তেল-চিনি-ছোলায় ভরপুর খাতুনগঞ্জ, নেই বেচাকেনা

| আপডেট :  ২৪ মার্চ ২০২২, ০৩:৫৬ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৪ মার্চ ২০২২, ০৩:৫৬ অপরাহ্ণ

আসছে পবিত্র রমজান মাস। এ মাসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই চাহিদা বাড়ে ছোলা, ডাল, তেল, চিনিসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের। ফলে বেড়ে যায় বেচাকেনাও। কিন্তু সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি হলেও বেচাকেনা তেমন নেই। এমনকি পণ্যের দাম কমলেও দেখা মিলছে না ক্রেতার। ফলে সেখানে বিরাজ করছে এক ধরনের গুমোট পরিস্থিতি। ব্যবসায়ীদের মাঝে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। বিশেষ করে বেশি অস্বস্তিতে রয়েছেন আমদানিকারকরা।

আমদানিকারকদের তথ্যমতে, পুরো বছর দেশে ছোলার চাহিদা থাকে প্রায় দুই থেকে দুই লাখ ১৫ হাজার টন। এর মধ্যে রমজানেই কেবল চাহিদা থাকে প্রায় ৭০ হাজার টন। অথচ চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম সাড়ে আট মাসেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছোলা আমদানি হয়েছে আড়াই লাখ টনের বেশি। রমজানে ৭০ হাজার টনের চাহিদা থাকলেও গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার টনের বেশি ছোলা আমদানি হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অবিক্রীত ছোলার মজুতও ছিল এবার। সব মিলিয়ে শুধু রমজানের চাহিদার দ্বিগুণ ছোলা মজুত রয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে ছোলাসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম।

শুধু ছোলা নয়, মটর-মসুর ডাল, এমনকি সয়াবিন তেল ও চিনির আমদানিও হয়েছে চাহিদার চেয়ে বেশি। তবে রমজান সামনে রেখে সে অনুপাতে গত কয়েকদিনে দেশের অন্যতম এ ভোগ্যপণ্যের বাজারে কোনো বেচাকেনা নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, খাতুনগঞ্জে লোকজনের আনাগোনা থাকলেও বেচাকেনা হচ্ছে না।

‘চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, খাতুনগঞ্জে গত কয়েকদিন কোনো ছোলা, ডাল, তেল, চিনির বেচাকেনা নেই। সামনে যে রমজান সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। অন্য বছর এসময় দেদারছে বিক্রি হতো। এবার সেই চিত্র নেই। সব ধরনের পণ্যের দাম প্রতিদিনই কমছে।

তিনি জানান, বর্তমানে খাতুনগঞ্জে ছোলা মানভেদে কেজিপ্রতি ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও যা কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা বেশি ছিল। ছোলার মতো মটরের দামও কমেছে। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি মটর ৪৭ টাকা থাকলেও সবশেষ বুধবার (২৩ মার্চ) ৪৪ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে। একইভাবে মসুর ডাল আগে ৮৯ টাকা ছিল, এখন ৮৭ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

বর্তমানে পুরো খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্য নিয়ে অস্থিরতা চলছে বলে জানান ব্যবসায়ীদের এই নেতা। তিনি বলেন, পণ্যের দাম হু হু করে কমছে। আমদানিকারকরা পণ্য আমদানি করে অস্বস্তিতে আছে। মূলত আমদানি বেশি হওয়ায় বাজারে দরপতন হচ্ছে সব ধরনের পণ্যের।

ছোলা আমদানি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দুই লাখ ৫২ হাজার ২১৩ টন ৩২৪ কেজি ছোলা আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি আমদানি হয়েছে শেষ ৪৮ দিনে। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত টিসিবিসহ (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) দেশের ৬৬টি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এক লাখ ২০ হাজার ২৭৬ টন ৪১৫ কেজি ছোলা আমদানি করে। দেশের নামি দামি শিল্পগ্রুপ নিজ মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি করে এসব ছোলা।

এর মধ্যে নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড ২১ হাজার ৯০৬ টন ৬৫০ কেজি, সিটি ডাল মিল লিমিটেড ১৯ হাজার ৭২৪ টন ৪৭০ কেজি, বিডি পালস অ্যান্ড কমোডিটি ১৩ হাজার ৯ টন ৩১০ কেজি, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ ১৩ হাজার ২০০ টন, মেসার্স শেখ ব্রাদার্স ১০ হাজার ৪২৭ টন ৮০ কেজি এবং টিসিবি ৯৪৭ টন ৮২৫ কেজি ছোলা আমদানি করে।

ডাল আমদানি

অন্যদিকে শেষ ৪৮ দিনে এক লাখ ১০ হাজার ৯৮৬ টন ১৯০ কেজি মটর ডাল আমদানি করেছে ২২টি প্রতিষ্ঠান।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে গত ১ জুলাই থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত তিন লাখ ১২ হাজার ৫৪৬ টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ৪৮ দিনে আমদানি হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি। এই সময়ে এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৩৭ টন ১৯০ কেজি ডাল আমদানি হয়।

তেল আমদানি

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে আট মাসেই আমদানি হয়েছে এর চেয়ে বেশি।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মার্চ পর্যন্ত ২৪ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭ টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। শেষ আড়াই মাসে আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ টন তেল। বেশির ভাগই আমদানি করেছে দেশের শীর্ষ পাঁচ শিল্পগ্রুপ।

চিনি আমদানি

অন্যদিকে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মতে, দেশে বছরে প্রায় ১৮ লাখ টন চিনির চাহিদা থাকে। অথচ এই অর্থবছরের প্রথম আট মাস ২০ দিনে চিনি আমদানি হয়েছে পুরো বছরের চাহিদার চেয়েও বেশি।

এনবিআরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকে গত ২০ মার্চ পর্যন্ত দেশের পাঁচটি বেসরকারি সুগার মিল ১৯ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৭ টন ১৩০ কেজি অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে। এর মধ্যে ২০ মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৯৪৯ টন ১৫০ কেজি অপরিশোধিত চিনি।

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে দেশের শীর্ষ শিল্পগ্রুপ মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি এই সময়ে ছয় লাখ ৬৫ হাজার ৩১৫ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। এর মধ্যে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টন অপরিশোধিত চিনি।

একইভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছয় লাখ ১৪ হাজার ৩৫৫ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এর মধ্যে শেষ ৪৮ দিনে প্রতিষ্ঠানটি আমদানি করেছে এক লাখ ৫৮ হাজার ৫৫৩ টন ৫০০ কেজি অপরিশোধিত চিনি।

এছাড়া চলতে অর্থবছরের শুরু থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ তিন লাখ ১২ হাজার ৫৯০ টন ৬৫০ কেজি, দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড এক লাখ ৫৬ হাজার ৯৬০ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে।

এর মধ্যে শেষ ৪৮ দিনে এস আলম আমদানি করেছে এক লাখ ৪১ হাজার ২৪৫ টন ৬৫০ কেজি অপরিশোধিত চিনি। আর ২৪ হাজার ৪০০ টন চিনি আমদানি করেছে দেশবন্ধু সুগার মিলস।

তেল- চিনির দাম

সম্প্রতি দেশে হঠাৎ করেই ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। বেড়ে যায় সয়াবিন তেলের দাম। কিন্তু খাতুনগঞ্জে সপ্তাহের ব্যবধানে তেলের দাম কমে যায়। তারপরও অন্য সময়ের থেকে এবার বেচাকেনা কম বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জের তেল ও চিনি ব্যবসায়ী মেসার্স আহাদ ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আবুল বশর বুধবার বিকেলে জাগো নিউজকে বলেন, বাজারে বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম সরকার নির্ধারিত দর থেকে প্রতি মন ৩০০ টাকা করে কম।

তিনি জানান, ২৩ মার্চ এস আলমের পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি পাঁচ হাজার ২০ টাকায়। একইভাবে টিকে গ্রুপের পাম অয়েল পাঁচ হাজার ৭০ টাকা, সিটি গ্রুপের পাম অয়েল পাঁচ হাজার ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত এক সপ্তাহ আগেও প্রতি মণে ১০০ টাকা বেশি ছিল।

এই ব্যবসায়ী বলেন, পাম অয়েলের পাশাপাশি সয়াবিন তেলের দামও সপ্তাহের ব্যবধানে মণপ্রতি ২০০ টাকা কমেছে। গত সপ্তাহে এস আলমের সয়াবিন ছিল পাঁচ হাজার ৭০০ টাকা, টিকে ও সিটির সয়াবিনের দাম পাঁচ হাজার ৮ টাকা ছিল। এখন এস আলম সয়াবিন প্রতি মণ পাঁচ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পাশাপাশি চিনির দামও কমেছে। ২৩ মার্চ বিকেলে পর্যন্ত এস আলমের চিনি মণপ্রতি দুই হাজার ৬২০ টাকা, সিটি ও ফ্রেশ (মেঘনা গ্রুপের) চিনিও প্রতি মণ ২ হাজার ৬৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেও এসব চিনির দাম প্রতি মণে কমপক্ষে ৫০ টাকা বেশি ছিল বলে জানান তিনি।

এ ব্যবসায়ী বলেন, আমদানি বেশি হয়েছে বলে বাজার কমছে তা কিন্তু নয়। বাজারে ডিও অনেক আছে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না। কারণ সারাদেশে সরকারিভাবে নজরদারি বেড়েছে। সেজন্য ব্যবসায়ীরা পণ্য (ভোগ্যপণ্য) কিনছে না। যে কারণে বাজার কমলেও বিক্রি নেই।