনগরে। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। ২০১০ সালে সায়েদাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং রায়পুরা কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন। নরসিংদী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে অনার্সে ভর্তি হন।

কিছুদিন পরই পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি হয় তাঁর। ছয় মাসের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৩ সালে গাজীপুর শিল্প পুলিশে যোগদান করেন। সেখানে বছর দুয়েক ছিলেন। পরে ২০১৫ সালে বদলি হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) আসেন। পোস্টিং হয় পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগে। সেখানে থাকা অবস্থায়ই নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে ২০১৬ সালে অনার্স শেষ করেন। শিল্প পুলিশে থাকার সময় কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন।

কিন্তু ডিএমপিতে কাজের চাপে দিশাহারা অবস্থা। এক রাতে হাকিমের ডিউটি পড়ে গাবতলীর শেষ প্রান্তের একটি পাম্পে। নোংরা পরিবেশ। বসার কোনো জায়গা নেই। এক জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়াবেন সে অবস্থাও নেই। কারণ মশার উৎপাত। রাতভর দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে ডিউটি করেছেন। সেদিনই আসলে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন এই চাকরিতে চলবে না। নিদেনপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে হবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

এরপর নায়েক র‌্যাংকে বিভাগীয় পরীক্ষা দিলেন ২০১৬ সালের শেষের দিকে। ২০১৭ সালে নায়েক পদে পদোন্নতি পেলেন। পরে তাঁর পোস্টিং হয় প্রটেকশন বিভাগে, নওয়াব আবদুল গনি রোডে। এখানে কাজের চাপ তুলনামূলক কম। ডিউটি শেষে পড়াশোনার সুযোগ পেতেন। এভাবে পড়াশোনা করেই স্নাতক পাস করলেন সিজিপিএ ৩.৩০ পেয়ে। আবেদন করলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য উপপরিদর্শক পদে। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতও হলেন। কিন্তু বিভাগীয় ছাড়পত্র পাননি বলে আর সে চাকরিতে যোগদান করতে পারলেন না!

মনের দুঃখে চোখে জল এলেও কাউকে বুঝতে দেননি। হাকিম হারার পাত্র নন। মনে জেদ চেপে গেল। স্বাস্থ্য উপপরিদর্শক পদে নির্বাচিত হয়ে আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া লেগেছিল। চাকরিতে কঠিন সংগ্রামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। স্বপ্ন যে তাঁর আকাশচুম্বী! ২০১৮ সাল। ৪০তম বিসিএসে সার্কুলার হলো। এবার আগেভাগেই বিভাগীয় অনুমতি নিয়ে বিসিএসে আবেদন করলেন।

চাকরির পাশাপাশি চলল তাঁর প্রস্তুতি। মালিবাগে একটি কোচিং সেন্টারেও ভর্তি হয়েছিলেন। যেদিন দিনে ডিউটি থাকত সেদিন রাতে কোচিং করতেন। রাতে ডিউটি থাকলে দিনে ক্লাস করতেন। টানা ডিউটি থাকলে কোনো কোনো সময় ক্লাস মিস হতো। তখন বন্ধুদের সাহায্য নিতেন। দিনের পড়া দিনেই শেষ করার চেষ্টা করতেন। পুলিশে দৈনিক রোলকলের ব্যবস্থা আছে। পড়াশোনা করতে গিয়ে অনেক সময় রোলকল মিস করে ফেলতেন। এ জন্য কথাও কম শুনতে হয়নি।

যাহোক, প্রথমবারের মতো বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন হাকিম। কৃতকার্য হওয়ার পর আটঘাট বেঁধে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার বৈতরণীও পার হলেন সাফল্যের সঙ্গে। গত ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পুলিশ ক্যাডারের মেধাতালিকায় ৬৭তম হলেন হাকিম।

বললেন, “আমি তখন ঘুমে ছিলাম। ঘুম ঘুম চোখে ফল দেখলাম। উত্তেজনায় নিজের রোল নম্বরই খুঁজে পাইনি। ভাবলাম হয়নি। বিকেল ৪টায় ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি জোন থেকে এসআই আশরাফুল ইসলাম আমাকে ফোন করলেন। বললাম, স্যার, আমার তো হয় নাই! স্যার আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘পড়ালেখা চালিয়ে যাও, সামনে হবে। ’ ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ পর অনলাইনে ঢুকে দেখলাম, লোকজন অভিনন্দন জানাচ্ছে। পরে চোখ কচলে নিজের রোল নম্বরটা আবার মিলিয়ে নিলাম। দেখলাম, না, ঠিকই আছে। পুলিশ ক্যাডারে ৬৭তম হয়ে এএসপি হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। ”

অল্প দিনের মধ্যেই স্বপ্নের চাকরিতে যোগদান করবেন হাকিম। নিজে কনস্টেবল ছিলেন। একেবারে ভেতর থেকে দেখেছেন সমস্যাগুলো। বললেন, ‘আমি যে পরিস্থিতিতে ডিউটি করেছি, দায়িত্ব পেলে আমার অধীন সহকর্মীদের সেই দুর্ভোগ লাঘবের চেষ্টা করব, বিশেষ করে কনস্টেবলদের। সবার সঙ্গে এখন যেমন আছি, তখনো তেমন থাকব। ’